সেলফোনের জনক আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার মনে করেন, বর্তমানে যেসব মোবাইল ফোন মানুষ হাতে নিয়ে ব্যবহার করে, একসময় এগুলোই ডিভাইস আকারে ত্বকের নিচে সংযুক্ত থাকবে। গেল সোমবার স্পেনের বার্সেলোনায় মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন কুপার।
১৯৭৩ সালে মোটরোলা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রথম সেলফোন উদ্ভাবন করে গোটা বিশ্বের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নতুন বিপ্লব নিয়ে আসেন মার্টিন কুপার। অনেকের কাছে তিনি মার্টি কুপার নামেও পরিচিত।
কুপারের ভাষ্যে, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষেত্রে দেখা যাবে তাদের কানের ত্বকের নিচেই ডিভাইস আকারে ফোন সংযুক্ত থাকবে।” এমনকি এসব ডিভাইস আলাদা চার্জ দেওয়ারও কোনো প্রয়োজন হবে না বলে মতামত ব্যক্ত করেন কুপার।
কুপার বলেন, “আপনার দেহই একটা পারফেক্ট চার্জার। আপনি যখন খাবার খান, আপনার দেহে শক্তি উৎপন্ন হয়। তাই নয় কি? আর এই ছোট্ট ইয়ারপিসটা চালাতে খুবই কম শক্তির প্রয়োজন হবে।”
কুপারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আভাস পাওয়া যায় যে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের শরীরে শক্তিশালী মাইক্রোচিপ এবং সেন্সর সংযুক্ত করা হতে পারে। কম্পিউটারকে মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে ইলন মাস্কের নিউরালিংকের মতো একাধিক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান।
মার্টিন কুপার বলেন, বর্তমানকালের স্মার্টফোনগুলোতে বহু অ্যাপ্লিকেশন থাকার ফলে এগুলো বেশ জটিল হয়ে উঠেছে যা মানুষের চেহারার বক্রতার (কার্ভেচার) সঙ্গে খাপ খায় না।
“আমি যখন কোনো ফোনকল করি এবং সাথে কোনো ইয়ারপিস থাকে না, তখন এই সমতল স্ক্রিনের বস্তুটাকে তুলে কানের পাশে ধরতে হয়; কথা বলার সময় একটা অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে আমার বাহু তুলে ধরে রাখতে হয়।”
গত কয়েক বছর ধরেই স্মার্টফোনের বাজার স্থবির হয়ে পড়েছে এবং এ শিল্পের বাজারে একটি বিষয় অনুভূত হচ্ছে যে, নির্মাতারা নতুন নতুন উদ্ভাবনী ডিজাইন নিয়ে আসতে হিমশিম খাচ্ছেন।
মোবাইল ফোন ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তারের ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি থেকে শুরু করে গোপনীয়তা লঙ্ঘন পর্যন্ত নানাবিধ সমস্যা তৈরি হয়েছে। নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির অপকারিতাগুলো স্বীকার করে নিয়ে কুপার বলেন, ‘গোপনীয়তার বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এখানে, আসক্তিও একটি সমস্যা।”
তবে ভবিষ্যতের জন্য আশার বাণীই শুনিয়েছেন কুপার। তিনি মনে করেন, আগামী দিনগুলোতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে প্রযুক্তি সবচেয়ে সেরা সুবিধা দিবে মানুষকে।
মার্টিন কুপার বলেন, আমার মনুষ্যজাতির উপরে অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। আমি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করতে পারি যে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কি কি অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে আমাদের। কোনো না কোনোভাবে মানুষ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছেই।
৯৪ বছর বয়সী এই ইঞ্জিনিয়ার আরও বলেন, “মানুষ এখন ভালোভাবেই জীবনযাপন করছে, তাদের আয়ু বেড়েছে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তারা এখন বেশি সম্পদশালী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। আমাদের জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই। কিন্তু সহজ কথায় বলতে গেলে, মানবসভ্যতার অগ্রগতি হচ্ছে।”
গত সপ্তাহে মার্টিন কুপারের সিক্সথ এভিনিউতে প্রথম ফোনকল করার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এমডব্লিউসিতে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ওয়াল স্ট্রিট’-এ দেখানো মোটরোলা ডিওয়াইএনএটিএসি৮০০০এক্স মোবাইল ব্যবহার করে তিনি ‘এটি অ্যান্ড টি’তে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জোয়েল এস. এঞ্জেলকে প্রথম ফোনকলটি করেছিলেন।
কুপার জানান, বর্তমানে মোবাইল যেরকম এক ধরনের পোর্টেবল কম্পিউটার হয়ে উঠেছে এমনটা কখনো কল্পনাই করেননি তিনি।
“৫০ বছর আগের সময়টা বলতে গেলে বেশ সেকেলে ছিল। ইন্টারনেট ছিল না, কোনো লার্জ-স্কেল ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট ছিল না, কোনো ডিজিটাল ক্যামেরাও ছিল না। আমাদের ফোনটাই যে কোনো একদিন ক্যামেরা এবং এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে উঠবে সেরকম চিন্তা কখনো আমাদের মাথায়ই আসেনি।”
কুপার আরও যোগ করেন, “আমরা জানতাম যে যোগাযোগ স্থাপন করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একদিন মজা করেই বলছিলাম যে, একসময় দেখা যাবে আপনাকে জন্মের পরেই একটা ফোন নাম্বার দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ফোন কল না ধরলেই আপনি শেষ! আমরা জানতাম যে একদিন প্রত্যেকটা মানুষের হাতেই মোবাইল ফোন থাকবে। আর এখন তা সম্পূর্ণ সত্য হওয়ার পথে।”
কুপারের ভাষ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার চাইতেও মোবাইল ফোন সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা বেশি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ব্যক্তিগত সেলফোন ব্যবহার করে। মোবাইল ফোন আসলে মানুষেরই একটা বর্ধিত অংশ হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউএসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ