মহারাষ্ট্রে গত মাস ছয়েক সময়ের মধ্যে ‘হিন্দু জন-আক্রোশ মোর্চা’ নাম দিয়ে ৫০টিরও বেশি মিছিল হয়েছে, যেগুলি থেকে উস্কানিমূলক ভাষণ এবং বিতর্কিত ধর্মীয় ইস্যুগুলি তুলে ধরা হচ্ছে। মিছিলগুলিতে কথিত ‘লাভ জিহাদ’, ‘ভূমি জিহাদ’, মুসলমানদের অর্থনৈতিক বয়কট ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো নিয়ে আসা হচ্ছে।
বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা কর্মীরা ‘সকল হিন্দু সমাজ’ নামের একটি সংগঠনের পতাকাতলে মিলিত হয়ে এইসব র্যালির আয়োজন করছেন। রাজধানী মুম্বাই সহ মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন ছোট বড় শহরে আয়োজিত মিছিলগুলোতে ভালই লোক সমাগম হচ্ছে।
মিছিলে যেসব ইস্যু তুলে ধরা হচ্ছে
এই র্যালিগুলিতে নেতা আর বক্তারা যেসব বিষয়ে কথা বলছেন, তার মধ্যে আছে তথাকথিত ‘লাভ জিহাদের’ প্রসঙ্গ। বিশেষ করে হিন্দু নারী ও মুসলমান পুরুষের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক এবং ‘ভূমি জিহাদ’ বা ফাঁকা জায়গায় মসজিদ তৈরির মতো ইস্যু নিয়ে কথা বলা হচ্ছে।
মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করার আবেদনও করা হচ্ছে এসব র্যালি থেকে। ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা কর্মীদের বেশি সংখ্যায় দেখা গেলেও ক্ষমতাসীন বিজেপি ও শিবসেনা (শিণ্ডে গোষ্ঠী)-র কয়েকজন নেতা এবং কিছু জনপ্রতিনিধিদেরও এইসব র্যালিতে অংশ নিতে দেখা গেছে।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং শিবসেনা (শিণ্ডে গোষ্ঠী) নিজেদের এইসব র্যালি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং মুসলমান গোষ্ঠী হিন্দু জন-আক্রোশ মোর্চার এই সমাবেশ-মিছিলের সমালোচনা করছেন এই বলে যে এগুলো সামাজিক সৌহার্দ্যের পরিপন্থী।
ধর্মীয় মেরুকরণ
মহারাষ্ট্রে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসছে। তার আগে রাজ্যে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় মেরুকরণ হতে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন এই ধর্মীয় র্যালিগুলো ঠিক এই সময়েই কেন করা হচ্ছে?
র্যালিগুলি বেশ সুসংগঠিত ভাবে আয়োজন করা হচ্ছে। এসব মিছিল হঠাৎ করে যেমন হচ্ছে না, তেমনই কোনও ছোটখাট সংগঠনের পক্ষে এত সুসংগঠিত মিছিল করা সম্ভবও না।
নামকরা লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুহাস পালশিকরের কথায়, “মনে হচ্ছে এগুলোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গুজরাত বা কর্ণাটকের মতো হিন্দু একতা কায়েম করা এবং ওই রাজ্যগুলির মতোই ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটানো।“
যেভাবে শুরু এসব র্যালির
‘সকল হিন্দু সমাজ’ মুম্বাই সহ নভি মুম্বাই, পুনে, কোলাপুর, নাসিক, কড়াড, সোলাপুর, লাতুর, নাগপুর, আহমেদনগর, ধুলে, জলগাও, আহমেদনগর সহ অন্যান্য ছোট ছোট শহরেও বিশাল ‘হিন্দু জন আক্রোশ মোর্চা’র আয়োজন করেছে। প্রথম র্যালিটি হয়েছিল মারাঠওয়াড়া অঞ্চলের পরভণিতে, গত বছরের ২০ নভেম্বর।
দিল্লিতে শ্রদ্ধা ওয়ালকার হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত এক মুসলমান যুবকের নাম সামনে আসার পরেই ওই র্যালি হয়। শ্রদ্ধা ওয়ালকার মুম্বাইয়ের কাছে ভাসাইতে থাকতেন আর আফতাবের সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মি. আফতাবকে দিল্লি পুলিশ গত বছর নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করে।
তারপরেই ‘সকল হিন্দু সমাজ’এর ব্যানারের নীচে একত্রিত হয়ে প্রথম র্যালিটি বেরয়। ওই র্যালির ঘোষিত ইস্যু ছিল ‘লাভ জিহাদ’। সেই মিছিলে বিপুল সাড়া পড়েছে এটা দেখে উৎসাহিত হয়ে পরের র্যালিটি করা হয় পুনেতে।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা শ্রীরাজ নায়ার বিবিসি মারাঠিকে ফেব্রুয়ারি মাসে বলেছিলেন, “মহারাষ্ট্রে লাভ জিহাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তৃণমূল স্তরে কাজ করতে গিয়ে আমাদের কাছে অনেক বাবা-মা এ নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন।“
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শাখা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদও ‘সকল হিন্দু সমাজ’এর মধ্যে রয়েছে। নভেম্বরের আগে ‘সকল হিন্দু সমাজ’এর নাম শোনাই যায় নি। তবে যেভাবে র্যালিগুলির আয়োজন করা হচ্ছে, মিছিলে যারা অংশ নিচ্ছেন, মিছিলের রুট যেভাবে তৈরি করা হচ্ছে বা যেসব ভাষণ দেওয়া হচ্ছে, প্রত্যেকটা বিষয়ই ভেবে চিন্তে করা হচ্ছে।
স্থানীয় বক্তারা ছাড়াও মহারাষ্ট্রের বাইরে থেকেও বক্তা আনা হচ্ছে। তেলেঙ্গানা থেকে উস্কানিমূলক ভাষণ দেওয়ার জন্য কুখ্যাত, বহিষ্কৃত বিজেপি নেতা টি রাজা সিং, গুজরাতের সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার কাজল হিন্দুস্তানি, সুদর্শন নিউজ চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ চাহানকে এবং বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা কালীচরণ মহারাজের মতো ব্যক্তিদের ডাকা হচ্ছে এসব র্যালিতে।
তবে এর আয়োজক ‘সকল হিন্দু সমাজ’এর অন্তর্ভুক্ত হিন্দু জনজাগরণ সমিতির নেতা সুনীল ঘনওয়াত বিবিসিকে বলছেন, “কোনও কিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে না। মানুষ নিজে থেকেই যোগ দিচ্ছেন।“
উস্কানিমূলক ভাষণ
‘হিন্দু জন-আক্রোশ মোর্চা’গুলি থেকে যেসব দাবী তোলা হচ্ছে, বা যে ধরণের ভাষণ দেওয়া হচ্ছে, সেসবের কড়া সমালোচনা হচ্ছে নানা মহল থেকে। সেকারণে এইসব র্যালির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
যদিও ‘সকল হিন্দু সমাজ’এর কোনও আলাদা ফেসবুক পেইজ বা ইউটিউব চ্যানেল নেই, কিন্তু যেসব সংগঠন রয়েছে ওই ব্যানারের নীচে, তাদের সামাজিক মাধ্যমের পেইজগুলোতে র্যালিতে দেওয়া কিছু কিছু ভাষণ আপলোড করা হয়েছে।
যেমন ২২ ডিসেম্বর ধুলে শহরের র্যালিতে সুদর্শন নিউজের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ চাহানকে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “পুলিশ যদি রেকর্ডিং করতে চায়, তাহলে ক্যামেরা সুরেশ চাহানকের দিকে তাক না করে ওইসব মসজিদে লাগানো উচিত যেখানে জিহাদিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেখানে লাভ জিহাদের জন্য অর্থ বিলি করা হয়।”
উগ্র হিন্দুত্ববাদী চ্যানেল সুদর্শন টিভির প্রধান মি. চাহানকে আরও বলেন, “ওখান থেকেই লাভ জিহাদিদের মোটরসাইকেল দেওয়া হয়, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কীভাবে হিন্দু নারীদের ফাঁসাতে হবে। ক্যামেরা তো মাদ্রাসায় লাগানো উচিত যেখানে শেখানো হয় যে মুসলমান ছাড়া বাকি সবাই কাফির।“
আবার ২২ জানুয়ারি মুম্বাইতে আয়োজিত এক র্যালিতে ভাষণ দেন বিতর্কিত নেতা টি রাজা সিং। তিনি লাতুর আর সোলাপুরের র্যালিতেও ভাষণ দিয়েছেন।
তিনি সেখানে বলেন, “মহারাষ্ট্র হিন্দুদের পবিত্র ভূমি। এটা লজ্জার বিষয় যে এই মাটিতেই লাভ জিহাদ বন্ধ করার আইন আনার জন্য হিন্দুদের লড়াই করতে হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের প্রতিটি কোণায় কোণায় অর্থের লোভ দেখিয়ে আমাদের দলিত এবং আদিবাসী বন্ধুদের ধর্ম পরিবর্তন করানো হচ্ছে। আমাদের দেবদেবীদের প্রকাশ্যে অপমান করা হচ্ছে।”
‘ভূমি জিহাদ’
হিন্দুত্ববাদী নেতা নেত্রীরা দীর্ঘদিন ধরেই ‘লাভ জিহাদ’এর কথা বলে আসছেন। কিন্তু হিন্দু জন-আক্রোশ র্যালিগুলোয় ‘ভূমি জিহাদ’ নামে একটা নতুন শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে বক্তারা অভিযোগ তুলছেন যে বড় আর ছোট শহরগুলিতে খালি পড়ে থাকা জমি দখল করে মসজিদ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে।
তবে দেশের বিভিন্ন অংশে এইধরনের অভিযোগ হিন্দুত্ববাদী নেতারা আগেও বিচ্ছিন্নভাবে তুলেছেন, কিন্তু হিন্দু জন-আক্রোশ র্যালিগুলিতে নিয়মিতই এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা শ্রীরাজ নায়ারের কথায়, “এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ সরকারী জমি অবৈধভাবে দখল করে ধর্মীয় ইমারত বানাচ্ছে। আমরা এধরণের জবরদখলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চাই। মহারাষ্ট্রে ভূমি জিহাদ একটা নতুন কারবার, নিরাপত্তার জন্যও এটা বিপজ্জনক।”
এসডব্লিউএসএস/১২২৫
আপনার মতামত জানানঃ