আজ আমরা এতো আধুনিক সভ্যতায় বসবাস করতে পারছি, তার জন্য ইলেকট্রিসিটির অবদান সবচেয়ে বেশি। মূলত এই বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর থেকে বিভিন্ন জিনিসের আবিষ্কার দ্রুতগতিতে হয়েছিল।
ইলেকট্রিসিটি আবিষ্কারের চেষ্টা কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুধু গত সহস্র বছরেই নয়, বিদ্যুৎ নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। কারণ বিদ্যুতের উপর নির্ভর করে যেসব যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবকয়টিই ইতিহাসের অন্যতম সেরা আবিষ্কার বলে বিবেচিত।
তবে বিদ্যুৎ কিন্তু কেউ আবিষ্কার করেনি, কারণ এই বিদ্যুৎ আগে থেকেই পৃথিবীতে ছিল। আবিষ্কার করা হয়েছে সেই পদ্ধতি যার সাহায্যে এই ইলেক্ট্রিসিটিকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে।
আজ থেকে ২৬০০ বছর আগে গ্রিকের এক গণিতজ্ঞ, যার নাম ছিল থেলিস। তিনি দেখেন রেশমের উপরে বা বিড়ালের পশমের উপরে কোনো বস্তুকে কয়েকবার ঘষলে তাতে ছোট ছোট কয়েকটি কাগজ টুকরা আটকে যাচ্ছে। তবে সেই সময় থেলিস এটিকে কোনো কালো জাদু ভাবেন। ফলে এই নিয়ে তিনি আর কোনো গবেষণা করেন নি।
এরপর কেটে যায় দুই হাজার বছর। ১৬ শতকে ইংল্যান্ডের এক ডাক্তার, যার নাম ছিল উইলিয়াম গিলবার্ট। তিনি ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের চিকিৎসক ছিলেন। উইলিয়াম গিলবার্ট লক্ষ্য করেন শুধুমাত্র রেশম বা বিড়ালের পশম নয়, কোনো একটি বস্তুর সঙ্গে অন্য একটি বস্তুকে ঘষলে তার মধ্যে একটি আকর্ষণের ক্ষমতা চলে আসে। যেমন ধরুন, একটি কলম যদি আমাদের চুলে বারবার ঘষা হয় এবং তারপর সেটি কয়েকটি ছোট কাগজের টুকরোর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সেই কাগজের টুকরাগুলো কলমের সঙ্গে আঁটকে যায়। তখন উইলিয়াম গিলবার্ট এই শক্তির নাম রাখেন ইলেকট্রিসিটি।
এভাবে ধীরে ধীরে ইলেকট্রিসিটির বিষয়ে মানুষের ধারণা আসে। সেই সময় গিলবার্ট এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, যার সাহায্যে এটা বোঝা যেতো যে কোনো বস্তুর মধ্যে ইলেকট্রিসিটি আছে নাকি নেই। তিনি তার আবিষ্কৃত এই নতুন যন্ত্রের নাম রাখেন ইলেকট্রোস্কোপ। আর এটি পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রথম যন্ত্র ছিল, যা দিয়ে ইলেকট্রিসিটি মেজারমেন্ট করা যেতো।
উইলিয়াম গিলবার্টের পর বহু বিজ্ঞানী ইলেকট্রিসিটির উপর কাজ করেছিলেন। কিন্তু তেমন একটা সফলতা আসেনি। ১৮০০ শতকে আমেরিকার একজন মহান বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ইলেকট্রিসিটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বেঞ্জামিন একটা সময়ে তার সব সম্পত্তি বিক্রি করে ইলেকট্রিসিটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন।
১৭৫২ সালের জুন মাসে একটি বৃষ্টির দিনে যখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, সেই সময় বেঞ্জামিন একটি ঘুড়ি ওড়ান। তিনি সেই ঘুড়ির সুতার সঙ্গে একটি লোহার চাবি বেঁধে দেন। সেই সময় একটি বিদ্যুৎ তার ঘুড়ির উপরে এসে পড়ে এবং সেখান থেকে ইলেকট্রিসিটি সুতার মাধ্যমে প্রথমে লোহার চাবিতে আসে এবং তারপর বেঞ্জামিনের হাত পর্যন্ত পৌঁছায়। আর এভাবেই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হয়ে যান ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কর্তা।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ইলেকট্রিসিটি আবিষ্কার করে ফেললেও এই ইলেকট্রিসিটিকে কাজে লাগানোর পদ্ধতি তখনও আবিষ্কার হয়নি। এরপর ১৭৯১ সালে দুই বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা এবং লুইগি গ্যালভানি একটি পরীক্ষা করেন। যেখানে একটি মৃত ব্যাঙের দুইটি পায়ে দুইটি আলাদা ধাতু সংস্পর্শ করতেই সেই মৃত পা দুইটি নড়ে উঠে। তখন লুইগি গ্যালভানি এর নাম রাখেন ‘অ্যানিম্যাল ইলেকট্রিসিটি’।
তবে তার বন্ধু আলেসান্দ্রো ভোল্টা এই বিষয়ে সহমত ছিলেন না। তিনি বলেন, এটি ঐ দুইটি আলাদা ধাতুর কারণেই হয়েছে। তাই একে ‘মেটাল ইলেকট্রিসিটি’ বলা উচিত। এরপর ১৭৯২ সালে আলেসান্দ্রো ভোল্টা একাই একটি গবেষণা করেন এবং ১৮৫৭ সালে তিনি পৃথিবীর প্রথম ব্যাটারি আবিষ্কার করেন। তিনি কয়েকটি আলাদা আলাদা ধাতুর ব্যবহার করে এই ব্যাটারি তৈরি করেছিলেন।
আলেসান্দ্রো ভোল্টা জিংক এবং কপারের কতগুলো ধাতু ও পাতকে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডে ভিজিয়ে এই ব্যাটারি আবিষ্কার করেছিলেন। আলেসান্দ্রো ভোল্টার এই আবিষ্কারের পর ইলেকট্রিসিটি নিয়ে গবেষণা দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে। কারণ এর আগে ইলেকট্রিসিটির একটি নির্দিষ্ট সোর্স পাওয়া সম্ভব ছিল না। ভোল্টার আবিষ্কৃত এই ব্যাটারি থেকে পাওয়া ইলেকট্রিসিটিকে ‘ডিসি কারেন্ট’ বলা হতো।
এরপর ১৮২০ সালে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড নামের এক বিজ্ঞানী তার গবেষণায় লক্ষ্য করে যখন একটি ধাতব ও তারের মধ্য থেকে ইলেকট্রিসিটি যায়, তখন সেই তারের আশেপাশে একটি চুম্বকীয় শক্তি তৈরি হয়। এই ঘটনার এক বছর পর ১৮২১ সালে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে এই চুম্বকীয় শক্তির উপর কাজ করে একটি মোটর আবিষ্কার করেন। যা ‘ডিসি মোটর’ নামে পরিচিত।
তবে এখনো পর্যন্ত ইলেক্ট্রিসিটি শুধুমাত্র একটি গবেষণার বিষয় হিসেবেই সীমিত ছিল। এরপর ১৮৭৯ সালে আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন একটি ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কার করেন। আর এর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ ইলেকট্রিসিটির ব্যবহার শুরু করে দেয়। সেই সময় এডিসন একটি ইলেকট্রিসিটি তৈরি করার কোম্পানি খুলেন এবং সেখানে তিনি ডিসি জেনারেটরের ব্যবহার করতেন।
তবে এই ডিসি জেনারেটরের একটি সমস্যা ছিল। এর সাহায্যে উৎপন্ন হওয়া ইলেকট্রিসিটি ধাতব ও তারের সাহায্যে দুই থেকে তিন কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর এই কারণে প্রতি দুই থেকে তিন কিলোমিটারের দূরত্বের পর একটি করে ইলেকট্রিসিটির প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি বসানোর প্রয়োজন হতো।
সেই সময়ে এডিসনের কোম্পানিতে আরেকজন বিজ্ঞানী কাজ করতেন। যার নাম নিকোলা টেসলা। তিনি সেই সময় এডিসনের কোম্পানিতে একটি নতুন ধরনের ইলেকট্রিসিটি আবিষ্কারের উপর কাজ করছিলেন। তিনি এই নতুন ধরনের ইলেকট্রিসিটির কথা এডিসনকে জানান। তবে এডিসন এতে সম্মতি জানান নি। তিনি ভাবেন, এই আবিষ্কার সফল হলে তার ডিসি কারেন্টের বিজনেস নষ্ট হয়ে যাবে।
এডিসন তখন নিকোলা টেসলাকে বলেন, ‘এই এসি ইলেকট্রিসিটি খুবই বিপজ্জনক। তুমি শুধুমাত্র ডিসি কারেন্টের উপরেই কাজ করো।’ কিন্তু নিকোলা টেসলা চেয়েছিলেন এমন একটি উপায় বের করতে যার সাহায্যে ইলেকট্রিসিটি বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে। এমনকি সস্তা হবে। যাতে সাধারণ মানুষ এই ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করতে পারে।
এডিসন যখন তাকে এই গবেষণা করতে বারণ করেন, তখন নিকোলা টেসলা এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে দেন এবং তিনি নিজেই গবেষণা শুরু করেন। অবশেষে ১৮৮৭ সালে নিকোলা টেসলা এসি জেনারেটর এবং এসি মোটর আবিষ্কার করেন। আর এর ফলে ইলেকট্রিসিটি বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল এবং এরপর থেকে ইলেকট্রিসিটির ব্যবহার বাড়তে থাকে এবং নতুন নতুন ইলেকট্রিক যন্ত্রের আবিষ্কার হয়। বর্তমানে আমাদের বাসাবাড়িতে যেই ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করা হয়, তা নিকোলা টেসলার আবিষ্কৃত এসি কারেন্ট।
এসডব্লিউএসএস১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ