জাকির হোসেন
মনে করা হয় যে মানুষের কুসংস্কার বা অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসগুলি সভ্যতার প্রথম দিক্কার এবং তারা প্রথম প্রাগৌতিহাসিক ধর্ম সৃষ্টি করেছিলো। আত্মা, পরমাত্মা, ভূত, প্রেত, অতিপ্রাকৃতশক্তি- সৃষ্টা সবই তাদের কুসংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। কুসংস্কারের সাথে ধর্মীয় সম্পৃক্ততার আরেকটি দিক হল যে, কিছু লোক বিশ্বাস করে অসুস্থতা, পাপ বা অন্যায় কাজের শাস্তির ফল হতে পারে। যারা ধর্মীয় রীতিনীতি লঙ্ঘন করে তারা অপরাধবোধ বা লজ্জার অনুভূতি অনুভব করতে পারে অথবা তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে শাস্তির ভয় পেতে পারে। নৃবিজ্ঞানী Elison & Levin এ বিষয়গুলিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের কুসংস্কার বলে অবিহিত করেন।
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসের মধ্যে একমাত্র আসল পার্থক্য হল বস্তুনিষ্ঠতার অভাব। ধর্ম হল আপনি যা বিশ্বাস করেন তা ধর্ম এবং অন্য লোক যা বিশ্বাস করে তাই কুসংস্কার। একটি সংস্কৃতিতে গৃহীত ধর্ম থেকে ভিন্ন ধর্মীয় অনুশীলনকেও কখনও কখনও কুসংস্কার বলা হয়। একইভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আনা নতুন অনুশীলনগুলিকে বাদ দেওয়ার প্রয়াসেও সেগুলোকে কুসংস্কার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সব সংস্কৃতিতে এবং লোক-কথায় অনেক কুসংস্কার খুঁজে পাওয়া যায়। এতে কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস একত্রিত থাকে এবং এগুলোকে আলাদা করা যায়না। এসব কুসংস্কারকে প্রায়ই মিথ্যা ধর্ম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
কুসংস্কার নিয়ে গবেষণা
মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে সহ-ঘটনা, অ-সম্পর্কিত ঘটনার মধ্যে একটি সংযোগ বিদ্যমান। ঘটনার সাদৃশ্য- একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার মিল। বিজ্ঞানী গ্রেফ এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, কুসংস্কারের মূল হল “মেলামেশা”। মানুষ আমাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, ক্রিয়া, বিভিন্ন বস্তু বা প্রতীকের মধ্যে লিঙ্ক তৈরি করে (তারা অর্থবোধ করে বা না করে)। এই লিংক বা মিলটিই হলো- কুসংস্কার। আর এর কার্যকারণ যদি একটি অতিপ্রাকৃত সত্তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে হয় তখন সেটি ধর্মীয় ঘটনা হিসেবে বর্ণীত হয়। কুসংস্কার কোন মানবিক কারণ বা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি। এটি একটি বিশ্বাস। এই বিশ্বাস কুসংস্কারটির ভবিষ্যতের ঘটনাগুলি কোনও যাদুকরী বা রহস্যময় সম্মোহনকারী কোন ব্যক্তির আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর একজন ব্যক্তির সাথে একটি খারাপ অভিজ্ঞতা সেই গোষ্ঠীর সমস্ত লোককে একইভাবে খারাপ ভাবতে পারে- এটিও একটি কুসংস্কার। অন্ধবিশ্বাস হল অতিপ্রাকৃত কার্যকারণে একটি অত্যধিক বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বাস। এই বিশ্বাস জ্যোতিষশাস্ত্র, লক্ষণ, জাদুবিদ্যা এবং অ্যাপোট্রোপিক জাদুবিদ্যার মতো কোনও শারীরিক প্রক্রিয়া ছাড়াই একটি ঘটনা অন্যটির কারণ। কুসংস্কারের দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। যেমন- সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি বা ধর্মের কুসংস্কারের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে বেড়ে ওঠেন তবে আপনি এই বিশ্বাসগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, এমনকি অবচেতনভাবেও।
কুসংস্কার হল ভাগ্য বা অন্যান্য অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর উপর যেকোন বিশ্বাস বা অনুশীলন। প্রায়শই এটি অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়। এর কাজ বিজ্ঞান বা কার্যকারণ সম্পর্কে একটি ভুল বোঝাবুঝি তৈরী করা। এটি ভাগ্য বা জাদুতে বিশ্বাস বা অন্য যেকোন অজানা বিষয় সম্পর্কে ভয় তৈরী করে।
ধর্ম এবং কুসংস্কার একই
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, কুসংস্কারের মূল উৎস হলো ভয় এবং ধর্মের উৎসও ভয়। ভয় হল ধর্ম ও কুসংস্কারের প্রধান উৎস এবং নিষ্ঠুরতারও অন্যতম উৎস। ভয়কে জয় করাই হল প্রজ্ঞার সূচনা। এডমন্ড বার্কের উদ্ধৃতি: “কুসংস্কার হল দুর্বল মনের ধর্ম।”
ল্যাটিন শব্দ থেকে কুসংস্কার শব্দটি এসেছে, তা হল দেবতাদের প্রতি অতিরিক্ত ভয়। কুসংস্কার বলতে সাধারণত অজ্ঞতা, অজানা ভয়, জাদু বা সুযোগের উপর আস্থা বা কার্যকারণের মিথ্যা ধারণার ফলে একটি বিশ্বাস বা অনুশীলনকে বোঝায়।
বিজ্ঞানী এ.জি. গার্ডিনার তার কুসংস্কার বিষয়ক প্রবন্ধে ভয়, নিয়ন্ত্রণ, যুক্তি, ঐতিহ্য, নিরাপত্তাহীনতা এবং পলায়ন এসব বিষয়কে কুসংস্কারের থিম হিসেবে ধরে ছিলেন।। একটি কুসংস্কার হল এমন কোনো বিশ্বাস বা অনুশীলন যা বিজ্ঞানীরা অযৌক্তিক, অতিপ্রাকৃত, ভাগ্য বা জাদু, অনুভূত অতিপ্রাকৃতিক প্রভাব বা অজানা ভয়ের জন্য দায়ী বলে মনে করেন।
নবীরা কুসংস্কারের ধারক বাহক
ব্রিটানিকা অভিধান মতে, নবীর সমার্থক শব্দ হলো ভাববাদী, দ্রষ্টা, ওরাকল, ইভোকেটর, জাদুকর, ভবিষ্যদ্বাণীকারী, পূর্বাভাসক, মিডিয়াম, ইশাইয়া, স্বপ্নদর্শী এবং সিবিল। ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ভাববাদীদের (নবীদের) মধ্যে রয়েছে দ্রষ্টা, ওরাকল প্রদানকারী, সুথসেয়ার্স- যারা সকলেই ভবিষ্যৎবাণী করেন বা যন্ত্র, স্বপ্ন, টেলিপ্যাথি, ক্লিয়ারভয়েন্স বা পরমানন্দের উন্মত্ত অবস্থায় প্রাপ্ত দর্শনের মাধ্যমে, বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে ঐশ্বরিক ইচ্ছার কথা বলেন।
প্রাচীন ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষরা হল জ্যোতিষশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীনতম রেকর্ডকৃত সংগঠিত পদ্ধতি- যা খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দে উদ্ভূত হয়েছিল। জ্যোতিষশাস্ত্র এবং ধর্ম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কুসংস্কারের জ্যোতিষরাও ভবিষ্যদ্বাণী করেন আবার ধর্মের নবীরাও ভবিষ্যদ্বাণী করেন।– দুটো মূলত একই। প্রস্তর ও ব্রোঞ্জ যুগে জ্যোতিষশাস্ত্রে বর্ণিত আকাশের বস্তুগুলি উপাসনার বিষয় ছিল। যেমন- সূর্যদেবতা, চন্দ্রদেবতা, তারাদের দেবতা ইত্যাদি। তাদের নবী ছিলো তখনকার ভবিষ্যদ্বাণীকারী- জ্যোতিষরা। অর্থাৎ, নবীর সমার্থক শব্দগুলি এমন একজন ব্যক্তির কথা বলে যিনি কুসংস্কারের ধারক বাহক।
ধর্ম ও কু-সংস্কার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক তৈরী করে
নৃবিজ্ঞানী স্যার এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর বলেন, কুসংস্কারের সাথে মানুষ এবং আধ্যাত্মিক শক্তির মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক জড়িত। সেটি ধর্মে সর্বোচ্চ আকারে। সেই সম্পর্কটি একটি ব্যক্তিগত, সচেতন সর্বশক্তিমান আধ্যাত্মিক সত্তার সাথে সম্পর্ক তৈরী করে। ব্রনিস্লো ম্যালিনোস্কি ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপবাসীদের উপর তার রচনায় উল্লেখ করেন, জাদু আধ্যাত্মিক শক্তিকে চালিত করতে চায়, যখন ধর্মীয় প্রার্থনা আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য অনুরোধ করে। জাদু এখানে কুসংস্কার।
কুসংস্কারের সাথে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ মিল হলো- কুসংস্কারের ওঝা অতিপ্রাকৃতশক্তির সাথে যোগাযোগ করে; যেভাবে ধর্মের নবী/অবতার অতিপ্রাকৃত সত্তা ঈশ্বর/আল্লাহ্/গড/ভাগবানের সাথে যোগাযোগ করে। “আত্মা” কুসংস্কারের সবচেয়ে পুরনো ধারণা – যার মাধ্যমে একজন ওঝা বা নবী অতিপ্রাকৃতশক্তির সাথে সংযোগ তৈরী করে। এটি ধর্ম ও কুসংস্কারের অভিন্ন মিল। আরেকটি বিষয়, ওঝা/মোল্লা/পুরোহিত মানষিক রোগকে অশুভ আত্মাদের (জিন-ভূত) তাড়ানোর জন্য একটি রহস্যময় ইন্দ্রজাল তৈরি করে কিংবা মিথ্যা জাদুর মাধ্যমে জ্বীনের সাথে মিলিত হয় – এটি ধর্মকে কুসংস্কারের একটি নগ্ন রূপ হিসেবে দৃশ্যমান করে।
ধর্ম এবং কুসংস্কার বহু শতাব্দী ধরে একত্রে আবদ্ধ রয়েছে। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন। কুসংস্কার যদি পশমের মতো হয় ধর্ম হলো তার কম্বল। এই পশম বাছতে থাকলে ধর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কুসংস্কার সংগঠিত হয়ে ধর্মের উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং তার প্রভাব এত বেশি যে সে একাই মানুষের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করতে পারে। কুসংস্কারগুলি জাদুবিদ্যা (কিছু ওঝা, কবিরাজ, জ্যোতিষ, ধর্মীয় পুরোহিত কিংবা নবীর অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন), বলিদান (কোরবানী), ভূত শিকার, জ্বীন তাড়ানো, যাদুবিদ্যা-অতিপ্রাকৃতশক্তি নিজের উপর ভর করানো বা তাড়ানো ইত্যাদির সাথে জড়িত। এটি অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের সাথে স্বর্গ ও পৃথিবী বোঝার এবং জীবনদর্শন বোঝার একটি অবিরাম চেষ্টা। এটি মানুষের আচরণের সাংস্কৃতিক নিষেধাজ্ঞা ও আচার-অনুষ্ঠানগুলির পথ তৈরি করে।
ধর্মের সারমর্ম হল ঈশ্বরের সত্তা ও প্রকৃতির উপলব্ধি দ্বারা উৎপন্ন ভয়ের একটি রূপ। ধর্ম নিয়ে কিয়েরকেগার্ডের কেন্দ্রীয় লেখা ছিল ভয় এবং কাঁপানো। মৃত্যুর ভয়কে সাধারণত ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রেরণা হিসাবে অনুমান করা হয়। ধর্মের প্রতিষ্ঠাতারা একে “প্রভুর প্রতি ভয়ের মাধ্যমে ধর্ম জ্ঞানের শুরু” বলে অবিহিত করেন। এটি আবেগের একটি রূপকে আরও সঠিকভাবে বিস্ময় বা শ্রদ্ধা করতে বলে। এ বিষয়টি কুসংস্কারের সংজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
একইভাবে, আবার প্রতিটি ধর্মীয় ব্যবস্থার আনুষঙ্গিক বিশ্বাস হিসাবে কুসংস্কার গ্রহন করে। যেমন, একজন খ্রিস্টান বিশ্বাস করতে পারেন সমস্যার সময়ে তিনি বাইবেল দ্বারা পরিচালিত হবেন, যদি তিনি এটিকে এলোমেলোভাবে খুলেন এবং পাঠ্যটি পড়েন, যা প্রথমে তার চোখে আঘাত করে।
ধর্ম ও কুসংস্কারের উদ্ভব নিয়ে বিজ্ঞান
কুসংস্কার সৃষ্টির প্রাথমিক কারণ- মানসিক ট্রমা। সম্ভবতঃ আদিম মানুষ বিভিন্ন শিকারী প্রাণীর আক্রমন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বিভিন্ন দূর্ঘটনা এবং আন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রামে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন মানষিক ট্রমার শিকার হয়েছিলো। এতে বেদনাদায়ক ঘটনার প্রাণবন্ত এবং বারবার স্মৃতি তাদের “অতিপ্রাকৃতশক্তির” অনুভূতির দিকে নিয়ে যেতো। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই পোস্ট-ট্রমাটিক হ্যালুসিনেশনই মানুষের আদি অতিপ্রাকৃতশক্তির প্রতি বিশ্বাসের প্রাথমিক কারণ হতে পারে।
অতিপ্রাকৃতশক্তি কেন উদ্ভব হয় সেটা নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ লেনোর টের ৮৮ জন ব্যক্তির উপর একটি গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন যে, ভূতের অনেক রিপোর্ট সত্যিই ভয়ঙ্কর এবং প্রায়শই জীবন-হুমকির অভিজ্ঞতা থেকে আঁকা হ্যালুসিনেশন এবং বিভ্রমের ফলাফল। টের যাদের উপর গবেষণা করেছিলেন তাদের মধ্যে আগুনের, বিমান দুর্ঘটনার এবং অদ্ভুত গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিল। অন্যরা শৈশবকালীন গুরুতর অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় প্রায় মারা গিয়েছিল, যার মধ্যে একটি শিশুও ছিল যাকে একটি কুকুর হামলা করেছিলো। এরা তাদের দূর্ঘটনার কিছু দিন পর অতিপ্রাকৃতশক্তির যে অভিজ্ঞতা পেয়েছিলো তা ছিলো দেখা, শ্রবণ, গন্ধ বা “ভূতের উপস্থিতি” বা অন্য প্রাণীদের “অনুভব” করা। প্রাণীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া কিছু শিশুকে পশু ভূত দ্বারা “ভুতুড়ে” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যে প্রাণী অনেক আগেই মারা গেছে তারা সেটা দেখত। এ বিষয়গুণি পর্যবেক্ষণ করে টের বলেন, একটি বেদনাদায়ক ঘটনার প্রাণবন্ত এবং বারবার স্মৃতি “ভুতুড়ে” হওয়ার অনুভূতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ জন্য পোস্ট-ট্রমাটিক হ্যালুসিনেশন “ভূত” এর জন্য দায়ী হতে পারে”। এই লক্ষণগুলি সংক্রামক বলে মনে হয়। এর অর্থ হতে পারে যে একটি পরিবার, প্রতিবেশী বা একটি সমগ্র সম্প্রদায় একজন ব্যক্তির দ্বারা উৎপন্ন একটি অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস দ্বারা প্রকাশিত বার্ষিক জার্নাল দ্য সাইকোঅ্যানালাইটিক স্টাডি অফ দ্য চাইল্ড-এ টের রিপোর্ট করেছেন, “মানসিক ট্রমা অলৌকিক অভিজ্ঞতার কারণ হয়।” এ ধরণের ট্রমাই সম্ভবত ভূত বা অতিপ্রাকৃত কিছুর আবির্ভাবে জন্য দায়ী।
টের আরো বলেন, ট্রমার পরে কিছু লোক বিশ্বাস করে যে তাদের মানসিক সতর্কতা রয়েছে। এই ধরনের লোকেরা তাদের আঘাতমূলক অভিজ্ঞতার আগের ঘটনাগুলির দিকে ফিরে তাকায় এবং একটি অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি যা ছিল তার উপর “নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা” করার চেষ্টা করার উপায় খুজে। তারা এমন লক্ষণ এবং সতর্কতাগুলি অনুসন্ধান করে যা তারা বিশ্বাস করে যে ভয়ঙ্কর ঘটনার পূর্বাভাস দেওয়া উচিত ছিল। তারা বলে, আমরা এটির প্রতিক্রিয়া জানাই কারণ প্রতিটি মানুষ নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায়। কেউ অসহায় হতে চায় না। আমরা এই ধারণায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। টের বিশ্বাস করেন যে, যখন একজন ব্যক্তি অপ্রত্যাশিতভাবে একটি ভয়ঙ্কর বাহ্যিক ঘটনার দ্বারা অভিভূত হয় তখন ব্যক্তির বাইরের সবকিছুই ভয়ঙ্কর দেখাতে শুরু করতে পারে। এগুলি মোটেই ভূত নয়- বরং হ্যালুসিনেশন । পরবর্তীতে ভুত, আত্মা, প্রেতাত্মা- অতিপ্রাকৃত অনুভুতিগুলিই কুসংস্কার ও ধর্মের ভিত্তি তৈরী করে।
হ্যালুসিনেশন থেকে- নবী/অবতার
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান মতে, সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্তরা নিজেকে নবী-অবতার বলে দাবি করে। তারা মূলত মানসিক বিভ্রম এবং হ্যালুসিনেশনের শিকার। সিজোফ্রেনিয়া বিভিন্ন পরিবেশগত কারণে হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চাপ, তাপ, তৃষ্ণা, তীব্র মানসিক পরিস্থিতি, বিরক্তিকর ও অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এ বিষয়গুলি মরুভুমির ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
ধার্মিকদের মধ্যে যারা দুর্বল তারা সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত হতে পারে। তাদের কছে ধর্মীয় চিত্রাবলী খুব মহৎ এবং এটি একজন ব্যক্তির মধ্যে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। বাস্তবসম্মত চিন্তাভাবনার পরিবর্তনের কারণে এটি সম্ভাব্যভাবে একটি মানসিক পর্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একজন ভুক্তভোগী বিশ্বাস করতে পারেন যে তারা নিজেরাই একজন দেবতা বা মশীহ, অথবা একজন ঈশ্বর তাদের সাথে কথা বলছেন, তাদের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন।
এই সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ সহিংস আচরণ হতে পারে, হয় অন্যদের প্রতি বা নিজেদের প্রতি। কিছু ক্ষেত্রে, যদি তারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর তাদের অসুস্থতাকে শাস্তি হিসাবে ব্যবহার করছেন তবে তারা আরও কষ্ট-প্ররোচিত লক্ষণগুলিও অনুভব করতে পারে। এ জন্য রোগী ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, কেউ বিশ্বাস করতে পারে যে তাদের বিভ্রম এবং হ্যালুসিনেশন আসলে অতিপ্রাকৃতশক্তির সাথে যোগাযোগ বা ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা বা জাদু।
নবী/অবতার যখন শাসক
প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার কিছু শাসক জনগণকে পবিত্র রাজত্বের ধারণা দিতেন। তারা এরকম শাসককে নবী-অবতার, প্রকাশ, মধ্যস্থতাকারী, পবিত্র (অতিপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত রাজ্য) এর এজেন্ট হিসাবে দেখাতেন। তারা ছিলো মুর্তিপূজারী- পৌত্তলিক। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধর্মীয় পবিত্র রাজ্যের ধারণাটি প্রাগৈতিহাসিক সময়ে উদ্ভূত হয়েছিল। যখন বন্যা, খরা, ভুমিকম্প প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিতো তখন তাদের দেবদেবী এবং অবতাররা প্রশ্নের মুখোমুখিও হতো। এই ধারণা আধুনিক বিশ্বে ধর্মরাষ্ট্র বা খিলাফত কায়েমের মূল ভিত্তি। এক সময়ে, যখন ধর্ম সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তির এবং সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং যখন রাজ্যগুলি বিভিন্ন মাত্রায় ধর্মীয় শক্তি বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিল, তখন এমন কোন রাজ্য ছিলোনা যেখানে ধর্ম রাজ্যের বৈশিষ্ট্য কিছু ছিল না। তখন তারা অর্থ এবং ক্ষমতার জন্য ধর্ম এবং কুসংস্কার ব্যবহার করতো। তাদের প্রণীত কিছু আইন পরবর্তী ধর্মগ্রন্থে প্রতিস্থাপিত হয়েছিলো।
ধর্ম ও কুসংস্কার মস্তিস্ক হতে নিয়ন্ত্রিত হয়
মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশটি কুসংস্কারের জন্য দায়ী। মানুষের ক্লিনিকাল নিউরোসাইকোলজিতে মিডিয়াল টেম্পোরাল লোব প্যাথলজি কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসের উত্থানের সাথে জড়িত। বিশ্বাস, ধর্মীয় বা অধর্মীয়, ভেন্ট্রোমিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (vMPFC)-এ বৃহত্তর সংকেতের সাথে যুক্ত। এটি একটি মস্তিষ্কের অঞ্চল যা আত্ম-প্রতিনিধিত্ব, মানসিক সংসর্গ, পুরস্কার এবং লক্ষ্য-চালিত আচরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ঈশ্বর বিশ্বাস মস্তিস্কে
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মস্তিস্কের periaqueductal এর ধূসর অংশে ঈশ্বর বিশ্বাসের জন্য দায়ি। ২০১২ সালে একটি নিউরোথিওলজি-ভিত্তিক গবেষণায় উপসংহারে বলা হয়েছে যে “আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা সম্ভবত মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সাথে যুক্ত।” নতুন গবেষণা (2021) পরামর্শ দেয় যে, মস্তিষ্কের “গড স্পট” ব্রেনস্টেমের পেরিয়াক্যুডাক্টাল ধূসর অংশে বাঁধা নিউরাল সার্কিটে মূল হতে পারে।
কুসংস্কার এবং ওসিডি: একটি জটিল লিঙ্ক
ধর্ম সৃষ্টির আগে কুসংস্কারের জন্ম। কুসংস্কার হলো প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে একটি মিল। মনে করা হতো একটি ঘটনার জন্য অন্য আরেকটি দায়ি। এই বিষয়টি যখন মানুষ বারবার চর্চা করে তখন একটি কুসংস্কারের উদ্ভব হয়। বর্তমানে ধর্ম ও কুসংস্কার মানুষকে একই কাজ বার বার করায়। যা নিশ্চিত মানষিক রোগ OCD । ধর্ম কিংবা কুস্কারের এই আচার-অনুষ্ঠানগুলি বারবার করে তারা প্রায়ই এ কাজ থেকে সান্ত্বনা লাভ করে। এটি- নিজেকে মানসিকভাবে ট্র্যাকে রাখার একটি উপায়! এতে ব্যক্তি অব্যাহত মানষিক চাপ হতে মুক্ত হয়। কখনও কখনও এ ধরণের পুনরাবৃত্তি আচরণ আরও গুরুতর অবস্থার সংকেত দিতে পারে। যেমন অবসেসিভ-বাধ্যতামূলক ব্যাধি (OCD)।
ওসিডি এবং কুসংস্কার অনেকগুলি ওভারল্যাপিং বৈশিষ্ট্য ভাগ করে। যেমন, ক্ষতি এড়ানোর জন্য আচার পালন করা। অত্যধিক হাত ধোয়া, রীতিমতো স্নান বা সাজসজ্জা, আচরণ পরীক্ষা করা, মানসিক আচার-অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকলাপ পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন, পাঠ্য পুনঃপড়া, হোর্ডিং সহ এ ধরণের আবেগের প্রতিক্রিয়ায় সম্পাদিত বাধ্যতামূলক কাজগুলি কুসংস্কারের উৎস বলে অনুমিত হয়।
ধর্মের ভয়
আমরা মানুষ মৃত্যু এবং মৃতদের ভয় পাই। নবী/অবতাররা তাদের ধর্মে এটিকে পুঁজি করে। প্রায় সব ধর্মই “আমি যা বলেছি তাই কর নতুবা তুমি অনুশোচনা করবে” – এ ধরণের ভয়ের উপর নির্মিত। অনুশোচনার পরিমাণ সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে। তবে ধর্ম তার চূড়ান্ত লক্ষ্য বিশ্বাসীদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। ভয়ের চেয়ে এটি অর্জনের জন্য ভাল আর কোন হাতিয়ার নেই। মৃত্যুর হুমকি, সহিংসতার হুমকি এবং অসহিষ্ণুতার কারণ এই ভয়। বিশ্বের প্রতিটি ধর্ম তার অনুসারীদের তাদের ধর্মের নিয়ম অনুসরণ করতে “অনুপ্রাণিত” করার জন্য কোনো না কোনো আকারে “ভয়” ব্যবহার করে।
তাছাড়া, ধর্ম ও কুসংস্কারের বাইরে মানুষ মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থায় এবং সমগ্র সমাজে ভয়কে একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। অনেক রাজনীতিবিদও এটি ব্যবহার করেন। যেমন- জনসাধারণকে সেই সমস্ত দুষ্ট বিরোধী কিংবা বিদেশীদের ভয় দেখিয়ে তাদের বোঝান যে তারা এই ধরনের লোকদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবেন।
ধর্ম ও কুসংস্কার ভবিষ্যদ্বাণী করে
ধর্ম ও কুসংস্কার উভয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করে। ধর্মে একজন ব্যক্তির (নবীর) সাথে একটি অতিপ্রাকৃত সত্তার যোগাযোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত একটি ভবিষ্যদ্বাণী হল এমন একটি বার্তা যা অনেক সংস্কৃতি ও বিশ্বাস ব্যবস্থার একটি মূল বৈশিষ্ট্য। এই বার্তাগুলোতে ভবিষ্যত ঘটনাগুলির ঐশ্বরিক ইচ্ছা বা আইন বা পূর্বপ্রাকৃতিক জ্ঞান থাকে বলে বলা হয়। ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম, প্রাচীন গ্রীক ধর্ম, জরথুষ্ট্রিয়ানিজম, মানিচেইজম, হিন্দুধর্মসহ অসসংখ্য ধর্মে এ ধরণের ভবিষ্যতবক্তা- নবীদের নবুওয়াতের দাবি বিদ্যমান রয়েছে।
ধর্ম এবং কুসংস্কার উভয়ই ভাগ্যবিশ্বাস করতে বলে
কুসংস্কার(SUPERSTITION) এর ব্রিটানিকা অভিধান মতে, কুসংস্কার হলো অজানা ভয়ের উপর ভিত্তি করে একটি বিশ্বাস বা আচরণের উপায়। যেটি যাদু বা ভাগ্যের উপর বিশ্বাস তৈরী করে। এটি একটি [গণনা] বিশ্বাস যে কিছু ঘটনা বা জিনিস ভাল বা খারাপ ভাগ্য নিয়ে আসবে।
“ভাগ্যে বিশ্বাস” কুসংস্কারের এই ধারণাটি সৌভাগ্যের প্রচার করে বা আপনাকে দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করে। কিছু লোকের ক্ষেত্রে কুসংস্কারপূর্ণ আচরণের সাথে সাথে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি পায়। এতে তার উদ্বেগ হ্রাস পায়। এটা ধর্ম বা কুসংস্কার এর শান্তি। যে কারণে চাপ এবং বিরক্তির সময় ধর্ম ও কুসংস্কার উভয়ই বৃদ্ধি পায় এবং উদ্বেগ কম হয় ফলে ধর্মীয় শান্তি পায়।
ইসলামে ভাগ্য বিশ্বাস
আল্লাহ সব কিছুর জ্ঞাত এবং সব কিছুর স্রষ্টা। তাঁর ইচ্ছা ও আদেশের বাইরে কিছুই বিদ্যমান নেই। ভাগ্যে বিশ্বাস সম্পর্কে কুরআন: “আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোন প্রকার বিপদ সংঘটিত হয় না। যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে পথ দেখান। আল্লাহ সর্ববিষয়ে অবগত।” (কোরআন, 64:11)
অর্থাৎ ভাগ্যে বিশ্বাসীরা এটা জেনে স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করে যে, তাদের যা কিছু ঘটছে তা তাদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত ছিলো।
ঐশী নিয়তি ইসলামে বিশ্বাস: আল-কদর হল মুসলিম বিশ্বাস যে আল্লাহ পৃথিবীতে এবং মানুষের জীবনে যা ঘটবে তার সবকিছুই নির্ধারণ করেছেন, যাকে পূর্বনির্ধারণও বলা হয়। অধিকাংশ মুসলমান বিশ্বাস করে যে মানুষ কিছু করতে পারে না যদি আল্লাহ ইতিমধ্যে তাদের জন্য সেই পথ বেছে না নেন।
ভয় ব্যবহার করে ঈশ্বরের সৃষ্টি
ঈশ্বরকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনশূন্য অংশে ব্রোঞ্জ যুগের উপজাতি ছাগল পালনকারীরা বালির একটি ছোট ছিদ্রে তৈরি করেছিলেন। উপজাতিরা ভয় করত বন্যা, চন্দ্র কিংবা সূর্য গ্রহন, সুনামি এবং প্লেগ। তাদের নেতারা মূলত এই ভয়কে তাদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছিল।- “এটা আবার করবেন না, নতুবা ঈশ্বর আমাদের আবার শাস্তি দেবেন” এইভাবে ইস্রায়েলীয়রা তাদের ঈশ্বরের জন্ম দিয়েছিল। ঈশ্বর সৃষ্টির পর ধর্ম তাদের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বাসীরা তা উপলব্ধিও করে না। তারা প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে আসতে বলে- তারা তা করে। তারা বলে কীভাবে প্রার্থনা করতে হবে, কখন প্রার্থনা করতে হবে, কার কাছে প্রার্থনা করতে হবে, কী গাইতে হবে, কীভাবে সই করতে হবে- অনুসারীরা তা করে। অনুসারীরা যে কোনো পরিষেবার মতোই প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে তাদের টাকা দিতে বাধ্য হয়। একবার এটি হয়ে গেলে, ধর্মের সদস্যরা ধর্মের নামে অন্যকে ঘৃণা করা ও হত্যা করার শক্তি অর্জন করে। আর এভাবেই প্রথম ঈশ্বরের সৃষ্টি…
ধর্মের আধ্যাত্মিকতা কুসংস্কারের উপর নির্ভরশীল
ধর্মের আধ্যাত্মিকতা কুসংস্কারের অতি-প্রাকৃত শক্তির সাথে যুক্ত। ধর্ম এখানে কুসংস্কারের উপর নির্ভরশীল। কুসংস্কারের অতি-প্রাকৃত শক্তি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে থাকা মানুষদের সবচেয়ে বড় বিশ্বাস। তবে ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, ধর্ম মানুষের অভিজ্ঞতার অংশ। কিন্তু কুসংস্কার প্রকৃতিকে কারসাজি করে বা তার গোপন অভিপ্রায় প্রকাশ করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের বিভ্রম প্রদান করে।
সাধারণভাবে ধার্মিক হওয়া আধ্যাত্মিকতাকে প্রতিফলিত করতে পারে। যা অতি-প্রাকৃতিক শক্তির উপর নির্ভরতার সাথে যুক্ত। বিভিন্ন ধর্মের দিকে তাকালে আমরা প্রবণতা লক্ষ্য করি যে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় থাকা কুসংস্কারে একটি শক্তিশালী বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
ধর্মের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য কুসংস্কারের সাথে সম্পর্কিত। ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলি হল পৌরাণিক কাহিনী এবং অন্যান্য গল্প, পবিত্র গ্রন্থ এবং অন্যান্য ধর্মীয় লেখা (যেমন আনুষ্ঠানিক বিশ্বাস), আচার-অনুষ্ঠান, প্রতীক, সামাজিক কাঠামো, নৈতিক নীতি এবং আচরণের মৌখিক বা লিখিত কোড এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিকতা। কুসংস্কারের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তিগত ভিত্তি থাকতে পারে। তবে ধর্মীয় নীতি এবং অনুশীলনগুলি বিশ্বাসহীন ব্যক্তির কাছে কুসংস্কারপূর্ণ বলে মনে হতে পারে।
ধর্মের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসগুলির মধ্যে রয়েছে নবীদের একটি উচ্চতর সত্তার (সৃষ্টিকর্তার) সাথে সম্পর্ক এবং জীবন, মৃত্যু এবং বাস্তবতার প্রকৃতির একটি অস্তিত্বগত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত। ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে অভ্যাস/আচার যেমন প্রার্থনা বা ধ্যান এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে ব্যস্ততা। এর বেশিষ্ট্যিগুলি কুসংস্কারের সাথে মানানসই।
কুরবানী/বলিদানে অতিপ্রাকৃতশক্তির সাথে যোগাযোগ
কুরবানী বা বলিদান কুসংস্কারের সবচেয়ে নগ্ন উদাহারণ। এর উদ্দেশ্য- ঈশ্বরকে উপহারের মাধ্যমে অতিপ্রকৃত শক্তির সাথে যোগাযোগ কিংবা অনিষ্ট শক্তিকে দূরে রাখা কিংবা কিছু অর্থনৈতিক যুক্তি।
উইলিয়াম রবার্টসন স্স্মিথ বলেন, একটি পশু বলিদান মূলত পবিত্র পশুর মাংস এবং রক্তের মাধ্যমে অতিপ্রাকৃতশক্তির সাথে একটি যোগাযোগ। যাকে তিনি “আনথ্রপিক পশু” বলে অভিহিত করেন। এটি একটি মধ্যস্থতাকারী । যেখানে পবিত্র এবং অপবিত্র রাজ্যগুলি যুক্ত হয়। বলিদানের কুসংস্কার রূপগুলি কিছু ধর্মীয় চরিত্র বজায় রাখে। যেমন, বিশ্বাসীরা বলিদানের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করে। এই যোগাযোগ ঘটে কারণ লোকেরা খাদ্য ও পানীয় ভাগ করে নেয় যেখানে ঈশ্বর অক্ষত। কমিউনিয়ন কোরবানি থেকে স্মিথ ত্যাগের কাফফারা বা প্রফিটিটরি ফর্মের উদ্ভব করেছিলেন। যাকে তিনি পিয়াকুলাম এবং উপহার বলি বলে অভিহিত করেছিলেন। স্মিথের মতো, তারা বিশ্বাস করেছিল যে একটি বলিদান পবিত্র এবং অপবিত্রের রাজ্যের মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিহত শিকারের মধ্যস্থতার মাধ্যমে ঘটে। যা দুটি রাজ্যের মধ্যে একটি বাফার হিসাবে কাজ করে এবং একটি পবিত্র খাবারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানী মাউসের আরেকটি গবেষণা, মানুষ দেবতাকে উপহার দেয় কিন্তু বিনিময়ে উপহার আশা করে। মাউসের মতে, দান করার ক্ষেত্রে এটি নিছক একটি বস্তু নয় যা প্রদান করা হয়, তবে এটি দাতার একটি অংশ যাতে একটি দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়। মালিকের মন বস্তুর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং যখন বস্তুটি দেওয়া হয় তখন নতুন মালিক এই মানায় ভাগ করে এবং দাতার ক্ষমতায় থাকে। এইভাবে উপহার একটি বন্ধন তৈরি করে। যাইহোক, এটি প্রদানকারী এবং প্রাপককে সংযোগ করার শক্তি প্রবাহিত করে। একটির বিনিময়ে অন্য একটি উপহারের আমন্ত্রণ জানায়।
কোরবাণী বা বলিদান যাদুবিদ্যা হতে উদ্ভূত
যেকোন অলৌকিক কাজই যাদু। স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার বলিদানকে যাদুবিদ্যার চর্চা থেকে উদ্ভূত হিসাবে দেখেছিলেন। যেখানে দেবতাকে পুনরুজ্জীবিত করার উপায় হিসাবে একটি দেবতাকে হত্যার অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। একটি গোত্রের রাজা বা প্রধানকে পবিত্র বলে মনে করা হত। কারণ তার কাছে মান বা পবিত্র ক্ষমতা ছিল। যা উপজাতির মঙ্গল নিশ্চিত করে। যখন তিনি বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়েন তখন তার মান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গোত্রটি পতনের ঝুঁকিতে পড়ে। এইভাবে রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং একজন শক্তিশালী উত্তরসূরি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। এইভাবে দেবতাকে ক্ষয় থেকে বাঁচাতে এবং তার পুনর্জীবনের সুবিধার্থে তাকে বধ করা হয়েছিল। পুরানো দেবতা তার সাথে বিভিন্ন দুর্বলতা দূর করতে হাজির হয়েছিলেন এবং একজন কাফ্ফারাকারী শিকার এবং বলির পাঁঠার ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ধর্মের একজন ডাচ ইতিহাসবিদ জেরার্ডাস ভ্যান ডার লিউ ত্যাগের প্রেক্ষাপটে উপহারের এই ধারণাটি গড়ে তুলেছিলেন। বলিদানে দেবতাকে একটি উপহার দেওয়া হয় এবং এইভাবে মানুষ নিজের ও দেবতার মধ্যে একটি সংযোগের প্রবাহ প্রকাশ করে। তার জন্য উপহার হিসাবে বলিদান “মানুষের সাথে চলতে থাকা দেবতাদের সাথে লেনদেনের বিষয় আর নয় এবং দেবতাকে আর শ্রদ্ধা করা যায় না যেমন রাজকুমারদের দেওয়া হয়- এটি উপহারের একটি আশীর্বাদ উৎসের উদ্বোধন।” এইভাবে তার ব্যাখ্যাটি উপহার এবং যোগাযোগের তত্ত্বগুলিকে মিশ্রিত করেছিল। তবে এটি একটি জাদুকরী স্বাদও জড়িত ছিল। কারণ, তিনি জোর দিয়েছিলেন যে বলিদানের কার্যের কেন্দ্রীয় শক্তি ঈশ্বর বা দাতা নয় বরং সর্বদা নিজেই উপহার।
১৯৬৩ সালে রেমন্ড ফার্থ উল্লেখ করেছেন যে কুরবানীর উৎসাহ, সময় এবং শিকারের ধরণ ও গুণমান অর্থনৈতিক বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়। সম্মিলিত বলিদানের পদ্ধতি শুধুমাত্র গোষ্ঠী ঐক্যের প্রতীক নয় বরং অর্থনৈতিক বোঝা হালকা করাও জড়িত। শিকারের ব্যবহার এবং ভোগের জন্য বলির খাবার সংরক্ষণ করা সম্ভবত সম্পদের সমস্যা মেটানোর উপায়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সামাজিক নৃবিজ্ঞানী E.E. Evans-Pritchard দক্ষিণ সুদানের জনগণ নুয়ের ধর্ম নিয়ে গবেষণা করার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, তাদের জন্য বলিদান হল একটি উপহার যা কিছু বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে। দুর্ভাগ্য, সাধারণত অসুস্থতা থেকে বাঁচতে। তারা ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য নয়, বরং তাকে দূরে রাখার জন্য। ইভান্স-প্রিচার্ড অবশ্য স্বীকার করেছেন যে নুয়েরের অনেক ধরনের ত্যাগ আছে এবং কোনো একক সূত্র পর্যাপ্তভাবে সব ধরনের ব্যাখ্যা করে না।
ইসলামে অতিপ্রাকৃত কুসংস্কার
বিভিন্ন ধর্মেরই একটি অলৌকিক সত্তা, বিশেষ করে একজন দেবতা, সৃষ্টিকর্তা, একজন যাদুকর, একজন অলৌকিক কর্মী, একজন সাধু বা ধর্মীয় নেতার ক্রিয়াকলাপের জন্য অলৌকিকতার দরকার হয়। যা মানুষকে সম্মোহিত করে, ভয় করে, সম্মান করে এর প্রতি আত্মসমর্পণ করে। যেমন বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ইসলাম, ইহুদি ধর্ম।
কুরআনে নবী মুহাম্মদের অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, কুরআন শৈশবে যীশুর জন্মের মতো অলৌকিক ঘটনার কথা বর্ণনা করে। ইসলামে কারামত মুসলিম সাধুদের দ্বারা সম্পাদিত অতিপ্রাকৃত বিস্ময়কে বোঝায়। ইসলামী শব্দভাণ্ডারে একক রূপ কারামাটির একটি ধারনা রয়েছে। যা দানশীলতার অনুরূপ। একটি অনুগ্রহ বা আধ্যাত্মিক উপহার যা ঈশ্বরের দ্বারা অবাধে প্রদত্ত। মুসলিম সাধকদের বিস্ময়কর জিনিসের মধ্যে রয়েছে অতিপ্রাকৃত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী এবং “হৃদয়ের রহস্যের ব্যাখ্যা”। এতে সাধারণ মানুষও সাধু হতে পারে এবং ঈশ্বরের দ্বারা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে।
ফেরেস্তা ও আল্লাহ ছাড়াও ইসলামের বহুল চর্চিত কুসংস্কারের অতিপ্রাকৃত চরিত্র হলো শয়তান, পিশাচ এবং জ্বীন। আরবি লোককাহিনীতে একজন পুরুষ পিশাচকে ঘুল বলা হয় এবং নারীকে বলা হয় ঘুলা। ঘুলকে কবরস্থান এবং অন্যান্য জনবসতিহীন স্থানে বসবাস করতে বলা হয়। মুনকার এবং নাকিরের মতো অদেখা এবং অতিপ্রাকৃত ফেরেশতাদের সমাধিতে ইসলামিক ইস্কাটোলজিতে যাওয়ার মত বিশ্বাস বিশ্লেষণ করার সময় জন ম্যাকডোনাল্ড বলেছেন যে, এই ধরনের ধারণার উদ্ভব সম্ভবত সমসাময়িক লোককাহিনী বা কুসংস্কার হতে পারে। যখন ইসলাম আরবের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে তখন জ্বীনের প্রতি বিশ্বাস ইরান, আফ্রিকা, তুরস্ক এবং ভারত থেকে আত্মা এবং দেবতাদের স্থানীয় বিশ্বাসের সাথে একীভূত হয়।
যেহেতু জ্বীন অন্যান্য ধর্মের অনেক আত্মা এবং রাক্ষসদের থেকে ভিন্ন এবং কোরনে বর্ণীত তাই তাদের শারীরিক প্রাণী বলে মনে করা হয়। তাই মুসলমানরা জ্বীন কুসংস্কার মেনে চলে। যেমন গরম জল নিক্ষেপ বা প্রস্রাব করার আগে জ্বীন তাড়ানোর দোয়া, দস্তুর উচ্চারণ করা ইত্যাদি। যাতে জ্বীনরা মানুষকে বিরক্ত না করে।
জ্বীনের শারীরিক উপস্থিতির কারণে ইসলামিক পণ্ডিতরা জ্বীন এবং মানুষের মধ্যে বিবাহের আইনি সমস্যা নিয়ে বিতর্ক করেছেন! যা অতিপ্রাকৃত প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে যৌন মিলনে সুদূরপ্রসারী বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করে। শায়তিন (শয়তান) জুডিও-খ্রিস্টান রাক্ষস থেকে উদ্ভূত অন্য ধরনের অতিপ্রাকৃত প্রাণী। কুরআন অনুসারে তারা প্রায়শই স্বর্গ আক্রমণ করে। কিন্তু ফেরেশতারা তাদের উপর উল্কা নিক্ষেপ করে মানুষকে রক্ষা করে। তাই কিছু মুসলমান আকাশে উল্কাপাত হলে ফেরেস্তা কর্তৃক শয়তানের দিকে নিক্ষেপ করা উল্কার পক্ষে শায়তিনকে অভিশাপ দেয়। এটি একটি কুসংস্কারের সার্কাস যা কুসংস্কারের সাথে ইসলামের অভিন্নতা প্রমাণ করে।
দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা ধর্মকে “অন্ধবিশ্বাসের সবচেয়ে ব্যাপক এবং ক্ষতিকর রূপ” হিসাবে অবিহিত করেন। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে কুসংস্কারের অর্থ হল এটি এমন একটি বিশ্বাস যা ভিত্তিহীন বা যুক্তিহীন। যেহেতু সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভিত্তিহীন এবং অযৌক্তিক হিসাবে দেখা যায় তাই ধর্মকেও কুসংস্কার মনে করা যায়। তাই ধর্ম ও কুসংস্কার একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ ।
সাধারণত উচ্চতর অনুভূত ধর্মীয়তা কুসংস্কার বাড়ায়। তদুপরি, এমন প্রবণতা রয়েছে যে ধর্মহীন বা ধর্মীয় সম্প্রদায়বিহীন লোকেরাও কুসংস্কারে সর্বনিম্ন বিশ্বাস রাখে। আর ধর্মবিশ্বাসী দেশগুলির মধ্যে কুসংস্কার শক্তিশালী এবং এর একটি শক্তিশালী বৈচিত্র্য রয়েছে।
বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ভলতেয়ার বিশ্বাস করেন যে, মানুষের কুসংস্কার খুবই বিপজ্জনক। “ঈশ্বর যখন আমাদের রুটি দেন তখন আমাদের নিজেদেরকে পুষ্ট করার চেষ্টা করা উচিত নয়”। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাস দরকারী কিন্তু প্রয়োজনীয় নয়।
ভয়কে জয় করার জন্য আদিম মানুষের গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিলো। দলবদ্ধতা প্রতিকূল পরিবেশে গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দেয়। ধর্মসৃষ্টির প্রথম কারণটি ছিল ভয়কে জয় করা। কিন্তু এর মূল উপাদান যেহেতু আদিম, অযৌক্তিক, মানসিক ট্রমা, কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক ভিত্তি সেহেতু এটা মানুষকে দলবদ্ধ করার পাশাপাশি নিষ্ঠুর, বিভক্ত এবং শত্রুতা তৈরী করে।
নবী/অবতারগুলোর বৈশিষ্ট্য
এন সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এর মতে, নবী এর সংকীর্ণ অর্থে প্রফেট (গ্রীক প্রফেটেস, “ফোথটেলার”) শব্দটি একজন অনুপ্রাণিত ব্যক্তিকে বোঝায়। যিনি বিশ্বাস করেন যে তাকে তার দেবতা বলার জন্য একটি বার্তা দিয়ে পাঠানো হয়েছে। সে অর্থে সে তার দেবতার মুখপত্র। একটি বিস্তৃত অর্থে, শব্দটি এমন যেকোন ব্যক্তিকে বোঝাতে পারে যিনি দর্শন, স্বপ্ন বা লটারির মাধ্যমে দেবতার ইচ্ছা উচ্চারণ করেন। (দেবতার ইচ্ছাও একটি লিটার্জিকাল সেটিংয়ে বলা যেতে পারে।) এইভাবে, ভাববাদী নবী প্রায়ই যাজক, শামান (উপজাতীয় সমাজে একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যিনি নিরাময়কারী, ভবিষ্যদ্বাণীকারী এবং মানসিক ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে কাজ করেন), ভবিষ্যদ্বাণীকারী এবং রহস্যবাদীর সাথে যুক্ত।
অর্থাৎ, এখানে নবীর যে অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাতে তিনি একজন কুসংস্কারের ওঝার বৈশিষ্ট্যের সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।
ধর্মের অলৌকিক ঘটনা
ধর্মবেত্তারা মনে করে অলৌকিকতা ধর্ম বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। ধর্মান্ধরাও একই, তারা বিশ্বাস রাখতে প্রমাণ খুঁজে না। অলৌকিক ঘটনা যা কাকতালীয়, একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার সাদৃশ্য, সেটি প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম দুভাবেই হতে পারে। আর প্রচলিত ধর্ম যে অলৌকিকতার কথা বলে সেগুলো সর্বদা জীববিদ্যা কিংবা পদার্থবিদ্যার চিরায়ত নিয়ম এবং সমীকরণ লংঘন করে। প্রকৃতি যেহেতু পদার্থ দিয়ে গঠিত তাই পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম লঙ্ঘন করা যেকোন ঘটনাই মিথ্যা।
খ্রিস্টান ধর্ম গসপেলগুলিতে যিশুর বিভিন্ন ধরণের অলৌকিক কাজের কথা বলা হয়েছে। যেমন- যিশু মৃতদের জীবিত করতেন, অসুস্থদের নিরাময় করতেন, ভূতদের তাড়াতেন, কানা শহরে রুটি বৃদ্ধি করতেন এবং জলকে ওয়াইনে পরিণত করতেন। ইসলামেও একই –মুহাম্মদ চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করেছিলেন, ইসরা ও মিরাজ গমন করেছিলেন। কুরআনেও একই কথা- হুদাইবিয়ার অলৌকিক ঘটনা, গাছের কান্ড কান্নাকাটি করে, ফেরেশতা ও জ্বিনদের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি।
গৌতম বুদ্ধের জীবনে ঘটা কিছু অলৌকিক ঘটনাও আছে। যেমন- তাঁর জ্ঞানার্জনের পরে, বুদ্ধ ধ্যানের মাধ্যমে অর্জনযোগ্য বেশ কয়েকটি অতি-সাধারণ শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে পানির ওপর দিয়ে হাঁটা, দেয়ালের মধ্য দিয়ে হাঁটা, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, উচ্ছ্বাস এবং নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা।
হিন্দুধর্ম গ্রন্থে অলৌকিকতার অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন, ভগবান শিব তার শিরচ্ছেদ করা পুত্রকে একটি হাতির মাথা দিয়ে জীবিত করছেন (এই হাতির মাথাওয়ালা দেবতা ভগবান গণেশ নামে পরিচিত)। কিছু হিন্দু বিশ্বাস করেন যে ব্রাহ্মণ সর্বশক্তিমান তাই এই ঘটনাগুলি আসলে ঘটেছে। এ সবগুলো ঘটনাই জীববিদ্যা কিংবা পদার্থবিদ্যার চিরায়ত নিয়ম এবং সমীকরণ লংঘন করে।
“আত্মা” কুসংস্কারের অংশ
প্রাগ্ঐতিহাসিক অ্যানিমিস্ট প্রাচীন ঐতিহ্য ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্যকে তাদের আত্মীয় বা পূর্বপুরুষ বলে মনে করে, যাদের থেকে তাদের সম্প্রদায়ের বংশধরা এসেছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা ত্যাগ করার পর কোনো না কোনোভাবে সমাজে প্রভাবশালী ধর্মীয় ঐতিহ্য অ্যানিমিজম নিয়ে আসে। এই বিশ্বাসীর লোকেরা মনে করত যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা যার মধ্যে মানুষ, প্রাণী এবং গাছপালা রয়েছে (তবে পাথর, হ্রদ, পর্বত, আবহাওয়া ইত্যাদিও একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণআত্মা ভাগ করে) – আত্মা বা পরমাত্মা তাদের শক্তি দেয়। সব কিছুর মধ্যে আত্মা আছে। অ্যানিমিজম ল্যাটিন শব্দ অ্যানিমা থেকে এসেছে, যার অর্থ জীবন বা আত্মা। এসব লোকেরা প্রায়শই “আদিম” বিশ্বাসের কথা চিন্তা করে যখন তারা অ্যানিমিজমের কথা ভাবে। আধুনিক কালে সমস্ত প্রধান ধর্মেই আদিম অ্যানিমিজমের “অতিপ্রাকৃত” বিশ্বাস খুঁজে পাওয়া যায়।
আত্মার বিশ্বাস: বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে প্রায় ২০০,০০০ বছর আগে মানুষ প্রথম শিল্প, পোশাক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রকাশ করেছিল।- তখন তারা আত্মার ধারণাও তৈরী করেছিল। যাকে মানব জাতির প্রথম সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা বলে। ৩০ থেকে ৫০ হাজার বছরের পুরোনো শামনবাদে আত্মা এবং পরকালের পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও শামানবাদকে প্যালিওলিথিক শিকারী-সংগ্রাহকদের সার্বজনীন ধর্ম হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে (সূত্র- Eliade 1964; Winkelman 1990)। তবে এটি একটি ধর্ম নয়- বরং বিশ্বাস। যা আচরণের একটি জটিল প্রকৃয়া। এটি পূর্বপুরুষের আত্মাদের সাথে যোগাযোগের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। যা পরকালের জগতে আত্মার বেঁচে থাকা সাধারণ জগত বর্ণনা করে।
শামানবাদ সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় অনুশীলনের একটি ব্যবস্থা। ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রায়শই আদিবাসী এবং উপজাতীয় সমাজের সাথে যুক্ত থাকে এবং এটি বিশ্বাসের সাথে জড়িত যে শামানরা অন্য জগতের সাথে একটি সংযোগের মাধ্যমে অসুস্থদের নিরাময় করার, আত্মার সাথে যোগাযোগ করার এবং মৃতদের আত্মাকে পরবর্তী জীবনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।
একজন শামান হলেন একজন ধর্মীয় বা রহস্যময় বিশেষজ্ঞ (পুরুষ বা মহিলা) যিনি ঐতিহ্যগত আদিবাসী সমাজে নিরাময়কারী, নবী এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তবুও এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিরাময়ের প্রাচীনতম রূপগুলির মধ্যে একটি এবং এটি সারা বিশ্বের অনেক অঞ্চলের সংস্কৃতির একটি অংশ। এটি এখনও দক্ষিণ আমেরিকা, ওশেনিয়া, চীন, তিব্বত এবং কোরিয়াতে অনুশীলন করা হয়।
আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যে আত্মার ব্যবহার তা প্রাচীন ইরাকের ব্যাবিলনিয়াতে শুরু হয়। আর ধর্মে পরকালের ব্যবহার শুরু হয় মিশরে।
আত্মা নিয়ে দার্শনিকদের চিন্তা: প্লেটো বলেছিলেন যে, মৃত্যুর পরেও আত্মা বিদ্যমান এবং চিন্তা করতে সক্ষম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দেহগুলি মারা যাওয়ার সাথে সাথে পরবর্তী দেহগুলিতে আত্মা ক্রমাগত পুনর্জন্ম (মেটেম্পসাইকোসিস) হয়।
তারপর, গ্রিক দার্শনিকদের আত্মার ধারণা অন্যান্য ধর্মে গ্রহীত হওয়া শুরু করে! প্রারম্ভিক খ্রিস্টান দার্শনিকরা আত্মার অমরত্বের গ্রীক ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। তারা আত্মাকে ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট এবং গর্ভধারণের সময় ঈশ্বর মানবদেহে আত্মা প্রবেশ করান এরকম মনে করেছিলেন। হিন্দুধর্মে আত্মা (“শ্বাস” বা “আত্মা”) হল সার্বজনীন, চিরন্তন আত্ম, যার প্রতিটি পৃথক আত্মা (জীব বা জীব-আত্মা) অংশ নেয়।
আত্মার বৈজ্ঞানিক ধারণা
মনস্তাত্ত্বিকদের জন্য আত্মার অস্তিত্ব নেই এমন নয়, তাদের প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানীরা ১৯৩০ এর দশকে মনোবিজ্ঞান থেকে আত্মাকে বাদ দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে মানুষের আবেগ, অনুভূতি, অনুপ্রেরণা, মানসিক ক্রিয়াকলাপ, সংবেদন, স্মৃতি, যুক্তি এবং সিদ্ধান্ত সবই পরিচালিত হয় মস্তিস্ক হতে। অথচ ধর্মগুলো বলে আত্মা হৃদপিন্ডে থাকে। যাইহোক, মূলত মস্তিষ্কই আত্মা এবং আত্মাই মস্তিষ্ক- মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আমাদের আবেগ, অনুভূতি, জীবদেহের চেতনা, জীবন শক্তি সবগুলোই নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ক হতে। আত্মার আলাদা কোন অস্তিত্ব নাই। বৈজ্ঞানীক ভাবে যেহেতু আত্মার অস্তিত্ব নেই সেহেতু এটি অতিপ্রাকৃতশক্তির সাথে মিলিত হতে কিংবা পরকালে যেতে পারে না।
দার্শনিক ডেসকার্টের পিনিয়াল গ্রন্থিকে মস্তিষ্কের কেন্দ্রে আত্মার প্রধান আসন এবং আমাদের সমস্ত চিন্তাভাবনার স্থান হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা আত্মায় বিশ্বাস করেন না। তাছাড়া সাইকোলজিস্টরাও আত্মায় বিশ্বাসী নন। এসব বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আত্মা নিয়ে চিন্তা করা বা এর সাথে সম্পর্কিত অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস কুসংস্কার। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আচরণ পরিবর্তন করার জন্য আসক্তি, ফোবিয়া, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার উপর চিকিৎসা করেন।- তাদের কাজে কখনও আত্মার প্রসঙ্গ আসেনা।
কুসংস্কারের স্থান-কাল
প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রাচীন ইরাকের মেসোপটেমিয়াতে সবচেয়ে পুরনো কুসংস্কারের খোঁজ পেয়েছেন। তারা এও বলেন যে, প্রিতিষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি ধর্মের উৎস প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায়। আমাদের ভারতবর্ষে যেসব কুসংস্কার প্রচলিত সেগুলোও ওখান থেকে এসেছে। দেখুন আমাদের সাথে মিলে কি-না?
মেসোপটেমিয়ান কুসংস্কার: প্লেগ থেকে বাঁচতে তাবিজ- প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা দুষ্ট চোখ এড়াতে ঘণ্টার আকৃতির তাবিজ পরত। ব্যাবিলনীয় ভাগ্যবক্তারা ভবিষ্যদ্বাণী করতে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং বিদ্বেষ এর জন্য (প্রাণীর অন্ত্রে অশুক অনুসন্ধান করা) ব্যবহার করতেন।
মিশরীয় কুসংস্কার: কাক ডাকার দুর্ভাগ্য। জুতা এবং ফ্লিপফ্লপ উল্টানো যাবে না। কাঁচি খোলা রেখে যাওয়া দুর্ভাগ্য। নীল ফিরোজা দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করে। কাঁধের উপর লবণ ছিটা মহান( তীর্থযাত্রীবা বা মেজবানী) রান্না বাড়ে। আপনার হঠাৎ কাউকে জাগানো উচিত নয়। কাঠের উপর আঘাত করা দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করে। কানে ব্যথা হলে কেউ আপনাকে খারাপ কথা বলছে ইত্যাদি।
ইরানি কুসংস্কার: ধূপ পোড়ানো বা জল ছিটানো (ভাল বা খারাপ ভাগ্য আনার ধারণা)। বদ নজর: মন্দ (বা “নবনা”) বদ নজর যে লোকেরা আপনার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয় এবং আপনাকে অভিশাপ দেয়। গাছের ডালপালায় বা হাতে রঙ্গীন সুতা দিয়ে গিট দেওয়া: ইরানিরা বিশ্বাস করে যে অল্পবয়সী অবিবাহিত ব্যক্তিদের বদ নজর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আগে অঙ্কুরের ডালপালা গিঁট দেওয়া উচিত। – এটি একটি সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার শুভ লক্ষণ হিসাবেও দেখা হয়।। নিরাপদ ভ্রমণের জন্য কুসংস্কার: ভ্রমণে যাওয়ার আগে ভ্রমণকারী কুরআনকে চুম্বন করে। ইরানের শিয়া এবং সুন্নি উভয় বিশ্বাস করে যে ঘরে বিবাহ বন্ধ রয়েছে সেখানে কোনো তালাকপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা বিধবা থাকা উচিত নয়। অন্যথায় বিবাহ ব্যর্থ হবে ইত্যাদি।
ভারতীয় কুসংস্কার: বর্তমান এই ২১শতকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশের তালিকায় ভারত প্রথম স্থানে রয়েছে। ধর্ম এবং কুসংস্কার এখানে আলাদা করা যায়না। একটি বিড়াল আপনার পথ অতিক্রম করা থেকে দুধ ফোটাতে গিয়ে পড়া পর্যন্ত, ভারতে দুর্ভাগ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। তাছাড়া, রাস্তা পার হওয়া একটি কালো বিড়াল- ভারতীয়দের দুর্ভাগ্যের প্রতীক। মাছ খাওয়ার পর দুধ খেলে চর্মরোগ হয়। মঙ্গুজ দেখা খুব ভাগ্যবান হওয়ার প্রতীক। সূর্যাস্তের পর ঝাড়ু দেবেন না। সূর্যাস্তের পর নখ কাটবেন না। নির্দিষ্ট দিনে মাংস খাওয়া উচিত নয়। বাইরে যাওয়ার আগে দই খান। সূর্য কিংবা চন্দ্র গ্রহন গর্ভবতী মহিলাদের জন্য অশুভ লক্ষণ। বাম হাতের তালু চুলকায় মানে আপনার কাছে টাকা আসছে। উপহারের টাকায় এক টাকা যোগ করা ভাগ্যের ব্যাপার। একটি আয়না ভাঙলে সাত বছরের দুর্ভাগ্য হবে। ভারতে ওঝা একটি আয়নাপড়া দেয় মানে, আয়নায় একজন ব্যক্তির প্রতিবিম্বকে ঘর বা ব্যক্তির আত্মার একটি অংশের সাথে সংযুক্ত বলে বিভ্রম তৈরী করে।
ভারতে অনেক সম্প্রদায়ে মহিলাদের ঋতুস্রাবকে “অপবিত্র” হিসাবে বিবেচনা করা হত (এবং কিছু ক্ষেত্রে এখনও)। ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের মন্দিরে যেতে বা আচার স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না (এটি নষ্ট হওয়ার ভয়ে)। এই ঋতুস্রাব মহিলাদেরও অন্য লোকেদের স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না এবং সাধারণত দূষণ ছড়ানোর ভয়ে একটি পৃথক ঘরে বসে আলাদা প্লেট থেকে খেতে হত। এমনকি যুক্তরাজ্যে অনেক কৃষকের স্ত্রীরা বিশ্বাস করতেন যে ঋতুস্রাবের সময় পরিচালিত দুধ মাখনে মন্থন করা যায় না বা হ্যামগুলি তাদের হাত থেকে লবণ নেবে না। কারণ এটি অপবিত্র বা অপবিত্র বলে মনে করা হয়েছিল।
ইউরোপে কুসংস্কার: ইউরোপের অন্ধকার যুগ তৈরী হয়েছিলো গোথ, ভ্যান্ডাল, হুন এবং অন্যান্য উপজাতিদের দ্বারা একাধিক আক্রমণের কারণে, রোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার ফলে। এর ফলে রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলি শক্তিশালী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং কলুষিত হয়ে ওঠে। সামন্তবাদ এবং সামন্ত রাজারাও প্রাধান্য লাভ করে। মধ্যযুগীয় সময়ে মানুষ ডাইনি ও মন্দ আত্মায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত । তাদের জন্য দুর্ভাগ্যকে দায়ী করত। এমন একটি সময় ছিল যখন মহিলা এবং পুরুষদের প্রায়ই ডাইনি হওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। মধ্যযুগ হল অনিশ্চয়তার যুগ।এই সময়ে বসবাসকারী লোকদের বিশ্বের জ্ঞানের অভাব ছিলো। এই সময়ে কুসংস্কারকে মানুষ দৈনিক রুটিন হিসাবে মানত। আধুনিক শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে এখন তারা কুসংস্কার মুক্ত।
বাংলাদেশে তন্ত্র-মন্ত্র, কবিরাজি, ভাওতাবাজি
বাংলাদেশে মানুষের অজ্ঞতা, ভয়ে ও হতাশাকে পুঁজি করে ধর্মের মোল্লা পুরোহিত কিংবা কুসংস্কারের ওঝা, কবিরাজ যারা মানুষের কাছে প্রচার করে গুপ্তবিদ্যা ইন্দ্রজাল, আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান- তিন জনই এক জন। এরা কবিরাজ। নূরানী তাবিজের কিতাব- লোকমানী চিকিৎসা। যথা ধর্ম তথা জয়। ব্যবহারই মানুষের পরিচয়। কামরূপ কামাখ্যা থেকে ২১ বছর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কবিরাজের উদ্ভব। তান্ত্রিক মগ, বৌদ্ধ, জ্বীন ও কালি সাধক। ফালনামা ও তদবীর। প্রেম ভালোবাসায় ব্যর্থ তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়। বিয়ে, বন্ধ্যা/নিঃসন্তান, জায়গা জমি নিয়ে ঝামেলা। স্বামী-স্ত্রীর অমিল। যে কোন অসাধ্য কাজকে সাধ্য করে দেয়া হয়। সংসারে অশান্তি/মানসিক কষ্ট দূর করা হয়। বান টোনা, নষ্ট/জ্বীন-ভূতের আছর দূর করা। বিদেশে অশান্তি/শুভ কাজে বাধা দূর। শত্রু দুশমন কে বশ করা হয়। যে কোন খেলাধুলার বিষয়ে তদবীর। ব্যবসা বাণিজ্যে শনির বাঁধা দূর। তন্ত্র, মন্ত্র, রত্ন পাথরের মাধ্যমে গ্রহ, নক্ষত্রের প্রভাব দূর করাসহ বিভিন্ন ভাগ্য পরিবর্তন করে।
অনেক জটিল রোগেরও চিকিৎসা করে এরা। কিছু কবিরাজ কমলা গাছ, সাদা লজ্জাপতি, রক্তচন্দন, নাগমণি, পরশমণি, চা গাছ, লালমাতাল, কুড়াসমতি, শ্বেতচন্দন, শ্বেত আনন্দ, মনামণি, অর্জুন, বাহুবল ইত্যাদি লতাগুল্ম দিয়ে চিকিৎসা দেয়। কেউ আবার পশুর চামড়া দিয়েও চিকিৎসা দেয়। যেমন- উটের চামড়া, ভাল্লুকের চামড়া, বাঘের চামড়া। মাছ ও পশুর হাড়, কালো ঘোড়ার হার, কট মাছের হাড়, তিমি মাছের হাড়সহ আরো অনেক কিছু। এসব গাছ-গাছালি, পশুর চামড়া, হাড়গোড় একটু করে তাবিজে ভরে দেওয়া হয়। আর এসব তাবিজ গলায়, হাতে বা কোমরে বেঁধে রাখতে বলা হয়। ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজরা জানে মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে।
এ ব্যপারে ডয়েচেভেলে কে অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, আমি মনে করি, এটা মাইন্ডসেট৷ আমাদের বাবা-মা আমাদের যেভাবে শিক্ষিত করেছেন আমরা সেভাবেই বড় হয়েছি৷ আধুনিক চিকিৎসার পরও অবচেতন মনে জন্মগতভাবে আমাদের কবিরাজি বা হোমিওপ্যাথির উপর বিশ্বাস রয়েই যায়৷ দেখেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার উপত্তি যেখানে সেই ব্রিটিশরা কিন্তু এটা নিষিদ্ধ করেছে৷ অথচ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে কিন্তু কবিরাজি চিকিৎসার একটা প্রভাব আগে থেকেই চলে আসছে৷ ছোটবেলা থেকে আমরা বাবা-মায়ের মুখে যেভাবে শুনে আসছি, সেটার কারণেই এই বিশ্বাস৷ যেমন ধরেন ক্যান্সার চিকিৎসা৷ এটা তো ব্যয়বহুল৷ আবার একটা পর্যায়ে গিয়ে আর রোগীকে বাঁচানো যায় না৷ সেখানে মানুষ মনে করে এই চিকিৎসায় হচ্ছে না, তাহলে কবিরাজি দিয়েই চেষ্টা করে দেখি৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রথাগত তন্ত্র-মন্ত্র কবিরাজি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অনুশীলন করা হয়। প্রধানত নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থার লোকেরা এসবে বিশ্বাস করে। প্রায় ৮০% রোগী সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য এসব ঐতিহ্যগত কুসংস্কার মূলক চিকিৎসার উপর নির্ভর করে। কারণ প্রমাণ-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা হয় ব্যয়বহুল বা কখনও কখনও সুলভ নয়।
ধর্ম মানেই ভয়- প্রসঙ্গ ইসলাম
কেয়ামতের ভয়: কুসংস্কারের মত ইসলামও ভয় সৃষ্টিকারী কনসেপ্ট নিয়ে আসে। যেমন কিয়ামতের ভয়, শেষ বিচারের ভয় এবং দাজ্জাল, ইমাম মাহদী এবং হযরত ঈসা আঃ এর আগমনে মুসলিমদের ভয়। যাতে আধুনিকতা হতে মানুষ ধর্মে ফিরে আসে।
ইসলামী আকীদা অনুসারে, ইসরাফিল (অতিপ্রাকৃত শক্তি) শিঙ্গায় ফুৎকার দিলে কিয়ামত হবে। অর্থাৎ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে। প্রথম ফুৎকার দেওয়ার সাথে সথেই আকাশ ফেটে যাবে (বিজ্ঞানে আকাশ বলে কিছু নেই), তারকাসমূহ খসে পড়বে (তারকা সমুহ কোন কিছুর সাথে বাঁধা থাকেনা), পাহাড়-পর্বত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে তুলার মত উড়তে থাকবে। সকল মানুষ ও জীব-জন্তু মারা যাবে। আকাশ ও সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে(বিজ্ঞানে আকাশ বলে কিছু নেই)। দ্বিতীয় ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত সৃষ্ট জীবের আর্বিভাব হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে (এটা জীববিজ্ঞান এর নিয়ম লঙ্ঘন করে)।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: আকাশ বলে কিছু নেই। দিনের বেলায় সূর্যের আলোর ছোট তরঙ্গ (নীল আলো) সবার আগে পৃথিবীতে আসে বলেই আমরা আকাশ নীল দেখি। মনে হয় যেন এর একটি অস্তিত্ব আছে। আসলে তা নেই। রাতের বেলা সূর্যের আলো থাকে না বলে পুরো মহাকাশটাকেই আমরা অন্ধকার দেখি। মহাকাশে বস্তুর ভর তার স্থানকে বাঁকিয়ে দেয়। ফলে গ্রহ, নক্ষত্র এবং মহাজগতিক বস্তু একে অপরকে আবর্তন করে। ফলে একটি সুশৃংখল মহাবিশ্ব গঠিত হয়। পুরো ব্রহ্মাণ্ডের যতটুকু খালি স্থান আছে ততটুকুই তার আকাশ। ধর্মে বর্ণিত সাত তলা বিল্ডিং এর মত এই মহাকাশ বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত নয় কিংবা এর কোন অস্তিত্ব নেই।)
আধুনিক ধর্ম সংস্কারকরা ভবিষ্যৎবাণীর উপর আস্থা না রাখলেও কথিত কিছু আমিরুল মুমিনিন যারা অর্থ ও ক্ষমতা লাভের আশায় মানুষের ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দিতে চায়। তারা এই কুসংস্কারগুলি মানুষের ভেতর ব্যপক বিস্তার করে ঐক্যবদ্ধ জিহাদের পথ সুগম করে। অর্থাৎ তারা পুরনো ভবিষ্যৎবাণী দ্বারা প্রভাবিত। এটি কুসংস্কার অন্যতম বাস্তব উদাহরণ। আবার কেউ কেউ বলে যে তাদের যুদ্ধের সাথে ফেরেশতাও যুক্ত আছে। কুসংস্কারের প্রাচীন এই অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলি পাক্ ইসলাম যুগেও প্রচলিত ছিল।
মৃত্যু ও পরকালের ভয়
কোরান হাদিসের অধিকাংশ কথাই মৃত্যু ও পরকালের ভয় সম্পর্কিত। সবগুলোর রেফান্সে দিতে গেলে বিশাল হয়ে যাবে।তবে দুটো আয়াত লক্ষ্য করুন,
“প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং শুধুমাত্র বিচারের দিনেই আপনাকে আপনার পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।” অন্য জায়গায়, কোরান মানবজাতিকে আহ্বান জানিয়েছে: “এবং ইসলাম ব্যতীত মৃত্যুবরণ করো না” (৩:১০২)
“কিন্তু যখন সবচেয়ে বড় অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয় আসবে – যেদিন মানুষ মনে রাখবে যে সে যার জন্য সংগ্রাম করেছিল, এবং যারা দেখবে তাদের জন্য জাহান্নাম উন্মোচিত হবে – তাই যে সীমালঙ্ঘন করেছে এবং দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছে, তখন নিঃসন্দেহে জাহান্নামই হবে [তার] আশ্রয়স্থল। কিন্তু যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার অবস্থানকে ভয় করে এবং আত্মাকে [অবৈধ] প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখে, তবে অবশ্যই জান্নাত [তার] আশ্রয়স্থল।” (কুরআন ৭৯:৩৪-৪১)
মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে যখন একজন মানুষ মারা যায়, তাদের আত্মা তাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে আসে, বিচারের দিনের অপেক্ষায়। ইসলামে আমরা এটা জেনে সান্ত্বনা পেতে পারি যে আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের সাথে আমরা একতাবদ্ধ হব এবং মৃত্যু হল পরকালে আমাদের স্থায়ী বাড়িতে যাত্রার শুরু।
সাপ্রতিক কালে আধুনিক পোশাক পরিচ্ছেদ কিংবা নতুন শিল্পরুচির উদ্ভবের কারণে ধর্মবেত্তারা সবাইকে কেয়ামতের ভয় দেখায়। এর কারণ কেয়ামতের ভয় দেখিয়ে মানুষকে ধর্মীয় পোশাক ও সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনা।
অর্থনৈতিক উত্থানকেও কেয়ামতের আলামত হিসেবে ধরা হয়। এর মূল কারণ, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা মানুষের ধর্মকে ঐচ্ছিক করে। ফলে ধর্মবেত্তারা কিয়ামতের ভয় দেখিয়ে ধর্মকে জীবনে আবশ্যিক করতে চায়। এর মূল কারণ হলো ধর্ম হারানোর ভয় কিংবা ধর্মে ফিরিয়ে আনা।
মানুষের নৈতিক পরিবর্তনকেও কেয়ামতের লক্ষণ বলে মনে করা হয়। অথচ ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই।
কুসংস্কার হতে পরকালের উদ্ভব
প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়ার সংস্কৃতিতে আত্মা ও পরকালের চর্চা ছিল। তাদের কাছে এটা ছিলো পাতাল বা আন্ডাগ্রাউন্ডের দেবতাদের সাথে সম্পর্কিত। আজকের সময়ে যে পরকালের কথা বলা হয় সেটা প্রাচীন সেমেটিক- খ্রিষ্টবাদী পরকাল।
পরকালের উদ্ভব নিয়ে বিজ্ঞান
পরকাল মৃত্যুর-কাছাকাছি অভিজ্ঞতা (NDEs), déjà vu-এর অনুভূতি দেয়- এরকম। déjà vu -পূর্বদৃষ্ট হল একটি নিশ্চিত অনুভবের অভিজ্ঞতা, যা একজন ইতঃপূর্বে এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে অথবা স্বচক্ষে দেখেছে (একজন ব্যক্তি অনুভব করে যে ঘটনাটি ইতিপূর্বে অথবা সাম্প্রতিক ঘটেছে), যদিও পূর্ববর্তী পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সঠিক ঘটনাটির সম্পর্কে অনিশ্চিয়তা রয়েছে। এগুলিকে ফরাসি ও ইংরেজিতে দেজা ভ্যু (Déja vu) বলে। যেখানে তারা দেখে ভূত আসতেছে এমন অনুভূতি। যেহেতু ভুত তাদের আগেই শেখানো হয়েছিলো। সম্ভবত এটি তাদের মনে হয়েছিলো যে মৃত্যুর বাইরেও জীবন আছে।
আফ্রিকানরা সাধারণত বিশ্বাস করে যে দেহ মারা যাওয়ার পরে জীবন অন্য রাজ্যে চলতে থাকে। মৃত্যুর পরে পূর্বপুরুষ হওয়া আফ্রিকান সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ব্যবস্থার অন্যতম বড় লক্ষ্য। মৃত্যুর আফ্রিকান ধারণাটি পূর্বপুরুষের উপাসনা নামেও পরিচিত। যেখানে মৃত্যুকে আত্মা জগতে প্রবেশের একটি অনুষ্ঠান হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
মানুষ সবচেয়ে ভয় পায়- মৃত্যু। আমরা মানুষ সবসময়ই মৃত্যু এবং মৃতদের ভয় পাই। কুসংস্কারের ওঝা এবং ধর্মীয় পুরোহিত এটিকে পুঁজি করে। মৃতদের হাত থেকে জীবিতকে রক্ষা করার উপায় হিসেবে পরকাল নামক কুসংস্কার শুরু হয়েছিল। তারা জানে যে কাউকে ভয় দেখানোর জন্য তাদের যা করতে হবে তা হলো- মৃত্যুপরবর্তী একটি ভয় ভিত্তিক ধারণা তৈরী করা।
বৌদ্ধ, হিন্দু বা শিখ নয় এমন কিছু লোকও পুনর্জন্মের ধারণায় বিশ্বাস করে! যারা অগত্যা মনে করে যে প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের জন্য পুরস্কৃত হওয়ার জন্য ভাল এবং মন্দের শাস্তির প্রয়োজন। কিন্তু তারা এমন একটি ঐতিহ্যগত বিশ্বাসকে ধারণ করে না যা পরকালের প্রতিশ্রুতি দেয়। খ্রিস্টধর্ম, ইহুদি ধর্ম এবং ইসলাম পরকালের কথা বলে। তাই এই ধর্মের অনুসারীদের জন্য মৃত্যুর পরের জীবন ঈশ্বরের দ্বারা প্রতিশ্রুত হয়েছে। বৌদ্ধদের জন্য পুনর্জন্মের বিশ্বাস এই ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে যে বুদ্ধ জ্ঞান অর্জনের সময় তাঁর পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করেছিলেন।
দার্শনিক স্যামুয়েল শেফলার প্রথাগত পরকালে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করেন না যে একটি আত্মা বা আত্মা শরীরের শারীরিক মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকে। দার্শনিকদের একটি অংশ বিশ্বাস করতেন যে শরীর নশ্বর এবং আত্মা অমর। সপ্তদশ শতাব্দীতে দেকার্তের পর থেকে বেশিরভাগ দার্শনিকরা মনে করেছেন যে, আত্মা মনের সাথে অভিন্ন এবং যখনই একজন ব্যক্তি মারা যায় তাদের মানসিক বিষয়বস্তু একটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় বেঁচে থাকে। কিন্তু নাস্তিকরা বিশ্বাস করে যে কোন ঈশ্বর নেই এবং মৃত্যুর পরে কোন জীবন নেই এবং মৃত্যু হল ব্যক্তির অস্তিত্বের অবসান।
ভয় হতে পরকালের উদ্ভব: পরকাল সম্পর্কিত মানষিক ভয় থানাটোফোবিয়া শুধুমাত্র মৃত্যুর উদ্বেগই নয়, এর অর্থ হতে পারে একটি তীব্র ভয়, মৃত্যু সম্পর্কে কারো চিন্তাভাবনার সাথে সামগ্রিক ভয়ের অনুভূতি- যা থেকে সৃষ্টি হয় কুসংস্কার। মানুষ মনে করে মৃত্যূকালে আত্মা বের হয়ে যায়। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মানুষের মৃত্যুর সময় আত্মার কোন ভূমিকা নাই। মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেলে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মৃত্যু ঘটে। এখানে আত্মা কোথাও বেরিয়ে যায়না।
জীববিজ্ঞানী, স্নায়ুবিজ্ঞানী, মণোবিজ্ঞানীরা আত্মায় বিশ্বাসী নয়। এমনকি শক্তি সণাক্ত করার কোন যন্ত্রে আত্মার অস্তিত্ব ধরা পরেনি। তাই পদার্থবিদরাও আত্মায় বিশ্বাস করেনা। বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণেও আত্মা খুঁজে পাওয়া যায়নি।মস্তিষ্কের শেষ মানে একজন ব্যক্তির অস্তিত্বের শেষ। মস্তিষ্ক মারা যাওয়ার পরে কোন মানসিক জীবন থাকতে পারে না। তার ভাষাগত ক্ষমতাও থাকে না। ফলে মৃত্যুর পর তার কনসাস পরকালে যেতে পারেনা। তাই আমাদের পরকাল ভয় পাওয়া উচিত নয়।
ধর্ম ও কুসংস্কারের ক্ষতিকর দিক সমুহ
কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস সমাজের মানুষের সামাজিক কল্যাণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এটি আর্থিক ঝুঁকি গ্রহণ এবং জুয়া খেলার আচরণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এটি আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয়। এটি মানুষকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে চিন্তা করতে দেয়না।এটি ভয়ের মাধ্যমে ইচ্ছাশক্তিকে পঙ্গু করে দেয়। এটি যৌক্তিক চিন্তাভাবনাকে অবরুদ্ধ করে।এটি বিদ্যমান অপ্রচলিত বিশ্বাসে লিপ্ত করায় ইত্যাদি।
ধর্ম মানুষকে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে বাইরের কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করতে বাধ্য করে। ধর্ম ভাল এবং খারাপ আচরণের অযৌক্তিক নিয়ম আরোপ করে। ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে এবং এটি দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের কারণ। অধিকাংশ ধর্মের শ্রেণীবদ্ধ কাঠামো গণতান্ত্র বিরোধী এবং এটি মৌলিক মানবাধিকারকে আঘাত করে।
কুসংস্কার তার প্রতিবেশি গোষ্ঠীর প্রতি অহেতুক বিরোধিতা, পরিহার, বৈষম্য, শারীরিক আক্রমণ এবং নির্মূল করে। কুসংস্কার সামাজিক গোষ্ঠীগুলির ভেতর রাগ, ভয়, বিতৃষ্ণা, করুণা, অপরাধবোধ, হিংসা, অবজ্ঞা সৃষ্টি করে।
আপনি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে পারেন যদি একজন ধর্মীয় নেতা থাকে। আপনাকে অপমানিত বা বিব্রত করার জন্য ধর্মগ্রন্থ বা বিশ্বাস ব্যবহারই যথেষ্ট। ধর্ম আপনার টাকা বা অন্যান্য সম্পদ দিতে বাধ্য করেছে যা আপনি দিতে চান না। ধর্ম আপনাকে ঘনিষ্ঠ হতে বা সেক্স করতে বাধ্য করেছে যা আপনি চান না।
ধর্ম কাউকে হয়রানি, অপমান বা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে যেমন- স্বার্থপর, ধর্মনিরপেক্ষ বা মতাদর্শগত বিরোধের কারণে কাউকে অবমাননার অপবাদ দিয়ে শারীরিক, মানসিক আঘাত কিংবা হত্যাও করতে পারে। অপরদিকে, সন্ত্রাস ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি আকর্ষণীয়। কারণ তারা যথাক্রমে আক্ষরিক এবং প্রতীকী অমরত্ব উভয়ই প্রস্তাব করে। যা পরকালের বিশ্বাসের আকারে এবং মূল্যবোধের সম্মানীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ধূর্ত রাজনীতিকের অর্থ ও ক্ষমতা হাসিল করতে পারে।
কুসংস্কার আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরোধীতা করে। প্রথাগত চিকিৎসকরা সাধারণত মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং রোগ পরিচালনার জন্য তাদের অনুশীলনে কুসংস্কার ব্যবহার করে। এই ধরনের অনুশীলন চিকিৎসা পেশা এবং এর প্রমাণ-ভিত্তিক অনুশীলনের সাথে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি করে। কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসগুলি স্বাস্থ্য এবং অসুস্থতা এবং মহামারীর পৃথক পার্থক্যের সাথে সম্পর্কিত। কুসংস্কারের ফলে মানসিক চাপ, বিষণ্নতা এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। কুসংস্কারের আছে ওঝা এবং ধর্মের আছে পুরোহিত/নবী সেও মাঝে মাঝে ওঝার কাজ করে। মাঝে মাঝে ধর্মীয় পুরোহিত কুসংস্কারের স্বপক্ষে আধুনিক চিকিৎসা ব্যাবস্থার সাথে দ্বন্দ্ব তৈরী করে। এরা শুধু এখানেই ক্ষান্ত নয়, তারা মানুষের অজ্ঞতাকে ব্যবহার করে কবিরাজি, জাদুটোনা, বানমারার, প্রিয়জনকে কাছে আনা, জন্ডিস, হোটাইটিস, হাড়ভাঙ্গা, অশ্ব-পাইলস, ক্যান্সারসহ যাবতীয় চিকিৎসার কথা বলে সাধারণের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করে।
কুসংস্কারের কারনে মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। যেমন- অন্যদের দ্বারা অবমূল্যায়িত হয়। তখন তাদের আত্মসম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা নিজেদের উন্নতি করার চেষ্টা করেনা। তারা সহজেই শোষিত হতে পারে। ধর্ম নারী এবং সমকামী ব্যক্তিদের প্রতি ধর্মীয় মৌলবাদ ও বৈষম্য তৈরী করে। এদের আচরণ অন্যান্য ধর্মের প্রতি বিদ্ধেষ ও বৈষম্য মূলক।
কুসংস্কার মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক আচরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার অধীনে দৈনন্দিন এবং ব্যবসায়িক পছন্দ এবং সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। কুসংস্কার প্রায়শই বাজারের অদক্ষ আচরণের দিকে পরিচালিত করে এবং সম্পূর্ণ যৌক্তিকতার অধীনে নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে মানুষকে বিচ্যুতি সৃষ্টি করে।
ধর্ম এবং কুসংস্কারের সৃষ্টি মানুষের মানষিক সমস্যা হতে। তাই এর প্রতিটি কথা উল্টা-পাল্টা এবং এগুলো মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়।
কুসংস্কারের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে ধর্ম
ধর্মীয় উপাসনালয় ও এর অনুশীলনের পেছনে সমাজ ও রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়। যেটি বন্ধ করতে পারলে জনগণের জিডিপি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেত।এটি ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য উপাসনালয়ে বৃদ্ধি ঘটায় এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে।
এটি ধর্ম ব্যবসার সাথে জড়িত বিপুল জনগণকে অন্যের দান, খয়রাত, যাকাত, ফেতরার মতো অস্থায়ী সাহায্যে প্ররোচিত করে। ফলে জনগণের কিছু অংশ বেকার ও পরনির্ভশীল হয়ে উঠে।
ধর্ম জাতিকে বিভক্ত ও বৈষম্য তৈরী করে। কখনও কখনও সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একটি জাতির মধ্যে সমান নাগরিক হিসাবে বসবাস করতে পারে না। এতে সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং অভিবাসিরা বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের পরিণতি- হয় তাদের একজনকে বাকিদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে হবে, নতুবা তাদের বিভিন্ন জাতি গঠন করতে হবে। অর্থাৎ, ধর্ম যখন একটি রাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকে তখন এটি সংখ্যালঘু ধর্মের প্রতি বৈষম্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
ধর্মের ভবিষ্যদ্বাণী সন্ত্রাস ডেকে আনে। যেমন- ইমাম মাহদি এবং যীশু খ্রিস্টের আগমন। এটি শুধু কুরআন নয়, অন্যান্য ধর্মীয় বইতেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। এমনকি কুরআনে উল্লেখিত উপাধি ও নাম সহ। ইমাম মাহদি এবং যীশু খ্রিস্টের আগমন ঈশ্বরের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যে একটি এবং এই দুই ত্রাণকর্তা ঈশ্বরের সাহায্য এবং মানুষের ইচ্ছায় আবির্ভূত হবেন। -এ ধরণের ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাসীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এ পর্যন্ত বহু লোক নিজেকে এসব দাবি করে সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে সেটা মারাত্নক আকার ধারণ করতে পারে। সুন্নীদের সাথে কাদিয়ানিদের বিরোধ এবং আশির দশকে কাবা অবরোধ কিংবা বিভিন্ন সন্ত্রাসীর আবির্ভাব মূলত এই মাহদি-যীশুর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রত্যক্ষ ফলাফল।
এটি ধর্মীয় কর্তৃত্বের পদে নারীদের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে। প্রতিটি ধর্মই পুরুষতান্ত্রিক। ধর্ম রক্ষণশীল ধর্মীয় শক্তি হিসেব আবির্ভত হয় । এটি পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে জোট তৈরী করে। ধর্ম লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য জোরদার করার জন্য নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে এবং নারীবাদীদের সহযোগিতা করতে নিষেধ করে ও শত্রুতা বাড়িয়ে দেয়।
ধর্ম পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ধর্ম সমাজে লিঙ্গ নিয়ম এবং পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোকে শক্তিশালী করে। এ ক্ষেত্রে ধর্ম নিজেই এর মূল কারণ নয়, বরং পুরুষ শাসিত ধর্মীয় ঐতিহ্য নারীদের নিপীড়ন ও অবমাননা করে। ধর্ম সাধারণভাবে মহিলাদের অধিকার এবং বিশেষ করে প্রজনন ও গর্ভপাতের অধিকারকে হতাশাগ্রস্ত করে।
ধর্মের ভয় যখন যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসের কারণ: ভয় মানুষের প্রতিনিয়ত কাজ করে। যেমন, অজানা পরকালের ভয়, প্রিয়জনকে কষ্ট পেতে দেখার উদ্বেগ, আমাদের দিনগুলি শেষ হয়ে গেছে তা জানার ভয়। অনেকের কাছে মৃত্যু এবং পরকাল একটি ভীতিকর বাস্তবতা। এটি মানুষের মণোজগতে একটি বড় এবং দুর্দান্ত হুমকি। ধর্মব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতি করে এমন চতুর লোক একেই পুঁজি করে। ধর্মীয় মৌলবাদের চরম বহিঃপ্রকাশ সন্ত্রাসের আকারে পাওয়া যায়। যার নাম রাজনৈতিক ধর্ম। এর লক্ষ্য অর্থ ও ক্ষমতা প্রাপ্তি। আত্মঘাতী বোমা হামলা সহ বিভিন্ন মাধ্যমে সহিংসতা, গুপ্তহত্যা এবং সমাজে ভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে তারা আদর্শিক লক্ষ্য অর্জন করে।
ধর্ম নিয়ে মানুষ মারাত্নক যুদ্ধ করেছে। দীর্ঘস্থায়ী ধর্মযুদ্ধ, ক্রুসেডগুলিতে ৩০০,০০০ এরও বেশি পুরুষ মারা গিয়েছিল। এটি প্রতিটি ক্রুসেডে ব্যবহৃত সেনাবাহিনী সংযোজনের গড় গণনা। ১৭শতকে ইউরোপে ধর্মযুদ্ধে ০৮ মিলিয়নেরও বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।- এটি সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি দুর্ভিক্ষ এবং সংঘাতের কারণে সৃষ্ট রোগের ফলাফল। দ্বি-জাতিতত্ত্ব বা ধর্মীয় বিভক্তির জন্য ভারত ও পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। যার ফলে ১.৫ কোটিরও বেশি লোক রিফিউজি হয়েছিল। যাদের মধ্যে ১০লক্ষ মানুষ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত হয়েছে। এর মধ্যে আনুমানিক ২০,০০০-১০০,০০০ মুসলমানকে গণহত্যা করা হয়েছিল।
যুদ্ধের এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে, সমস্ত ১,৭৬৩টি পরিচিত/লিপিবদ্ধ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে, ১২১ বা ৬.৮৭% যুদ্ধের প্রাথমিক কারণ ছিল ধর্ম। ম্যাথিউ হোয়াইটের দ্য গ্রেট বিগ বুক অফ হরিবল থিংস ধর্মকে বিশ্বের ১০০টি মারাত্মক নৃশংসতার মধ্যে ১১টির প্রাথমিক কারণ হিসাবে অবিহিত করে।
ধর্মের ভিত্তি অযৌক্তিক, মিথ্যা, কুসংস্কার হলেও সএটি বিজ্ঞানের সাথে বিরোধ তৈরী করে। পৃথিবীর বিখ্যাত জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞানীরা ধর্মের জীবন ও বিশ্ব দর্শনে একমত হতে পারেনি বলে তাদের শাস্তি দিয়েছে, নির্বাসন কিংবা হত্যা করেছে। ধর্ম এবং বিজ্ঞান উভয়ই জীবন এবং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাখ্যা দেয়। বিজ্ঞান পরীক্ষিত, পরীক্ষামূলক প্রমাণ এবং পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে। অন্যদিকে ধর্ম একজন স্রষ্টার বিষয়গত বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে- যা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোপার্নিকাস এবং গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব এবং সৌরজগত কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চার্চের সাথে সমস্যায় পড়েছিলেন।
ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বের কারণ- চার্চের কর্মকর্তারা ভয় পেয়েছিলেন যে লোকেরা বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিকে বিশ্বাস করতে শুরু করার সাথে সাথে লোকেরা চার্চকে প্রশ্ন করতে শুরু করবে। লোকেরা ধর্মবিশ্বাসের মূল উপাদানগুলিকে সন্দেহ করবে। চার্চের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে বৈজ্ঞানিক ধারণা চার্চের শক্তিশালী প্রভাবকে হুমকির মুখে ফেলবে। কোপার্নিকাসের সৌরজগত এবং ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব দুটি প্রাচীন বিশ্বতত্ত্ব ও জীবনদর্শনকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।
যাইহোক, ধর্মবেত্তারা বিবর্তনবাদ অস্বীকার করলেও তাদের ধর্মও কিন্তু বিবর্তনের শিকার! তাদের গ্রন্থ অপরিবর্তনীয় হলেও তাদের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। মানুষের চিন্তা চেতনা সব সময় পরিবর্তনশীল।এর সাথে ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও পরিবর্তনশীল। ফলে আলাদা আলাদা মতবাদের আলাদা আলাদা শাখার সৃষ্টি। এদের ভিতর কয়েকটা প্রগতিশীল মতবাদ থাকতে পারে। কিন্তু সবগুলো একই ফ্রেমে আবদ্ধ। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতে লেখা ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং এই একুশ শতকের সংস্কৃতির তুলনামূলক পার্থক্য। এটা দেখলেই বোঝা যায় যে ধর্মগুলো কতটুকু বিবর্তিত এবং বিবর্ধিত হয়েছে।
ইবাদত এবং পূজার্চনায় অর্থ ও সময়ের ক্ষতি: সনাতন এবং ইসলামসহ কিছু অনগ্রসর ধর্ম চর্চাকারীদের মধ্যে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের হার সর্বোচ্চ। এরা ধর্মকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস মনে করে। এরা বৈচিত্রময় নিয়মকানুন, উপাসনা ও ধর্মজ্ঞানের পেছনে বিপুল অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করে। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে এরা বিজ্ঞানের সত্যের সন্ধান হতে দূরে।
ধর্মীয় পোষাকের ক্ষতি: ধর্মীয় পোষাক পুরুষ এবং নারী উভয়ই পড়েন। সেগুলো লম্বা ঢিলেডালা, আগাগোড়া শরীর ঢাকা কিংবা হিজাব, নিকাব। এগুলো নারী-পুরুষ উভয়ের বিপজ্জনকভাবে চলাফেরা ও দৃষ্টিশক্তি সীমিত করে। এসব পোশাক শরীরে মারাত্মক ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি তৈরী করে। আগাগোড়া শরীর ঢাকা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির উচ্চ হারের সাথে যুক্ত। পুরো শরীর ঢাকা পোশাক শ্রবণশক্তি হ্রাস, ত্বকের সমস্যা, মাথাব্যথা, কার্ডিয়াক ডিসঅর্ডার, হাঁপানি, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরী করতে পারে। এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যও বিপদজনক। কেননা সন্ত্রাসবাদীরা এটি ব্যবহার করে।
শিক্ষার ক্ষতি: ধর্মের নামে ধর্মীয় শিক্ষা একটি অনুৎপাদনশীল খাত। এটি করতে গিয়ে রাষ্ট্র ও তার জনগণ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু এর আউটপুট- জিরো। এ মাধ্যমে রাষ্ট্রে একটি পরনির্ভরশীল প্রজন্ম তৈরী হয়।
প্রতিটি ধর্মেরই পবিত্র স্থানে তীর্থযাত্রার রুটিন মাফিক কিছু ইবাদত আছে। কথিত পবিত্র স্থানে তীর্থযাত্রার জন্য রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা বিদেশে চলে যায়।
শব্দ দুষণ: ইদানিং ধর্মের নামে প্রতিনিয়ত মাইকে ঘোষণা, ধর্মীয় স্তব-স্তুতি, গান, বাদ্য-বাজনা, টাকা কালেকশন ইত্যাদির নামে উচ্চশব্দ জনস্বাস্থ্যের মারাত্নক ক্ষতিকর।
ধর্মের সাথে আধুনিকতার দ্বন্দ্ব
পাশ্চাত্যের সাথে ধর্মের দ্বন্দ্ব মূলত আধুনিকতার সাথে প্রাচীন ঐতিহ্যের দ্বন্দ্ব। পাশ্চাত্যে যখন আধুনিকতা শুরু হয় তখন খ্রিষ্টধর্মের সাথেও তাদের মারাত্নক দ্বন্দ্ব হয়েছিল। বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক, প্রাযৌক্তিক ও শিল্প-সাহিত্য অনুশীলনের কারণে তারা সেই আধুনিকতাকে আত্মীকরণ করে নিয়েছে। কিছু অনগ্রসর ঐতিহ্য ও ধর্ম পাশ্চাত্যের এই আধুনিকতাকে খ্রিষ্টান কালচার বলে কটাক্ষ করে।- যা সত্য নয়। খ্রিষ্টানরাই এগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো এবং প্রগতিশীল সংস্কারকরা সংগ্রাম করেই এগুলো প্রতিষ্ঠা করেছে। যাইহোক এটি মূলত ধর্মের সাথে আধুনিকতার দ্বন্দ্ব।
কুসংস্কার ও ধর্ম টিকে থাকার কারণ
বিজ্ঞানী সসির বলেন, লোকেরা তাদের বিশ্বে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী এবং নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করার জন্য কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস একটি ইতিবাচক মানসিক মনোভাব প্রচার করতে সাহায্য করে। যদিও এটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে সৌভাগ্য এবং ভাগ্যের গুণাবলীতে বিশ্বাস করে নিজেকে শান্ত রাখতৈ সহায়তা করে।
ধর্ম গোষ্ঠীবন্ধ মানুষকে সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করেছিল। গোষ্ঠীবন্ধ মানুষ যখন রাষ্ট্র তৈরী করেছে তখন রাষ্ট্রের সংবিধান ধর্মের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। তারপরেও ধর্ম টিকে আছে। যার প্রধান কারণ রাষ্ট্রের শাসকরা ধর্মকে ব্যবহার করে, অজ্ঞতা ও ভয়কে পুঁজি করে জনগণকে সহজেই শোষণ করে অর্থ ও ক্ষতা অর্জন করে। এটি টিকিয়ে রাখা তাদের জন্য দরকারী।
কখনও কখনও কুসংস্কার একটি প্রশান্তিদায়ক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি অজানা উদ্বেগ থেকে মানুষকে মুক্তি দেয় এবং তাদের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি দেয়। এটিকে তখন স্রষ্টার শান্তি বলে মনে হয়। এই কারণেও হতে পারে যে ধর্ম ও কুসংস্কার এতদিন টিকে আছে এবং মানুষ সেগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছে- এই শান্তির জন্য।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি বা ধর্মের কুসংস্কারের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে বেড়ে ওঠেন তবে আপনি এই বিশ্বাসগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, এমনকি অবচেতনভাবেও। এটিও কুসংস্কার টিকে যাওয়ার কারণ।
শুধুমাত্র বিশ্বাসের কারনে কিছু ওঝা/কবিরাজ রোগীকে পথ্য হিসেবে অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়ান তা উদ্বেগ শান্ত করতে সাহায্য করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, কুসংস্কারগুলি মানুষকে অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে এবং অনিশ্চয়তা-প্ররোচিত উদ্বেগ কমাতে পারে। কুসংস্কারের ভূমিকা উচ্চতর মৃত্যু উদ্বেগ বা মৃত্যুর উদ্বেগ হ্রাসের সাথে সম্পর্কিত কিনা তা অস্পষ্ট। তবে এটির বিশ্বাস মানুষের মানষিক উদ্বেগ কমিয়ে শান্তি দেয়। তাই কুসংস্কার টিকে যাওয়ার এটি একটি কারণ।
কুসংস্কারে চাপ এবং বিরক্তি নিয়ন্ত্রণ হয়: অনেক লোকের জন্য কুসংস্কারপূর্ণ আচরণের সাথে জড়িত হওয়া নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি প্রদান করে এবং উদ্বেগ কমায়। যে কারণে চাপ এবং বিরক্তির সময় কুসংস্কারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটি বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক অনিশ্চয়তার সময়, বিশেষ করে যুদ্ধ এবং সংঘাতের সময়। তখন এটি মানষিক চাপ ও বিরক্তি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। ফলে কুসংস্কারের প্রতি কিছু আস্থা চলে আসে।
নৈতিকতা ধর্ম থেকে আসেনি
সাধারণ মানুষ মনে করে প্রাত্যাহিক জীবনের নিয়ম-নীতি- নৈতিকতা ধর্ম হতে সৃষ্টি হয়েছে- কথাটি আদৌ সত্য নয়। ধর্ম সৃষ্টির বহু আগেই আদিম গুহা মানব গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার প্রয়োজনে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া প্রচারের জন্য প্রথম নৈতিকতার উদ্ভব ঘটায়। এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। প্রাচীন নৈতিক জ্ঞান ও নীতি শাস্ত্রের জনক সক্রেটিসও একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। তার নৈতিক শিক্ষার ছাত্ররা যেমন- প্ল্যাটু, অ্যারিস্টটলসহ সবাই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক বাহক ছিলেন। অথচ ধর্ম এটিকে নিজের সম্পদ মনে করে। ভয়ের মাধ্যমে নৈতিকতা জাগ্রত হয়না। নৈতিকতা জাগ্রত হয় পরিপূর্ণ শিক্ষা ও বিবেকের মাধ্যমে।- ধর্মের মাধ্যমে নয়।
ধর্ম ও কুসংস্কার দূর করার উপায়
ধর্মীয় কিংবা ধর্ম সম্পর্কিত কোন প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেন, দান, অনুদান, যাকাত, ফেতরা, সদকা, মানত কিংবা কোন প্রকার সাহায্য নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের সরকারী যেকোন পরিষেবা বন্ধ করতে হবে।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী দূর: নারীর আত্ননির্ভরশীলতা, উচ্চতর শিক্ষা, সমান সম্পত্তি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, সার্বিক নিরাপত্তাসহ নারীর যাবতীয় বৈষম্য দূর করলেই ধর্ম এবং কুসংস্কারের মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়বে। প্রচলিত ধর্মগুলো মূলত পুরুষতন্ত্রের উপর টিকে আছে। এটি ভেঙ্গে গেলেই ধর্ম ভেঙ্গে পরবে।
বাকস্বাধীনতা, ন্যয়বিচার, জননিরাপত্তা ও কল্যাণরাষ্ট্র কায়েম করা।
সবসময় ইতিবাচক থাকা: কুসংস্কার বন্ধ করার আরেকটি ভাল উপায় হল আপনি সারাদিন ইতিবাচক শক্তি নিয়ে কাজ করুন। যদি আপনার মুখে হাসি থাকে এবং ভবিষ্যতের জন্য আশা থাকে তাহলে আপনি আচার-অনুষ্ঠান বা কুসংস্কারের সন্ধানে থাকবেন না।
চন্দ্রগ্রহন, সূর্য গ্রহন সংক্রান্ত কুসংস্কার দূর করার জন্য শিক্ষার্থীদের একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের ধারণা শেখাতে শিক্ষকদের নির্দেশিকা গাইড ও রাষ্ট্রের চাপ থাকতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে মিডিয়ার ব্যবহার করতে হবে। শিশুদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মেজাজ জাগ্রত করতে বিজ্ঞান ভিত্তিক বিনোদন এবং পিতামাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শিক্ষা শেষে কোন শিক্ষার্থী যাতে কোন ধরণের ধর্ম কিংবা কুসংস্কারে বিশ্বাসী না হয় সেই ধরণের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির রাজনীতিতে এবং শিশুদের সামাজিকীকরণ রোধে প্রতিনিধিত্বকারী সরকার এবং শিক্ষা বোর্ডের শক্তিশালী ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন এবং বাস্তবমূখী শিক্ষা সিলেবাস বাস্তবায়ন করতে হবে।
কুসংস্কারের নামে বাজারের ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজ, জ্বীনে ধরা, ভূতে ধরা, ভূয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অভিযান অব্যহত রাখতে হবে। তাদের যাতীয় রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে পাঠ্যপুস্তক, রেডিও, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যপক প্রচার চালাতে হবে।
আপনার প্রাত্যাহিক আচরণে যুক্তি নির্ভর পছন্দ থাকতে হবে। যেমন, মাঝে মাঝে এক্সপেরিমেন্ট করুন। সবাইকে নিয়ে একটি কালো বিড়াল পোষা বা সিঁড়ির নীচে তার হাঁটা আবিস্কার করুন। যে আপনাকে বা কাউকে একাকী ভয় দেখায়।
চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের জন্য উদ্ভিদ , প্রাণীর বা মানুষের কোন স্বাস্থ্য / পরিবেশ পরিবর্তন হয় না।
এ রকম কুসংস্কারগুলো উদ্ঘাটন করে প্রচারের ব্যবস্থা করুন।কোনো ব্যক্তিকে জ্বীনে ধরা বা ভূতে ধরা একটি সাইকোলজিক্যাল সমস্যা। -এটি প্রচার করুন।
ধর্ম ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইতিহাস, বিজ্ঞান, গণিত ও যুক্তির আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে বুঝান- অসাধ্য ও অর্জনযোগ্য বিজ্ঞান নিজেই একটি সুখকর শুরু ও একটি তিক্ত সমাপ্তি। যেখানে ধর্মের কিংবা কুসংস্কারের শুরু বা শেষ নেই। বিজ্ঞান নিজেই একটি সম্পূর্ণ বাস্তবতা। বিজ্ঞান, গণিত এবং যুক্তি মানুষের প্রশ্ন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আপনি সবার ভেতর এটি তৈরীর করার কাজ করুন।
মনবতাবাদকে শক্তিশালী করুন: যেকোন গোড়ামীর বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতা, ন্যয়বিচার ও বৈষম্যের স্থানে “মানবতাবাদ” প্রতিষ্ঠা করুন। এটি ধর্শ ও কুসংস্কারের সবচেয়ে বড় শত্রু।
মানুষের চেতনা থেকে “ভয়”কে বা আতঙ্ককে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে হবে। আমরা এখন ভয় বা নম্রতা ছাড়াই বাস করতে পারি। কেননা, বিজ্ঞানের ফলাফল, সমীকরণ এবং এর ধ্রুবক আমাদের সাথে আছে। শিক্ষিত লোকেদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং তারা অন্যদেরকে এই কুপ্রথা সম্পর্কে সচেতন করতে পারে।
বিভিন্ন ধারণা এবং জীবনযাত্রার জন্য উন্মুক্ত নয় এমন লোকদের এড়িয়ে চলুন কিংবা এদের সাথে খুব বেশি সময় ব্যয় করবেন না। যারা ব্যপারে আপনার থেকে আলাদা তারা আপনার ক্ষতি করতে পারে।
রাষ্ট্রের হস্থক্ষেপ: কুসংস্কার দূর করতে রাষ্ট্রের বৃহত্তর প্রচেষ্টা বা বিশাল সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, সতীদাহ প্রথাকে ‘প্ররোচনা’ দ্বারা নির্মূল করা হয়নি বরং সমাজ সংস্কারকদের ব্যাপক প্রচেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হয়েছে।
“উচ্চতর ভয়” ধর্ম ও কুসংস্কারকেও ভীত করে দেয়। যেমন আমরা বিগত কোভিড-১৯ এ ভয় এবং সতর্কতা দেখেছি। তখন লক ডাউনের সময় পবিত্র তীর্থস্থানগুলি জনশূণ্য হয়েছিলো। ভয় যেহেতু ধর্ম ও কুসংস্কারের কারণ সেহেতু তারচেয়ে উচ্চতর ভয় আবার সেগুলোকে শূণ্য করে দিতে পারে। আমাদের উচিত ধর্ম ও কুসংস্কারের অযৌক্তিক, নিষ্ঠুর ও অবৈজ্ঞানিক যুক্তিগুলি উচ্চতর ভয় এবং সতর্কতার সাহায্যে ধর্ম ও কুসংস্কারকে শূণ্য করে দেওয়া। যাতে মানবজাতি এগুলো এড়িয়ে চলতে পারে।
উপসংহার
বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংস্কৃতির মানুষের জীবনে ধর্ম ও কুসংস্কারের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী আট-দশ জনের বেশি লোক একটি ধর্মীয় কিংবা কুসংস্কারের গোষ্ঠীর সাথে পরিচিত। তবে এটাও সত্য যে, যাদের কোনো ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই এমন লোকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
কুসংস্কারের মূল উৎস হলো ভয় এবং ধর্মের উৎসও ভয়। ভয় হল ধর্ম ও কুসংস্কারের প্রধান উৎস এবং নিষ্ঠুরতারও অন্যতম উৎস। যারা এই ধর্ম ও কুসংস্কারের পুরানো অভ্যাস চর্চা করে চলে তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা সহজ নয়। এজন্য শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। মানুষের ভেতর ইতিহাস, বিজ্ঞান, গণিত ও যুক্তির চর্চা বাড়াতে হবে। যাতে মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে।
কুসংস্কার, ধর্ম এবং অন্ধ বিশ্বাস পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনা। কুসংস্কারে বিশ্বাস করা ভালো নয়। যারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন তারা সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। তারা অজ্ঞতায় বাঁচে অজ্ঞতায় মরে।
আপনার মতামত জানানঃ