মার্চ মাসে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়ার চার মাসের মাথায় কেন ‘পরিকল্পিত’ লোডশেডিং দিতে হলো, এই প্রশ্ন এখন সবার মনেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলেন ইজাজ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন জোর করে করা একটা ব্যাপার। শতভাগ বিদ্যুতায়নের সক্ষমতা আমাদের নেই। তড়িঘড়ি করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দিকে যাওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তাদের পুরো সম্পদ ও মনোযোগ সেদিকেই রাখতে হয়েছে।
ফলে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন তখনই হবে, যখন আমরা উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রস্তুত হতে পারব। গ্রামের মানুষেরা তো শহরের মানুষের তুলনায় অনেক পরে বিদ্যুৎ পেয়েছেন। আরও কিছুদিন অপেক্ষা তো তাঁরা করতেই পারতেন। আমরা যদি পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করতাম, তাহলে কি ক্ষতি হতো? এখন তো সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো।
জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকেই নাজুক অবস্থায় ছিলাম। আমরা যদি বিদ্যুতায়নটা যা হওয়ার কথা সেটাতেই রাখতে পারতাম, তাহলে চাহিদাটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেড়ে যেত না। তাতে এখনকার সংকট হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবে উতরে যাওয়া যেত। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে পরিকল্পনাহীনতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত হলো, এখন জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের ৫৫ শতাংশ গৃহস্থালি বা বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত হয়।
গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ ভোগের বৃদ্ধিটা মূলত গৃহস্থালিতেই বেড়েছে। ১০ বছর আগে শিল্প ও গৃহস্থালিতে ব্যবহার প্রায় সমান (২৭ শতাংশের মতো) ছিল। এখন শিল্প খাতে এর হিস্যা ৩০ শতাংশ।
আবার অপরিকল্পিত বিদ্যুতায়নের কারণে আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির খুব সফল যে সোলার হোম সিস্টেম ছিল, সেটাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ৬৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম ছিল, সেগুলোর অর্ধেকের বেশি এখন পরিত্যক্ত। আমরা আসলে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা শুধু পাওয়ার প্ল্যান্ট করে গেছি। কিন্তু পাওয়ার প্ল্যান্ট তো আর বিদ্যুৎ নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনযন্ত্র, তাতে তো জ্বালানি জোগাতে হবে। কিন্তু সেই জ্বালানি কোথা থেকে আসবে সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। এ কারণে আজ আমরা এমন বিপদে পড়েছি।
ইজাজ হোসেন বলেন, কোভিড মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের আগেও আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখার জন্য জ্বালানি জোগানোর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় ছিল। সংকটগুলো নানাভাবে ঢাকা দেওয়া ছিল। কোভিড আর ইউক্রেন যুদ্ধ না এলে মোটামুটি সেভাবেই চলত, কেউ বুঝতে পারত না। এখন এক ধাক্কাতেই চরম বিপদটা সামনে বেরিয়ে এল।
আমাদের পেট্রোবাংলা ও পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) মধ্যে কোনোরকম সমন্বয় নেই এবং পিডিবি যে পেট্রোবাংলাকে তোয়াক্কাও করে না—এটাই বর্তমান সংকটের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোনো নীতি নেই, কোনো পরিকল্পনা নেই। দিন আনি দিন খাই পরিকল্পনায় আমরা চলছি।
এখন প্রশ্ন জ্বালানি সাশ্রয়ে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাশ্রয় হলে লোডশেডিংয়ের কারণে বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় ডিজেলের ব্যবহার বেড়ে যাবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার সব ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেনি। সরকারের নিজস্ব মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। ডিজেলভিত্তিক সব কেন্দ্র বন্ধ রাখলে ডিজেল সাশ্রয় হতো, কিন্তু তাতে লোডশেডিং অনেক বেড়ে যেত। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে সরকার এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের সাশ্রয়ের কথা বলেছে। আমার ধারণা, শতভাগ সাশ্রয় হবে না। এর ৫০ শতাংশ সাশ্রয় হতে পারে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকটটা কতটা গভীর, সে প্রসঙ্গে ইজাজ হোসেন বলেন, সংকটটা আরও অনেক গভীর হতে পারে। সরকার বলছে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসবে, তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন তো অনেক আগেই শুরু হওয়ার কথা। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর পরও সঞ্চালন লাইনের কারণে পুরো বিদ্যুৎ আমরা পাচ্ছি না। সঞ্চালন লাইন ডিসেম্বরের পরে চালু হওয়ার কথা রয়েছে। রামপালের বিদ্যুৎও এই সঞ্চালন লাইন দিয়ে আসবে। ফলে সঞ্চালন লাইন আগে করা না গেলে নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব নয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু তেল-গ্যাস নয়, বিশ্বে কয়লার দামও বেড়ে গেছে। এখন যদি সরকার বলে কয়লার দাম বেড়ে গেছে, আমরা তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে পারছি না, তাহলে লাভটা কী হলো? ফার্নেস অয়েল আর কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যদি কাছাকাছি থাকে, তাহলে সংকট তো রয়েই যাবে। কেননা, ডলারের সংকটের কারণেই তেল-গ্যাস আমদানি কমিয়ে দিতে হয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রত্যাশিত বিদ্যুৎ পেতে গেলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ঠিক সময়ে ও ঠিকমতো উৎপাদনে আসতে হবে। সঞ্চালন সুবিধাগুলো ঠিকমতো থাকতে হবে। কয়লার দামও সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হবে। এই তিন শর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করছে বর্তমান সংকটটা কতটা গভীর হবে। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকায় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমে যাবে। কিন্তু মার্চ থেকে গরম শুরু হবে। তখন ওপরের তিনটি শর্ত পূরণ না হলে অনেক বড় সমস্যায় পড়তে হবে।
আবার আমাদের গ্যাসের সমস্যা রয়েই গেছে। প্রতিবছর গ্যাসের চাহিদাও বাড়ছে। সরকার এখন সংকটে পড়ে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেটা করতেও সময় লাগবে। আবার স্পট মার্কেটে এলএনজির এখন আকাশছোঁয়া দাম, আমদানি সম্ভব হবে না। কাজেই লোডশেডিং থেকে শিগগির মুক্তি মিলছে না।
এসডব্লিউএসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ