বসবাসের জন্য দালান অট্টালিকা নির্মাণ করে মানুষ। গড়ে তোলে সুশীল সমাজব্যবস্থা। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এমন সমাজব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে পশু-পাখিদের মাঝেও। এমনকি শৃঙ্খলার দিক দিয়ে তারা ছাড়িয়ে গেছে মানুষকেও। বসতবাড়ি নির্মাণে এদের স্থাপত্য কৌশল অবাক করে দেওয়ার মতো। লিখেছেন পরাগ মাঝি
ভোগেলকপ বাওয়ারবার্ডের বাসা
এমন রোমান্টিক পাখি পৃথিবীতে খুব কমই আছে। অস্ট্রেলিয়ার এই প্রজাতির পাখিরা বসবাসের জন্য দারুণ আকর্ষণীয় এক বাসা বানায়। পাখিটির নামের ‘বাওয়ার’ অংশটুকু এই বাসা বানানোর কৃতিত্বের জন্যই যুক্ত হয়েছে। ‘বাওয়ার’ শব্দের মানে ‘নিকুঞ্জ’।
ভোগেলকপ বাওয়ারবার্ডের বাসা সাধারণত মাটিতেই হয়ে থাকে। ছোট ছোট গাছের ডাল দিয়ে বানানো এই বাসাটি অনেকটা তাঁবুর আকৃতি হয়। বাসা বানানোর পুরো কৃতিত্ব পুরুষ পাখির। বাসার কাঠামো দাঁড় করানোর পর আসে এটিকে সাজানোর পালা।
নারীসঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য বাসার সামনেই নানা ধরনের ফুল, রঙিন পাতা, পালক আর চকমকে গুবরে পোকা ছড়িয়ে রাখে ওরা। প্রায় তিন ফুট উঁচু এবং পাঁচ ফুট জায়গাজুড়ে প্রশস্ত এই বাসাটি একটি দর্শনীয় ব্যাপার। বাসার সৌন্দর্যে বিমোহিত নারী পাখিটি ধীরে ধীরে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। এই প্রবেশের মধ্য দিয়েই শুরু হয় তাদের নতুন আরেকটি প্রজন্মকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার প্রথম ধাপ।
মৌমাছির বাসা
সৃষ্টি জগতের অপার বিস্ময় মৌমাছির বাসা। এই বাসাকে বলা হয় মৌচাক। মৌমাছি কতটা পরিশ্রমী প্রাণী তা বোঝার জন্য এদের সুনিপুণ কারিগরিতে বানানো বাসাটিতে একবার চোখ বুলালেই বোঝা যায়। মার্কিন গণিতজ্ঞ থমাস হেলস বলেন, মৌচাক হলো প্রকৃতির সবচেয়ে সুনিপুণ শৈল্পিক পদ্ধতিতে বানানো একটি বাসস্থান।
একটি মৌচাকের ভেতর অসংখ্য কুঠুরি থাকে। ষষ্ঠভুজাকৃতির এই কুঠুরিগুলো দারুণভাবে সুবিন্যস্ত। শ্রমিক মৌমাছির মোমগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত মোমের উপাদান দিয়ে তৈরি এই কুঠুরিগুলোতে বাচ্চা মৌমাছিরা বড় হয়। এখানে জমা থাকে মধু আর ফুলের পরাগ রেণু। মোম ছাড়াও বাসা নির্মাণে শ্রমিক মৌমাছি রেজিন জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করে। গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে এই পদার্থ তারা সংগ্রহ করে। এর ব্যবহারের ফলে বাসার গঠন শক্ত হয়।
মৌমাছির শরীরের আকার ও আয়তন অনুযায়ী প্রকোষ্ঠগুলো নির্মাণ করা হয়। মৌচাকে রানীর জন্য বানানো কুঠুরিটি হয় সবচেয়ে বড়।
পিঁপড়া কলোনি
পিঁপড়ারা একা থাকতে পছন্দ করে না। তাই এরা দলবেঁধে কলোনি বানিয়ে থাকে। প্রতিটি দলে থাকে সাধারণত একটি রানী পিঁপড়া, কয়েকটি পুরুষ পিঁপড়া এবং বাকি সব শ্রমিক পিঁপড়া।
পতঙ্গ জগতের মধ্যে পিঁপড়ারাই সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। প্রতিদিনই এরা ঘরদোর পরিষ্কার করে। বেশিরভাগ পিঁপড়াই মাটির নিচে বাসা বানায়। তবে পাথরের খাঁজে, গাছের শুকনো ডাল ফুটো করে, গাছের পাতা জুড়ে ইত্যাদি নানাভাবে এদের বাসা বানাতে দেখা যায়।
মাটির নিচের বাসাগুলো সুড়ঙ্গের মতো হয়। এই ধরনের বাসায় সাধারণত একটি বা দুটি প্রধান দরজা থাকে। সুরঙ্গের ভেতরে থাকে সারি সারি প্রকোষ্ঠ বা ঘর। রানী যে ঘরে থাকে সেটা সবচেয়ে বড় হয়। বাকি ঘরগুলোর কোনোটাতে থাকে ডিম, কোনোটাতে শূককীট, কোনোটাতে খাবার-দাবার ইত্যাদি।
অর্থাৎ, বিভিন্ন প্রয়োজনে এদের আলাদা আলাদা ঘর থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো এরা ঘরগুলো যেমন তেমন ভাবে বানায় না। প্রতিটি ঘরে যাতে বাতাস চলাচল এবং উত্তাপ ও জলীয় বাষ্পের মাত্রা ঠিক থাকে সেদিকে এদের সতর্ক দৃষ্টি থাকে। স্থাপত্য শিল্পে এই ক্ষুদ্র পতঙ্গগুলোর প্রযুক্তিগত কলা-কৌশল অবাক করে দেওয়ার মতো।
এক প্রজাতির পিঁপড়া আছে যারা বাসা বানানোর জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে পচা কাঠ, গাছের পাতা এবং গাছের ছাল। প্রথমে এরা এগুলো চিবিয়ে মণ্ডের মতো করে রোদে শুকিয়ে নেয়। তারপর সেগুলোতে নিজেদের শরীর থেকে বের হওয়া এক ধরনের আঠা মিশিয়ে তা আবার চিবিয়ে চেপ্টা করে ভিমরুলের চাকের মতো বাসা নির্মাণ করে।
এই জাতের পিঁপড়াগুলো ছয়-সাত মিলিমিটারের মতো লম্বা হয়। এদের পেছনে একটা হুল থাকে। সেখানেই থাকে এদের বিষের থলে।
পিঁপড়াদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বাসা বানায় নালসো পিঁপড়া। গাছের পাতার মধ্যে এই বাসাগুলো এমনভাবে লুকানো থাকে যে গাছের ডালে পিঁপড়ার সারি দেখা গেলেও এদের বাসাগুলো চট করে দেখা যায় না। বাসা বানানোর জন্য নালসো পিঁপড়া সাধারণত সোজা ও লম্বা পাতার ফলক পছন্দ করে। আমগাছের পাতা এই ধরনের হয় বলে এই গাছই এদের বেশি পছন্দ।
প্রথমে এরা পাশাপাশি দুটি পাতার একটির প্রান্তভাগ মুখ দিয়ে কামড়ে এবং অন্যটির প্রান্তভাগ পা দিয়ে আঁকড়ে টেনে ধরে। তখন আরেকটি দল পাতার উল্টো দিক দিয়ে পাতা দুটি জুড়তে থাকে। এই জোড়ার কাজটা বেশ অভিনব। পাতার পেছন দিকে যারা থাকে তাদের প্রত্যেকের মুখে থাকে একটি করে নিজেদের শূককীট বা লার্ভা। শক্ত চোয়াল দিয়ে শ্রমিক পিঁপড়ারা যখন এই শূককীটগুলোর দেহে চাপ দেয় তখন এদের মুখ দিয়ে রেশম সুতোর মতো এক ধরনের আঠালো সুতো বেরিয়ে আসে।
টেনে ধরার পাশাপাশি দুটো পাতার প্রান্তভাগে তখন এরা শূককীটগুলোর মুখ একবার এ পাতায় আরেকবার ও পাতায় ঠেকিয়ে ওই আঠালো সুতোর বুনোট দিতে থাকে। এইভাবে এরা একটার পর একটা পাতাজুড়ে গোলাকার বাসা তৈরি করে। প্রতিটি বাসার নিচের দিকে একটি গোলাকার দরজা থাকে। বাসা বানানোর পর এরা বাসাটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে।
কোথাও কোনো খুঁত বা ফুটো থাকলে শূককীটদের মুখ থেকে বের হওয়া আঠালো সুতো সেখানে বারবার লাগিয়ে খুঁত সারিয়ে ফেলা হয়। বাসাগুলো এত মজবুত হয় যে ঝড়-জলেও সহজে নষ্ট হয় না। এমনকি বাসার ভেতরে এক ফোঁটাও জল ঢোকে না।
মন্টেজুমা ওরোপেন্ডোলার বাসা
মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় এই ধরনের পাখির দেখা মেলে। মধ্য আমেরিকার মন্টেজুমা ওরোপেন্ডোলা পাখিদের বাসা আমাদের দেশের বাবুই পাখির মতো দেখতে অনেকটা। আঙুরগাছের শুকনো লতা বুনে এরা বাসা বানায়।
একটি নির্দিষ্ট গাছে বেশ কয়েকটা বাসা বানিয়ে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। সবচেয়ে শক্ত ডাঁটাগুলো এরা বাসার উপরিভাগে ব্যবহার করে আর নরমগুলো থাকে ভেতরের দিকে। সাধারণত বড় এবং বিচ্ছিন্ন একটি গাছকে এরা বাসা বানানোর জন্য বেছে নেয়। ডালে ডালে ঝুলে থাকে এই বাসাগুলো।
দুষ্ট বানর যেন বাসাগুলোর কোনো ক্ষতি কিংবা ডিম চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য কোনো একটি ডালের একেবারে চূড়ার দিকে হয় এগুলোর অবস্থান। এছাড়া মন্টেজুমা ওরোপেন্ডোলারা আরও একটি কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের সুরক্ষার জন্য। এক্ষেত্রে তারা ভিমরুলের বাসা আছে এমন গাছকে নিজেদের বাসা নির্মাণের জন্য বেছে নেয়। ঝড়ো বাতাসে এই বাসাগুলো বাতাসে উড়লেও সহজে ছিঁড়ে পড়ে না।
রুফোজ ওরনারোর বাসা
বেশিরভাগ পাখির বাসাই হয় ফাঁপা দেয়ালের। এইসব দেয়ালের মধ্য দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম রুফোজ ওরনারো পাখিরা। তাদের বাসার দেয়াল হয় নিচ্ছিদ্র এবং শক্ত। দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট এই পাখিটি গাছের মধ্যে কাদামাটি দিয়ে বাসা বানায়। ঠোঁটে করে দূর থেকে কাদামাটি সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে তাদের বাসা গড়ে তোলা হয়।
এই বাসাটি অনেকটা বাটি আকৃতির। কাদামাটির বাসাটি রোদে শুকিয়ে খুব শক্ত আকার ধারণ করে। ডিম পাড়ার আগে আগে এরা নতুন বাসা নির্মাণ করে। এ ধরনের বাসা শক্তিশালী বাতাস কিংবা বৃষ্টি থেকে তাদের রক্ষা করে।
প্রেইরি ডগদের শহর
কাঠবিড়ালির মতো দেখতে হলেও আকারে একটু বড় হয় প্রেইরি ডগ নামে উত্তর আমেরিকান প্রাণীটি। এরা মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলে এরা নিজেদের শহর নির্মাণ করে।
এই অঞ্চলটি চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু প্রেইরি ডগদের বানানো বাসাগুলো তাদের মাত্রাতিরিক্ত তাপ, বন্যা এবং আগুন থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
মাটির বিভিন্ন গভীরতায় এদের নির্মিত গর্তগুলো বিভিন্ন কাজে লাগে। মাটির বেশি গভীরতায় হয় অপেক্ষকৃত তরুণ ডগদের বসবাস। আর ওপরের দিকে থাকে বয়স্কদের কুঠুরিগুলো। শিকারিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই কুঠুরিগুলোতে তারা তাৎক্ষণিকভাবে অবস্থান নেয়। এছাড়াও থাকে খাদ্য মজুদের জন্য আলাদা কুঠুরি।
আর কয়েকটি কুঠুরিকে এরা নিরাপত্তা চৌকি হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে অবস্থান করে এরা শিকারিদের চলাফেরা এবং অবস্থানের ওপর তীক্ষ নজর রাখে। কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় প্রেইরি ডগ পরিবারগুলো দলবেঁধে অবস্থান করে বলে এগুলোকে প্রেইরি ডগ টাউন বলা হয়।
প্রতি একর ভূমিতে সাধারণত ৩৫টি প্রেইরি ডগ অবস্থান করতে পারে। ১৯০০ সালে টেক্সাসে এমন একটি প্রেইরি ডগ টাউন পাওয়া গিয়েছিল যা প্রায় ২৫ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। আর ওই শহরে প্রায় ৪০ কোটি প্রেইরি ডগের বসবাস ছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ