মামুন আব্দুল্লাহ : আফ্রিকায় ত্রাস সৃষ্টিকারী বোকো হারাম আফ্রিকার ইসলামিক স্টেট নামেও বেশ পরিচিত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর একটি। নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী বহুবার এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠীটিকে পুরোপুরি নির্মূলের দাবী করেছিল। কিন্তু বারবার শূন্য থেকে আবার ফিরে আসে বোকো হারাম। ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান সিনেমার বিখ্যাত উক্তি, ”Criminals are like weeds, Alfred. Pull one up another grows in its pleace”- বোকো হারামের ক্ষেত্রে গিয়ে একশত ভাগ ফলে গেছে। বছর খানেক আগে ঠিক এভাবেই নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী বোকো হারামের সদস্যদের পুরোপুরি নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছিল কিন্তু সাম্প্রতিক সেই বোক হারাম আবার দাবী করেছে তারা ২০০ স্কুল শিক্ষার্থীকে অপহরণ করেছে।
বোকো হারাম আবার মিডিয়া স্পটলাইটে এসেছে এর মানে হ’ল বোকো হারাম কখনোই পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। এমনটা ঘটলো তৃতীয়বারের মতন, অর্থাৎ নাইজেরিয়ান সেনাবাহিনী তৃতীয়বারের মতো বোকো হারামকে পরাজিত হওয়ার দাবী করার পর আবার ফিরে এসেছে। এখন প্রশ্ন হ’ল এটা বারবার কেন ঘটছে। বোকো হারামের সক্রিয়তা শুরু হয় উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় এবং তারা সেখানে এখন পর্যন্ত বেশ সক্রিয়। বোকো হারামের আরবি নাম ‘জামাত আল আস সুন্মাহ লিদ দাওয়া ওয়াল জিহাদ’ অর্থাৎ Group of people of Sunnah for preaching and Jihad. ২০১৫-তে বোকো হারাম নিজেদের বিশ্বস্ততা আইসিস এর নিকট সপে দেয় এবং পশ্চিম আফ্রিকার ইসলামিক স্টেট বা পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের প্রোভিন্স ঘোষণা করা হয়। তখন আইসিসের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদী ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা সমগ্র বিশ্বে ইসলামী খিলাফত কায়েম করবেন, এছাড়া তিনি নিজেকে খলিফাও দাবী করে বসেন। তখনই বোকো হারাম পশ্চিম আফ্রিকায় ইসলামিক স্টেটের ফ্রাঞ্চাইজ নিয়ে নেয়। তখন থেকে তারা উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ার বোর্নো, আদামাওয়া, ইয়োব, কানো, কাদুনা, গোম্বে, বাউচি অঞ্চলে সক্রিয় অবস্থানের জানান দিতে থাকে। প্রায় অর্ধেক নাইজেরিয়ায় রয়েছে তাদের সক্রিয় অবস্থান। ফলে এটি শুধু নাইজেরিয়ার সমস্যা না, আঞ্চলিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কথিত আছে, বোর্নোর মাইদুগুরি বোকো হারামের রাজধানী। শেষ বার দেখা গিয়েছিল বাউচিতে। এবং অতি সাম্প্রতিক ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়ার সীমান্তে তাদের অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে। নাইজেরিয়া ছাড়াও নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন রাষ্ট্রে বোকো হারামের গেরিলা আক্রমণের খবর পাওয়া যায়।
বোকো হারামের শুরুটা হয়েছিল অনাড়ম্বর ভাবে। মুহাম্মদ ইউসুফ ২০০২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে তাদের কার্যক্রম ছিল পুরোপুরি ননভায়োলেন্ট। মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা শিক্ষাকে না বলা এবং নাইজেরিয়াকে সহীহ ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা। মুহাম্মদ ইউসুফের মূল উদ্দেশ্যই এটা ছিল যে তিনি নর্দান নাইজেরিয়ায় ইসলামকে পিউরিফাই করবেন পশ্চিমা শিক্ষা থেকে। সহীহ ইসলামী চর্চার উদ্দেশ্যে তিনি উক্ত অঞ্চলে শরীয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই কার্যক্রমটি তখনও পুরোপুরি অহিংসক ছিল। ২০০৯ সালে গিয়ে বোকো হারাম একটি বিশাল ধর্মীয় দলে পরিণত হয় এবং চারিদিক থেকে তারা রিক্রুটিং সেন্টার হিসেবে কাজ করছিল। সেই বছরই মুহাম্মদ ইউসুফ উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ার মাইদুগুরিতে বিদ্রোহ করে বসেন। নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী পূর্ণশক্তি নিয়ে মুহাম্মদ ইউসুফের বিদ্রোহ দমন করে। সেনাবাহিনী প্রথমে ইউসুফের গ্রুপের হেডকোয়ার্টার দখল করে নেয়, একই সাথে বহু সমর্থক, অস্ত্রধারী মিলিট্যান্ট ও ইউসুফকে হত্যা করা হয়। তখন নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী দাবী করে বোকো হারাম বিলুপ্ত হয়েছে।
কিন্তু তারা ভুল ছিল। মুহাম্মদ ইউসুফের মৃত্যুর পর ২০০৯ সালে বোকো হারাম পায় নতুন নেতৃত্ব। তিনি হয়ে ওঠেন আরও ভয়ংকর। ২০১০ সালে নতুন নেতা আবুবকর শেখাউয়ের নেতৃত্বে বোকো হারামের ১০৫ জন সদস্য ও জেলখানায় গঠিত নতুন ৬০০ সদস্য সহ বাউচি জেল থেকে পালিয়ে যায়। এদের সকলের রিগ্রুপের ফলে বোকো হারাম আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পূর্ব নাইজেরিয়াতে অবিরমা হামলা জারি ছিল।
২০১৪ সালে বোকো হারাম ২০০ এর বেশি কিশোরী তরুণী নারীদের অপহরণ করে। সঠিক সংখ্যাটা আসলে ছিল ২৭৬ জন মেয়ে। তাদের কিছু সংখ্যককে উদ্ধার করা হয়েছিল কিন্তু আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোর তথ্য মতে, পাঁচ বছর পর এখনও ১১২ জনের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। যাদের উদ্ধার করা হয়েছিল তাদের ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা বিভৎস, বর্ণনার অতীত। এটি চিবোক অপহরণ নামে বেশি পরিচিত। এই ঘটনার পর বোকো হারামের জিহাদীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন চলতে থাকে। আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচুর সমালোচনার শিকার হতে থাকে বোকো হারাম। ২০১৫ সালে বোকো হারাম নিজেদের বিশ্বাস্ততা আইসিসের প্রতি সপে দেওয়ার সময়ে নাইজেরিয়ায় নির্বাচন চলছিল। সেসময় নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী সাবেক স্বৈরশাসক মুহাম্মাদু বুহারি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন, উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় আইনের শাসন ফিরিয়ে আনবেন। বলাবাহুল্য তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। জয়ের পর তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কিছুটা অবশ্যই পূরণ করেছেন। প্রথম বছরেই চাদ, ক্যামেরুন ও নাইজারকে নিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কোয়ালিশন গঠন করেন। এক বছরের ভেতরে তাদের ক্যাম্পেইন বেশ কার্যকরী প্রমাণিত হয়। বহু গ্রাম ও নগর তারা বোকো হারামের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে। নাইজেরিয়ান সেনাবাহিনী আবার ঘোষণা দেয় তারা বোকো হারামকে পরাজিত করেছে।
এটা বলতেই হবে যে, নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী পুশব্যাক করেছিল। ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বহু বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, কিন্তু বোকো হারামের অবশিষ্ট সদস্যরা আশেপাশের অঞ্চলে বা সামবিসা জঙ্গলে, নাইজেরিয়া-ক্যামেরুন সীমান্তের মান্দারা পর্বতমালায় পালিয়ে যায়। সেখানেই তারাই আবার এটিকে সুগঠিত করে। সেখান থেকে তারা গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত করে। অর্থাৎ সরাসরি কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না, বরঞ্চ অতর্কিত হামলা করে পালিয়ে যায়। ২০১৬ সালের পর যখন থেকে তাদের বিদ্রোহ দমন হয়েছিল তখন থেকে সাধারণ নাগরিকের উপরে গেরিলা ওয়্যারফেয়ার চর্চা বেড়ে যায়। ফরেন রিলেশনেএ ইউ. এস. কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ সালে বোকো হারাম আগের দশকের তুলনায় নাইজেরিয়ান সেনাবাহিনীর জন্য আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। তারা ২০০ এর বেশি সিভিলিয়ান ও সিকিউরিটি ফোর্সকে হত্যা করেছে।
এমন যখন পরিস্থিতি তখন নতুন করে শোনা যায়, শিশু ও পূর্ণবয়স্ক নাগরিককে বোকো হারাম অপহরণ করেছে, গ্রামের ৪০ জন কৃষককে জবাই করেছে। আল-জাজিরার তথ্য মোতাবেক অভিভাবক ও স্কুল কতৃপক্ষের দাবী স্কুলের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অর্থাৎ প্রায় ৮০০ জন শিক্ষার্থীকে কাটসিনা অপহরণ করেছে। অফিশিয়াল সংখ্যা এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। বোকো হারামের দাবী তারা এই অপহরণ করেছে। কিন্তু এখানে আকর্ষণীয় বিষয় হ’ল অপহরণের ঘটনা ঘটেছে নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাইরে। উল্লেখ্য উক্ত অঞ্চলে বোকো হারামের সদস্যদের কখনো কাটসিনায় সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এই অপহরণের ঘটনা আদৌ বোকো হারাম করেছে কিনা, কেনন নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে ২০০ এর বেশি স্কুল ছাত্রকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু কাজটি যে বোকো হারাম করেছে এটা স্বীকার করে নেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে মুহাম্মাদু বুহারির ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছর হয়ে গেছে, তবুও বোকো হারাম যথেষ্ট শক্তিশালী উপরন্তু তারা অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে, বুহারির নিজের পৈত্রিক এলাকায়। উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়া থেকে এগিয়ে এসে বোকো হারাম এখন সেন্ট্রাল এরিয়ায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বোকো হারামের উপরে বেশ কিছু রিসার্চ পেপার অনলাইনেই পাওয়া যায়। সেখানে দেখানো হয়েছে বোকো হারামের প্রশ্নে সরকার বিশেষ করে স্বৈরাচারী সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। সন্ত্রাসবাদকে পুরোপুরি শেষ না করে বেশ কয়েকবার বিজয়ের দাবী করেছে নাইজেরিয়ান সেনাবাহিনী। ২০০৯, ২০১৫, ২০১৯ ও ২০২০ আবার নতুন করে বোকো হারামের উত্থান ঘটেছে। বোকো হারামের পুনরুত্থান প্রমাণ করে গ্লোবাল টেরোরিজম দমনে আন্তর্জাতিক অবদানের প্রয়োজন রয়েছে। বুহারি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতি হয়তো কিছু ক্ষেত্রে পূরণ হয়েছে কিন্তু পুরোপুরি পূরণ হয়েছে এটা বলা যাবে না, কিন্তু আরও বেশি ক্যাম্পেইনের প্রয়োজন।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ