প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় একটি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আজ বুধবার বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তাকে বরখাস্ত করে। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির জরুরি সভায় বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বরখাস্ত হওয়া ওই শিক্ষকের নাম মো. মিজানুর রহমান (৪৫)। তিনি উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের মজলিশপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। তাঁর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ধুরুয়া গ্রামে।
মিজানুর রহমানের দাবি, তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হয়েছে। মিজানুর বলেন, ‘ওই সময় আমার ফেসবুক আইডিটা হ্যাকড হয়ে গিয়েছিল। বিষয়টা নিয়ে আমি বর্তমানে খুবই বিপদের মধ্যে আছি।’
মজলিশপুর উচ্চবিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন দাবি করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শিক্ষক মিজানুর রহমান গুরুতর অপরাধ করেছেন, যা একজন শিক্ষকের কাছে আমরা কখনোই প্রত্যাশা করিনি।
বিষয়টি নজরে এলে মঙ্গলবার পরিচালনা কমিটি জরুরি সভা ডেকে সর্বসম্মতিক্রমে ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাঁকে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের জন্য পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, মিজানুর রহমান তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ২১ মে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে পোস্টটি দেন। ওই পোস্টের পর এলাকায় মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
এ অবস্থায় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি জরুরি সভা ডেকে তাকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই পোস্ট দেওয়ার পর থেকে মিজানুর রহমান বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন বলে জানান তিনি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইফুল আলম বলেন, ‘শিক্ষক মিজানুর রহমানকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের বিষয়টি আমি জেনেছি। এ বিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোবাইলে আমার সঙ্গে পরামর্শও করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শিক্ষক হিসেবে মিজানুর রহমান কোনোভাবেই এমন পোস্ট দিতে পারেন না। এটা তার চাকরি নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’
মূলত পরিস্থিতি বিবেচনা করলে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ হিসেবে তকমা দেয়া হয় এখন। গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে। সেই সমালোচনা যে পক্ষ থেকেই আসুক না কেন, তা দমন করা হচ্ছে কঠিন হাতে।
হোক সে বিরোধীপক্ষ বা শিক্ষার্থী, সাংবাদিক বা সাধারণ নাগরিক। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বাংলাদেশে বিরোধীরা ততোই দমন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সংকুচিত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও।
তবে মনে রাখা উচিত কেউ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নয়। আসলে স্বাধীনতার ‘স্বপক্ষে’ বা ‘বিপক্ষের’ শক্তি আখ্যা দিয়ে সব মানুষকে বিচার করা যেমন যায় না, তেমনি ‘আওয়ামী লীগ’ বা ‘বিএনপি-জামায়াত’ দিয়েও সবাইকে বিবেচনা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ কোন রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেন না। তারা যে কোনো ইস্যুতে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। আর সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেই কেউ ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ বা ‘বিরোধী দলের প্রতিনিধি’ হয়ে যান না। বরং সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত করার চেয়ে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়াই সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে আমাদের।
তবে সমালোচনার বিরুদ্ধে সবসময়ই কঠোর অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়, তখন থেকেই গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করে র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ তালিকায় যোগ হয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ। যেখানে পুলিশি নির্যাতনে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন মনে করেন সরকারের সহিষ্ণুতার অভাব থেকেই এ ধরণের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে “অবমাননাকর” পোস্ট করায় ১৫ বছরের এক শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকার উত্তরে ভালুকায় পুলিশ গনমাধ্যমকে জানায় তারা শিশুটিকে গ্রেপ্তার করেছিল যখন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করে ছেলেটি “আমাদের মায়ের মত নেত্রীকে … অপবাদ” দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা করায় কাউকে গ্রেপ্তার করা শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন নয়, সর্বশেষ উপায় ছাড়া ১৮ বছরের নিচে কোন শিশুকে আটক করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেরও লঙ্ঘন। তবুও গ্রেফতার করা হয় ওই কিশোরকে।
এরপর ধীরে ধীরে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে আরও কঠোর থেকে কঠোর অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। চলতি বছর জানুয়ারিতেই আওয়ামী লীগের ‘আওয়ামী’ শব্দের অর্থ বিকৃত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে এক তরুণকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় রাজশাহীর একটি আদালত।
মূলত, একটি স্বাধীন দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক৷ এই স্বাধীনতা নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনাই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ সেই আলোচনা নিয়েই আছে। স্বাধীনতা অর্জন করেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে কখনো বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করতে পারেনি।
এসডব্লিউএসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ