মানুষের নানা ধরনের যৌন চরিত্র রয়েছে। বিপরীতকামী ও সমকামীই এ ক্ষেত্রে সবকিছু নয়, অনেকের যৌনতার চরিত্রকে এসেক্সুয়াল বা যৌনতাহীন বলে ধরা হয়। এ ধরনের ব্যক্তি মূলত যৌন সম্পর্ক বিষয়ে কোনো আগ্রহ পান না।
এই যেমন বিয়ের পরই এক নারী বুঝতে পারেন যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার ক্ষেত্রে কোন আকর্ষণই পাচ্ছেন না তিনি, বরং বিষয়টি তার কাছে কারো প্রতিই আকর্ষণ বোধ করি না এমন একটি অনুভূতি বলে মনে হচ্ছিল।
যৌন সম্পর্কের বিষয়টি তার কাছে ধর্ষণের মতো মনে হত। নিজের নাম পরিচয় গোপন রেখে বিবিসি বাংলার কাছে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন তিনি।
ওই নারী বলেন, যৌনতায় তার এই অনাগ্রহের কথা স্বামীকে জানালে স্বামী আরও বেশি জোর-জবরদস্তি শুরু করেন, যেটা ওই নারীর কাছে যৌন নির্যাতনের মতো মনে হয়। প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরেই তিনি এর ভুক্তভোগী।
পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে কোন আগ্রহ পান না। তারা নারী কিংবা পুরুষ কোন লিঙ্গের মানুষের প্রতিই আকর্ষণ বোধ করেন না। এ ধরণের ব্যাক্তিদের এসেক্সুয়াল বা অযৌনচিত্ত বলা হয়।
কিন্তু এসব এসেক্সুয়াল ব্যক্তিদের অনুভূতিগুলো কেমন হয়? যৌন সম্পর্ক স্থাপনে তাদের এই অনাগ্রহের কারণে তাদের কী ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় কিংবা সমাজ বা পরিবার তাদের কী চোখে দেখে?
এ বিষয়ে ওই নারী বলেন, এমনিতেই অনেকে বলে যে বাঙালি মেয়েদের যৌন আগ্রহ কম থাকে। কিন্তু বিয়ের পরে ঘাটাঘাটি করে জানলাম আমি এসেক্সুয়াল। স্বামীকে এটা জানানোর পর সে বললো, আমারওতো একটা চাহিদা আছে; আমি সেক্সুয়াল পার্সন। তখন সে বলতো, তুমি অন্য স্টাইলে চেষ্টা করো।
এসেক্সুয়ালিটি কি?
নারী ও পুরুষের যৌন চেতনায় বিরাট একটা পার্থক্য আছে তাদের এসেক্সুয়ালিটি নিয়ে। এসেক্সুয়ালিটি হলো একটি সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন যা ১ শতাংশের কাছাকাছি নরনারী LGBTQ-এর মতই জন্মগত ভাবে পেয়ে থাকে।
তাদের বৈশিষ্ট হলো, তারা কোনো জেন্ডারের প্রতিই সেক্সুয়ালি এট্রাকটেড অনুভব করে না। তারা ইম্পটেন্ট নয়, শারীরিক ভাবে যৌন মিলনে খুবই সক্ষম। তারা ব্রহ্মচারীও নন আবার, একই বা বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু-বান্ধবও থাকে। কিন্তু তারা তাদের কারো সঙ্গে যৌনতা ইনক্লুসিভ কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ান না বা জড়াতে পারেনই না।
এসেক্সুয়াল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা দীপা মাহবুবা ইয়াসমিন বলেন, এসেক্সুয়ালের পরিসর এখন অনেক বড়। অনেকে আছেন, যারা কারও স্পর্শ পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না। আবার অনেকের এসেক্সুয়ালিটি হচ্ছে সেক্স বিদ্বেষী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞান এখনও যৌনতাহীন বা যৌন আকর্ষণ বোধ না করার কারণ নির্ণয় করতে পারেননি। এ ধরনের ব্যক্তিরা শারীরিক সব লক্ষণ ঠিক থাকার পরও যৌনতায় কোনো আকর্ষণ বোধ করেন না। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এর পেছনে মানবদেহের জিনের ভূমিকা থাকতে পারে।
জনপ্রিয় ধারণা
অনেকেই যৌনতার ক্ষেত্রে কোনো আকর্ষণ বোধ করেন না। এ ক্ষেত্রে তাদের ধারণা হতে পারে এটি হয়ত নিজের জন্য উপযুক্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তি খুঁজে না পাওয়ার সমস্যা। যদিও কোনো ব্যক্তির প্রতিই এ ধরনের মানুষরা যৌন আকর্ষণবোধ করেন না।
এ বিষয়ে জুলি সন্দ্রা তার বই ‘দ্য ইনভিজিবল ওরিয়েন্টেশন : অ্যান ইন্ট্রুডাকশন টু এসেক্সুয়ালিটি’-এ বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, বহু মানুষই যৌনতার তাগিদ না পাওয়াকে গুরুত্ব দেন না। অনেকের ধারণা থাকে এটি সঠিক মানুষ খুঁজে না পাওয়ার বিষয় কিংবা যৌনতার বিষয়ে অভ্যাস না থাকার কারণে হয়।
তবে যৌনতাহীন ব্যক্তিদের মানসিকভাবে অসুস্থ বলেও ধরা যায় না। এমনকি ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে, তাও নয়। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সমস্যা।
আবেগগত সংযোগ
কিছু যৌনতাহীন ব্যক্তি বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি পরিপূর্ণভাবে আগ্রহ বোধ করে না। অনেকে আবার কিছুটা আকর্ষণবোধ করে। তবে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, কিছু যৌনতাহীন ব্যক্তি অপরের সঙ্গে রোমান্টিকভাবে সংযুক্ত হতে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের অনুরূপ যৌনকামনাসম্পন্ন ব্যক্তি খুঁজে বের করাই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্সিটসিন হরমোনটি অর্গাজমের সময় নির্গত হয়। এটি আবেগগত সম্পর্ক তৈরি করতে কাজ করে। কিন্তু এ হরমোনটি তৈরি না হলে রোমান্টিকভাবে সম্পর্ক তৈরি করা কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে অনেক যৌনতাহীন ব্যক্তিই রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াতে চান না।
দুই ধরনের যৌনতাহীন ব্যক্তি
একেবারেই যৌনতাহীন ব্যক্তি ছাড়াও বেশ কয়েক ধরনের যৌনতাহীন ব্যক্তির কথা জানান চিকিৎসকরা। এগুলো হলো :
ডেমিসেক্সুয়াল:
এ ধরনের ব্যক্তিরা সাধারণত যৌনতাহীন থাকলেও মনের মতো কারো সঙ্গে দেখা হলে ধীরে ধীরে যৌনতা অনুভব করতে শুরু করেন। মূলত আবেগগত সম্পর্ক তৈরির পর বিষয়টি পরিবর্তিত হয়।
গ্রেসেক্সুয়াল:
এ ধরনের ব্যক্তি খুব বিরল ঘটনায় যৌন আকর্ষণ বোধ করেন। এটি মূলত যৌন ও অযৌনের মাঝামাঝি পর্যায়। এরা সাধারণত যৌনতা অনুসন্ধান করেন না এমনকি কোনো সম্পর্কে জড়ালেও তা হয় না।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞান এখনও যৌনতাহীন বা যৌন আকর্ষণ বোধ না করার কারণ নির্ণয় করতে পারেননি। এ ধরনের ব্যক্তিরা শারীরিক সব লক্ষণ ঠিক থাকার পরও যৌনতায় কোনো আকর্ষণ বোধ করেন না। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এর পেছনে মানবদেহের জিনের ভূমিকা থাকতে পারে।
সচেতনতার অভাব
অধিকাংশ মানুষই যৌনতাহীন ব্যক্তিদের বিষয়টি নিয়ে অজ্ঞানতায় থাকেন। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে যথাযথভাবে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এতে বিষয়টি নিরাময়ের উপায় নিয়েও কোনো বিষয় জানতে পারেন না ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে ড. কামিনি দেশমুখ বলেন, ‘যথাযথ সচেতনতা ও শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে যৌনতাহীন মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা উচিত। এতে তারা নিজেদের বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন এবং তাদের অনুভূতি অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারবেন। এ ছাড়া এতে তাদের ভয় ও ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান হবে।’
এসডব্লিউএসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ