রোববার রাজধানীর গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কয়েকটি দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৭টি দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলিও।
বৈঠক শেষে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদেরকে জানান, বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে বিদেশি কূটনীতিকদের জানানো হয়েছে।
ওদিকে, গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি জানিয়েছিলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই নির্বাচন ঘিরে আগ্রহ শুধু দেশের ভেতরেই নয়, সারা বিশ্বেই তৈরি হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউ বাংলাদেশে তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাতে চায়।”
এমন পরিস্থিতিতে সচেতন মহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে ইইউ কি পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাবে?
বিষয়টি অনেকটা খোলাসা করে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেছেন, আসছে নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাতে প্রস্তুত। বিএনপিকে বলেছি ইইউ এর হাই রিপ্রেজেনটেটিভ জানিয়েছে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।
আর, এটা তখনই হবে যখন নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক, নিশ্চিত হবে বিএনপির অংশগ্রহণ। আর বিএনপি নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে যা সবারই জানা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় দলটি।
বর্তমান সরকারের কারণে তরুণ প্রজন্ম ভোট কি জিনিস ভূলে গেছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া, বিনপির কোনভাবে নির্বাচন করা উচিত হবে না।
পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে চায় ইইউ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
gt বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) সচিবালয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলির নেতৃত্বে ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতরা সম্মিলিতভাবে এই প্রস্তাব দেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
বৈঠকের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাতে চান। আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন যে, পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো আপত্তি নেই, সেটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন।’
এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার বলে জানান তিনি। বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে কত জনকে আনবে, কত জনকে আনবে না। আমার মনে হয় নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে দ্বিমত করবে না।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষক কেন দরকার হয়?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যারা গণতন্ত্র এবং নির্বাচন বিষয়ে গবেষণা করেন, তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করেছেন৷ যদিও সবাই এটা স্বীকার করেন যে, একমাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্ত তাঁরা এটা জোর দিয়ে বলেন যে, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি অন্যতম দিক৷
ফলে ১৯৭০-এর দশক থেকে দেখা গেছে যে, এমনকি স্বৈরশাসকরা সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করে নিজেদের গণতন্ত্রী বলে দেখানোর চেষ্টা করেন৷ সেই সময়েই গবেষকরা বলেন যে, কেবল নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয়, সেগুলো সুষ্ঠু কিনা, অংশগ্রহণমূলক কিনা, সেটাও নিশ্চিত করা দরকার৷ দেখা দরকার নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য কিনা৷ এই পটভূমিকায়ই নির্বাচনের সততার বা ইন্টিগ্রিট্রির প্রশ্নটি গুরুত্ব লাভ করে৷
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে তাতে বেশি ভোটার অংশ নেন৷ আলবার্টো সিম্পসারের ‘হোয়াই গভর্নর্মেন্টস অ্যান্ড পার্টিজ ম্যানিপুলেট ইলেকশন্স: থিউরি, প্র্যাকটিস অ্যান্ড ইমপ্লিকেশন্স’ (ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৪)-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে৷
বিপরীতে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে তাতে ভোটারদের অংশগ্রহণ থাকে না এবং ভোটাররা নির্বাচনের পরে আন্দোলন ও বিক্ষোভে অংশ নেয়, যে বিষয়ে গবেষণার মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে, পীপা নরিস, রিচার্ড ফ্রাঙ্ক, ফেরান মার্টিনেজ ই কোমা’র গবেষণা, ‘কন্টেনশাস ইলেকশন্স: ফ্রম ভোটস টু ভায়োলেন্স’, যা তাদের সম্পাদিত গ্রন্থ ‘কনটেনশাস ইলেকশন্স: ফ্রম ব্যালটস টু বেরিকেডস’এ প্রকাশিত হয়েছে (রাটলেজ, ২০১৫, পৃষ্ঠা ১-২১)৷
এই বিবেচনা থেকেই তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ধারণা এবং সেই পদক্ষেপের সূচনা হয়৷
প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ করা দরকার যে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ধারণার উদ্ভব হয় ১৯৮৬ সালে, ফিলিপাইন্সে৷ ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যান্ড মার্কোস যাতে নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে না পারেন সেই জন্যে ন্যাশনাল সিটিজেন্স মুভমেন্ট ফর ফ্রি ইলেকশন্স (এনএএমএফআরএএল-নামফ্রেল)-এর প্রায় পাঁচ লাখ স্বেচ্ছাসেবী নাগরিকের ভোটাধিকার রক্ষায় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নেন এবং যে সাফল্য অর্জন করেন তা-ই সারা দুনিয়ায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ধারা তৈরি করে৷ ক্রমান্বয়ে তা আন্তর্জাতিক রূপ নেয়৷
২০১২ সালে জাতিসংঘে এই ধরনের সংগঠনগুলোর বৈশ্বিক কাঠামো থেকে পর্যবেক্ষণের নীতিমালা ও আচরণবিধি গৃহীত হয়৷ ১৯৮৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ৮৪টিরও বেশি দেশে ২ শতাধিক সংগঠন তৈরি হয়; আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোও এর সঙ্গে যুক্ত হয়৷
যেসব ক্ষেত্রে নির্বাচনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবার আশঙ্কা থাকে, সেখানেই তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বিদেশি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির তাগিদ তৈরি হয়৷ নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বা যেসব দেশ গণতন্ত্রে উত্তোরনের পথে, সেখানে এই পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতির প্রয়োজন দেখা দেয়৷
গবেষকরা বলছেন যে, সেসব দেশে নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না বা যেসব দেশে ‘হাইব্রিড রেজিম’ (দৃশ্যত গণতান্ত্রিক, কিন্ত কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক) উপস্থিত, সেখানে ক্ষমতাসীনরা ফলাফল বদলাতে পারে, আবার বিপরীতক্রমে পরাজিতরা নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন৷ এতে করে গোটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ই ভণ্ডুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷
বিদেশিদের দ্বারা পর্যবেক্ষণের হার বৃদ্ধি পায় ১৯৯০-এর পরে৷ এর আগে মাত্র ৫টি দেশে পর্যবেক্ষণ মিশনের ইতিহাস রয়েছে৷ কিন্ত ১৯৯০ থেকে ২০১০ এর মধ্যে তার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রতি পাঁচটি নির্বাচনের চারটিতে৷ এইসব পর্যবেক্ষণের ফল এবং গবেষকদের বিশ্লেষণ হচ্ছে এই যে, ভোট জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হবে- এই ভয় জালিয়াতি থেকে বিরত রাথতে সক্ষম হয়, পরাজিতরা ফলাফল মানতে আগ্রহী হয় এবং নির্বাচনে বিজয়ীদের বৈধতা তৈরি হয় ( এই বিষয়ে আলোচনা দেখুন, সুসান হাইড ও নিকোলে মারিনভ, ‘ইনফরমেশন অ্যান্ড সেলফ-এনফোরসিং ডেমোক্রেসিঃ দ্য রোল অব ইন্টারন্যাশনাল অবজারভার’, ইন্টারন্যাশনাল অর্গ্যানাইজেশন, বর্ষ ৬৮, সংখ্যা ২, পৃষ্ঠা ৩২৯-৫৯)৷
এসডব্লিউএসএস/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ