দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিতর্কের মধ্যেই অবশেষে ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধায় দেশে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ৩৮ মিনিটে নতুন উপকেন্দ্রের মাধ্যমে সেখান থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, প্রথমে কিছু কিছু করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ধাপে ধাপে এটি বাড়বে। আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৭৪৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট পুরোদমে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশে (পিজিসিবি) ও আদানি পাওয়ার সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে।
এ তিন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর আগে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার হয়। এরপর পরীক্ষামূলক উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক থাকলে বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ শুরু হবে। বাণিজ্যিক সরবরাহের দিন থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল হিসাব করা হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দীন জানান, ভারতের ঝাড়খন্ডের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গতকাল সন্ধা ৭টা ৩৮ মিনিট থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়েছে।
এই বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী মনাকষা থেকে রহনপুর হয়ে বগুড়া পর্যন্ত ১৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং বগুড়ায় ৪০০/২৩০ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সঞ্চালন লাইন তৈরি হলেও উপকেন্দ্রের কাজ শেষ হতে দেরি হয়ে যায়। এ কাজ করছে পিজিসিবি। একটি অস্থায়ী উপকেন্দ্র ব্যবহার করে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত ১৬ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এরপর মাঝেমধ্যে ১০০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট সরবরাহ করা হয়েছে। এখন উপকেন্দ্র তৈরি হয়ে গেছে।
পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী বলেন, বুধবার রাতেই সঞ্চালন লাইন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পুরোপুরি তৈরি বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন যেকোনো মুহূর্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে।
আদানি গ্রুপের একটি সূত্র বলছে, তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। অল্প অল্প করে সরবরাহ বাড়ানো হবে। আগামী চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই প্রথম ইউনিট থেকে পুরোদমে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়ে যাবে।
তবে পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একটি বড় কেন্দ্র চাইলেই হুট করে উৎপাদন শুরু করতে পারে না। একটু একটু করে ধাপে ধাপে উৎপাদন বাড়ানো হয়। এর মধ্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে। কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি শুরু হয়নি। প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছে।
আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। চুক্তিটিকে একপেশে আখ্যা দিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলছেন এর ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আদানি বিপুলভাবে লাভবান হবে। ভারতীয় কোম্পানির পীড়াপীড়িতে এই চুক্তি হয়েছিল বলে সে সময় সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছিল।
আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা এই চুক্তিকে অসম চুক্তি আখ্যায়িত করে অবিলম্বে তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। কেউ কেউ চুক্তিটি পর্যালোচনার দাবি জানিয়েছেন। চুক্তিটি নিয়ে ভারতেও সমালোচনা হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে পিডিবি আদানিকে চিঠি দিয়েছিল চুক্তি পর্যালোচনার জন্য। আদানির প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে ঘুরে গেছে। আগামী ১৩ মার্চ পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের ভারতে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। যদিও কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল ২৬ মার্চ।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকতারা বলছেন, আদানির সঙ্গে ক্রয় চুক্তি বাতিল কিংবা পর্যালোচনা করার সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
গত মাসে আদানি তাদের কেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম টনপ্রতি ৪০০ ডলার দাবি করেছে। সে হিসেবে কেন্দ্রভাড়াসহ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ২৫ টাকারও বেশি। অথচ আদানির কয়লার চেয়ে উন্নতমানের কয়লা দিয়ে পটুয়াখালির পায়রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে যেখানে ব্যয় ১৪-১৫ টাকা। দেশের বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে এই কেন্দ্রে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী দেশীয় বিদ্যুতের দাম কম হলেও আদানির বিদ্যুৎ আমদানি করতে হবে সবার আগে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পিডিবি গড়ে প্রতি ইউনিট ৩.৯৬ টাকা দরে বিদ্যুৎ কিনেছে। আর ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম পড়েছে ৫.৫২ টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১৭-১৮) এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪.৫২ ও ৫.৮৭ টাকা।
বর্তমানে ভারত থেকে সরকার ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিকৃত এ বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম পড়েছে ৬.১১ টাকা। পিডিবি উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ব্যয় হয়েছে ৫.০২, বেসরকারি খাতের আইপিপি কেন্দ্রে ১১.৫৫, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৯.৮০, গ্যাসভিত্তিক সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় হয়েছে ৪.৭৫ টাকা। সব মিলে গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ৮.৮৪ টাকা।
সিডনিভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক টিম বাকলি গত ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের বাজারের চেয়ে আদানির বিদ্যুতের দাম পাঁচ গুণের বেশি পড়বে। এমনকি বিশ্ববাজারে কয়লার দাম আগের পর্যায়ে ফিরলেও অভ্যন্তরীণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে অন্তত ৩৩ শতাংশ বেশি দামে এ বিদ্যুৎ কিনতে হবে বাংলাদেশকে। আদানির সঙ্গে করা চুক্তিটিকে প্রতারণা বলে আখ্যায়িত করেছেন তিনি।
এসডব্লিউএসএস/০৯২৫
আপনার মতামত জানানঃ