দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল ফার্নেস অয়েল। এসব জ্বালানির বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ জ্বালানি চাহিদার প্রয়োজন পড়ছে, তার বার্ষিক আমদানি ব্যয় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। বিপুল পরিমাণ এ জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে হিমশিম খাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে বিদ্যমান জ্বালানির বাজারদর বিবেচনায় বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি দরকার হবে।
জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগকে। নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে জ্বালানি আমদানি বাবদ যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে, তার সংস্থান নিয়ে রয়েছে সংশয়। জ্বালানি নিরাপত্তায় টেকসই অর্থনীতি ও বাজেটে এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেন তারা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালাতে বছরে প্রায় ছয় লাখ টন ফার্নেস অয়েল, এলএনজি ও কয়লা আমদানি করতে হয় জ্বালানি বিভাগকে। বছর শেষে হিসাব অনুযায়ী, এ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার।
জ্বালানিসংশ্লিষ্ট সূত্রের হিসাবে দেখা যায়, স্পট মার্কেট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৯০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করতে হলে বছরে শুধু এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার (গড়ে ১০ ডলার হিসেবে), যার পুরোটা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার না হলেও অনেকাংশে এলএনজিনির্ভর।
দেশে বর্তমানে ২ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট আমদানিনির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারদরে প্রতি টন কয়লার দাম গড়ে ১৫০ ডলার হিসাবে বছরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে। এছাড়া ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য বছরে প্রায় ছয় লাখ টন জ্বালানি আমদানি করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসির ফার্নেস অয়েল আমদানির পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৫৮৬ টন। যার আমদানি ব্যয় ১ হাজার ৭১০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে ডলারের বিনিময় মূল্য গড়ে ৮৫ টাকা হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ কোটি ১২ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪৭ ডলার।
দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানির পাশাপাশি পরিবহন, শিল্প ও কৃষি খাতের জন্য ডিজেল, অকটেন, জেট ফুয়েল, মেরিন ফুয়েলসহ বেশকিছু জ্বালানি পণ্য আমদানি করা হয়। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি হয়। আমদানীকৃত এসব জ্বালানি পণ্যে ব্যয় হয় ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটাতে বছরে ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১১ হাজার ৩৭২ মেগাওয়াট। যদিও বর্তমানে গ্যাস সংকটের কারণে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে ৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মতো। নির্মাণাধীন কেন্দ্রগুলো আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে প্রস্তুত হলে দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট। বর্তমানে স্থানীয় গ্যাসের বাইরে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। দৈনিক ৯০০ এমএমসিএফডি সরবরাহ সক্ষমতা চালু থাকলে বছরে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট এক প্রক্ষেপণে দেখা যায়, ২০২৭ সাল নাগাদ দেশে গ্যাসভিত্তিক ১৬ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৬ হাজার ৪৯৭ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক ৭ হাজার ৯১ মেগাওয়াট, আমদানি সক্ষমতা দাঁড়াবে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট ও পরমাণুভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হবে ৫৯১ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা ও বিদ্যমান বাজার দর হিসাব করলে সংশ্লিষ্ট বছর থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটাতে হবে। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য ৬-৭ বিলিয়ন ডলার, কয়লায় ৫ বিলিয়ন এবং আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ, ফার্নেস অয়েল, নিউক্লিয়ার ফুয়েলের জন্য ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ অনুযায়ী, দেশে ২০২৫-২৬ সাল নাগাদ গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বিদ্যমান গ্যাসের সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে তিন হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি (এলএনজিসহ)। স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ একই পরিমাণ থাকলে দৈনিক আরো প্রায় আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হবে।
আমদানিনির্ভর কয়লার ওপর দেশে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলমান রয়েছে। বছরজুড়ে এ সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু থাকলে ৮০ লাখ ৩০ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন পড়ে। বিদ্যমান বাজারদরে প্রতি টন কয়লার দাম গড়ে ১৫০ ডলার হিসাবে বছরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের (১২০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার) কয়লা আমদানি হচ্ছে। আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ দেশের বিদ্যমান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু হলে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা দাঁড়াবে সাত হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে বছরে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
দেশে জ্বালানি তেলচালিত (ফার্নেস অয়েল) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা রয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট (৬ হাজার ৪৪১ মেগাওয়াট)। পিক ডিমান্ডের ভিত্তিতে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালায় বিপিডিবি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সাড়ে ছয় লাখ টন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি আমদানি করে। দেশের জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশ আমদানিনির্ভর। বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি পণ্য আমদানি করছে বিপিসি। ডিজেল, জেট, ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল ও অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্যসহ বছরে ছয় মিলিয়ন টন (৬০ লাখ টন) জ্বালানি আমদানি হয়। এসব জ্বালানি পণ্যের দাম গড়ে ১০০ ডলার হিসাব করলে বছরে ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়।
গত বছরের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখীর প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট একটি প্রক্ষেপণে দেখা যায়, দেশের নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠলে আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি করতে প্রয়োজন পড়বে ২০-২৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম নিম্নমুখী হলেও এ অর্থের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি থাকবে।
জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যে পরিকল্পনা থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে বিপুল অংকের জ্বালানি আমদানি করতে হবে। তবে সেই তুলনায় জ্বালানির বিষয়টিকে গুরুত্ব কম দেয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘দেশে গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু হলে ২০২৭ সাল নাগাদ জ্বালানি আমদানির জন্য বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করতে হবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে দুটি মৌলিক সিদ্ধান্তে আসতে হয়। হয় নিজস্ব জ্বালানি নির্ভরতা ও সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। নতুবা আমদানিনির্ভর জ্বালানির জন্য বরাদ্দ ও বিনিয়োগের সংস্থান করতে হবে।’
তিনি মনে করেন, দেশে জ্বালানি নিশ্চয়তা তৈরি করতে হলে এ খাতে প্রচুর অর্থ ও বিনিয়োগ আনতে হবে। তাহলে হয়তো একটা স্থিতিশীল অবস্থায় আসা যাবে।
দেশে জ্বালানি সংকটে বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ভুগছে। এ পরিস্থিতিতে আগামীতে চলমান প্রকল্পগুলো উৎপাদনে এলে জ্বালানির সংস্থান কীভাবে হবে তা নিয়ে কথা হয় বিদ্যুৎ খাতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সঙ্গে। সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমরা নির্মাণ করেছি আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানোর জন্য। পাশাপাশি সব ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যও এটি। আমরা কয়লা আমদানির বিষয়ে তিনটি বাজার ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। এসব বাজারে যখন যেখানে মূল্য সাশ্রয়ী হবে সেখান থেকে কয়লা আমদানি করব।’
দেশে জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে সারা দেশে বেড়ে গিয়েছে লোডশেডিং। শহরে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি মফস্বল এলাকায় ১২-১৪ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ের অভিযোগ করেন গ্রাহকরা। দৈনিক আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। লোডশেডিংয়ের বিষয়টি নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, তাপপ্রবাহ বেড়ে গেছে, পাশাপাশি বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে গেছে। আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ