জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে হত্যা করা হয়েছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে—রব্বানির স্বজন ও সহকর্মী সাংবাদিকদের এ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যে চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে এসেছে।
উল্লেখ্য, গত বুধবার রাতে সন্ত্রাসীরা রব্বানির ওপর হামলা চালায়। পরদিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। রব্বানি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলার সংবাদ সংগ্রাহক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।
রব্বানি হত্যার ঘটনায় সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তাঁরা সবাই চেয়ারম্যানের অনুসারী বলে পরিচিত। তবে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম পালিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়নি।
এদিকে রব্বানির বিচারের দাবিতে জামালপুরে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা। হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে পেশাজীবী, মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠন।
রব্বানির স্বজন, সহকর্মী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রব্বানির ওপর হামলার পরও সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা এলাকাতেই অবস্থান করছিলেন। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এলাকা ছেড়েছেন।
জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত, ওই চেয়ারম্যানের নির্দেশেই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ঘটনাস্থলের অনেকের ভাষ্যমতে, ওই হত্যাকাণ্ডের মূল মদদদাতা ওই চেয়ারম্যান (মাহমুদুল আলম)। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মাহমুদুল আলম বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সাংবাদিক রব্বানির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ওই চেয়ারম্যান।
বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু বকশীগঞ্জের মানুষ নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষ ওই চেয়ারম্যানকে (মাহমুদুল আলম) অভিযুক্ত করছেন। ইতিমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগ ওই চেয়ারম্যানকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁকে বহিষ্কার করা হবে।’
ভিডিও ফুটেজ দেখে ছয়জনকে আটক
রব্বানি হত্যার ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত মামলা হয়নি। ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে গোলাম কিবরিয়া ওরফে সুমন, মো. তোফাজ্জল, মো. কফিল উদ্দিন, মোহাম্মদ আয়নাল হক, মো. শহিদ ও ফজলুল হককে আটক করে। তাঁদের সবার বয়স ২৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে গোলাম কিবরিয়ার বাড়ি ঘটনাস্থল পাটহাটি এলাকায়। তিনি যুবলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত। আয়নাল হক চেয়ারম্যান মাহমুদুলের অতি ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত। বাকিরা চেয়ারম্যানের অনুসারী বলে স্থানীয়ভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো (গতকাল সন্ধ্যা) থানায় মামলা হয়নি। তবে দ্রুত মামলা হবে। এ ঘটনায় আগে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আরও চারজনকে আমরা আটক করতে সক্ষম হয়েছি।’
র্যাবের ছায়া তদন্ত
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সাংবাদিক রব্বানি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংস্থাটি ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রতিবাদ
গোলাম রব্বানি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জামালপুর অনলাইন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের উদ্যোগে সভা হয়েছে। জামালপুর শহরের শহীদ হারুন সড়কের ওই সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়ে প্রতিবাদ সভা হয়।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চেয়ারম্যান মাহমুদুলের গ্রেপ্তারের দাবিতে রব্বানির জানাজায় অংশ নেওয়া সাংবাদিকেরা বকশীগঞ্জ থানা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ ছাড়া বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বকশীগঞ্জ উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণের ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই তিনটি কর্মসূচিতেই বক্তারা চেয়ারম্যান মাহমুদুলকে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত করে তাঁকেসহ জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
রব্বানি হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মানবাধিকার ও সাংবাদিকদের সংগঠন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে সাংবাদিক হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এ ঘটনা জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) রব্বানি হত্যাকাণ্ডকে মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হতাশাজনক ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে। টিআইবি বলেছে, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার জেরে সাংবাদিকদের ওপর অবারিতভাবে চলমান হামলা, মামলা, নির্যাতন ও হত্যা বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ), গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বিবৃতি দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেছে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ।
রব্বানি হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। একই সঙ্গে সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সুরক্ষা দিতে আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানায় প্যারিসভিত্তিক এই সংগঠন।
এসডব্লিউএসএস১২১০
আপনার মতামত জানানঃ