ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিকরা ততটুকুই প্রতিবাদ করেন, যতটুকু পর্যন্ত সরকার ক্ষিপ্ত হবে না৷ বিএনপি আমলে হলে বিষয়টি ভিন্ন হতো৷
নানা নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা৷ প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন৷ আরও আছে মামলার ভয়৷ সবসময় পাশে থাকে না প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো৷
এরই মধ্যে চার সপ্তাহ আগে, বাংলাদেশের এক সাংবাদিককে নিজ কার্যালয় থেকে তুলে নিয়ে বাজেভাবে মারধর করা হয় এবং তার ভবনের ছাদ থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়। এতে তার পিঠে জখম হয়, পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায়৷ তার মাথায়ও ছুরির ক্ষত ছিল।
একটি অপরাধী চক্রের সাথে স্থানীয় সরকারের সম্পর্কের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদনের জন্যই তার উপর হামলা করা হয়েছে বলে জানান সাংবাদিক আইয়ুব মিয়াজীর বিশ্বাস।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন
প্রভাবশালী বৃটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়ে বলা হয়েছেঃ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সংঘটিত এই হামলায় দেশটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবনতির আশঙ্কা আরো বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক সংবাদপত্র স্বাধীনতা সূচকে দেশটির অবস্থান একেবারে নিচের দিকে।
মার্চের শেষের দিকে, খাদ্যের উচ্চ মূল্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের বিষয়ে ভাইরাল হওয়া, আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এক প্রতিবেদনের জন্য দেশের বৃহত্তম সংবাদপত্র প্রথম আলোতে কর্মরত এক সাংবাদিককে বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
রিপোর্টার শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে “মিথ্যা সংবাদ” বানানোর অভিযোগ আনা হয়েছে এবং পত্রিকাটিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “জনগণের শত্রু” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছেন, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) প্রণয়নের পর থেকেই দেশটিকে ভুগতে হয়েছে। অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণা এবং চরমপন্থী উপাদান বন্ধ করার লক্ষ্যে আইনটি করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করলেও এই আইনের ফলে বহু মানুষ গ্রেপ্তার হওয়ার পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি ও সহিংসতা ছড়িয়েছে।
একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে কর্মরত এক বাংলাদেশি সাংবাদিক বলছেন, এ আইনের অস্পষ্ট ভাষা সাংবাদিকদের এবং তাদের সম্পাদকদের নিজেদের রিপোর্ট সম্পর্কে অতি সতর্ক করে তুলেছে।
তিনি বলেন, “ডিএসএ আসার পর থেকে আমরা নিজেদেরকে কারাগারে দেখতে না চাওয়ার বিষয়ে সতর্ক থেকেছি কারণ এটি সহজ… এটি একেবারেই ভয়ের।”
গণমাধ্যম কর্মীরা বলছেন, তারা ক্ষমতাসীন দল বা তাদের প্রকল্পগুলো নিয়ে সমালোচনামূলক সংবাদ এড়িয়ে গেছেন৷ কিন্তু, প্রথম আলোর উপর হামলার (যার মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দ্বারা বিক্ষোভ এবং ভয় দেখানোও অন্তর্ভুক্ত) ঘটনাটি বেশ ভালোভাবেই দেখিয়েছে যে, “দেশের ভাবমূর্তি” ক্ষুন্ন করা কিংবা মন্ত্রী বা কোনো কর্মকর্তাকে অস্বস্তিতে ফেলা সহ নানা ইস্যুতে সাংবাদিকরা কীভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সাংবাদিক জানান, “দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো নিয়ে রিপোর্ট করাটা নিরীহ বলেই মনে হয়েছিল। তবে শামসকে গ্রেপ্তারের পর, এটা স্পষ্ট যে আমরা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এমন বিষয়গুলো নিয়েও রিপোর্ট করতে পারি না।”
তারা বলছেন, ভয়টা শুধু ডিএসএ-এর অধীনে মামলার সম্মুখীন হওয়ারই নয়, সাংবাদিক ও তাদের পরিবারকে হুমকি এবং ভয়ভীতির সম্মুখীনও হতে হয়েছে। “এটি সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিরই একটি পন্থা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করতে আসে এবং কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কয়েক দিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় এবং কেউ জানেও না যে আপনাকে কোথায় নেওয়া হয়েছে।”
করোনা মহামারীতে সরকারের প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টের জন্য আটক হওয়ার নয় মাস পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ২০২১ সালে লেখক মুশতাক আহমেদ কারা হেফাজতে মারা যান।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) পরিচালিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ট্র্যাকার বলছে, এই আইন ব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৬০০ টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এগুলোর প্রায় অর্ধেকই ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে রাজনৈতিক দল বা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা দায়ের করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
এক সময় ডেইলি স্টারের মতামত বিভাগে কাজ করা নাজমুল আহসান স্মরণ করছিলেন, “আমরা জানতাম না কোন লেখাটি আমাদের সমস্যায় ফেলতে পারে। আমাদের বা আমাদের লেখকদের ভাগ্যে কী থাকতে পারে তার কোনো পরিষ্কার চিত্রও আমাদের কাছে ছিল না। খুবই সাধারণ অনেক বিষয় আমরা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি… একজন মধ্যস্তরের পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের বিষয়ে লেখা প্রকাশ করার আগে আপনাকে দুবার ভাবতে হবে।”
নাজমুল এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন৷ তিনি বলছিলেন, “এর ফলে অনেক সাংবাদিক নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছেন। কেউ কেউ বিদেশে যেতে চাইছেন এবং অন্যরা আশা করছেন (হয়তো নির্বাচনের মাধ্যমে) কোনো একটি পরিবর্তন আসলে তাদের উপর এই চাপ কমাতে পারে। এই সময়ের মধ্যে, তারা স্পর্শকাতর বিষয়গুলো কাভার করা এড়িয়ে যাচ্ছেন এবং প্রতিবেদনে কড়া ভাষা ব্যবহার করছেন না।”
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ মনে করেন, ডিএসএ সাংবাদিকদের উপর “গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে”। তিনি বলেন, “তারা সেটাই অনুশীলন করছেন, যাকে সেল্ফ-সেন্সরশিপ বলা হচ্ছে। কিন্তু, এটি সেল্ফ-সেন্সরশিপ নয় – এটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে এবং তাদের তা মেনেই চলতে হবে।”
আলী রীয়াজ বলেন, অনেক পত্রপত্রিকা সেইসব ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন যারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা যারা ভুল মানুষকে বিরক্ত করলে নিজেদের স্বার্থের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় থাকেন।
তিনি বলেন, সাংবাদিকরা দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে অনুসন্ধানী কাজ করতে ভয় পান বলে পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাংবাদিকরা এখন আর ভাবেন না: আমার সামনে কিছু একটা ঘটছে, যাই হোক না কেন আমি খুঁজে বের করবো এর নেপথ্যে কে আছে। তারা ভাবেন: ‘আমি ন্যূনতম কী লিখে বেঁচে থাকতে পারি?
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ