ডিপ ফেক পর্ন হচ্ছে এমন এক ধরনের পর্নোগ্রাফিক ভিডিও যাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন নারীর দেহের সাথে আরেকজন নারীর মুখ যোগ করে দেয়া হয়।
ডিপফেকের ওপর নজরদারি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সেন্সিটি এআই। তারা বলছেন, তাদের গবেষণায় দেখা যায় ৯৬% ডিপফেক যৌন ছবিই সম্মতির ভিত্তিতে নেয়া হয়নি, এবং এর শিকারদের ৯৯%ই নারী।
অধ্যাপক ম্যাকগ্লিন বলছেন, মেয়েদের এই নিগ্রহের শিকার হবার সম্ভাবনাই বেশি, এবং এগুলো করে থাকে প্রধানত পুরুষরাই। নারীর বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধকে গুরুত্বের সাথে নেবার রেকর্ড সমাজের নেই, এবং অনলাইন অপরাধকে প্রায়ই তুচ্ছ বা সাধারণ ব্যাপার বলে মনে করা হয়।
প্রামাণ্যচিত্র
ডিপ ফেক-এর শিকার হয়েছেন যে নারীরা তাদের নিয়ে ‘মাই ব্লন্ড জিএফ’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন রোজি মরিস। ছবিটিতে এই নারীরা বর্ণনা করেছেন, এই ডিপ ফেক পর্ন কীভাবে তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
হেলেন মর্ট একজন লেখিকা। রোজি মরিসের তৈরি প্রামাণ্যচিত্র “মাই ব্লন্ড জিএফ” ছবিতে তিনি একজন মূল চরিত্র। একদিন তিনি ঘটনাচক্রে আবিষ্কার করেন যে একটি পর্ন ওয়েবসাইটে তার ‘ডিপ ফেক’ ছবি বের হয়েছে।
ডিপ ফেক বা ভুয়া পর্ন হচ্ছে এমন এক ধরনের পর্নোগ্রফিক ছবি বা ভিডিও, যাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন নারীর দেহের সাথে আরেকজন নারীর মুখ যোগ করে দেয়া হয়।
হেলেনের ধারণা, তার একটি পুরোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো ব্যবহৃত হয়েছে পাবলিক ডোমেইনে থাকা তার বেশ কিছু ছবি, যা পেশাদারদের তোলা।
তার বয়স যখন ১৯ থেকে ৩২, সেই সময়কালের অনেকগুলো ছবি এই ডকুমেন্টারিতে দেখাচ্ছিলেন তিনি। এতে দেখা যায়, বিয়ে এবং অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানে তার হাসিমুখের ছবি। আর কিছু ছবি আছে যা তিনি গর্ভবতী থাকার সময় তোলা। এগুলোই হচ্ছে সেই ছবি যেগুলো ডিজিটাল সম্পাদনার মাধ্যমে জুড়ে দেয়া হয়েছে অন্য কিছু নারীর ছবির সাথে।
“ছবিতে দেখা যায় একজন নারী, তিনি বিছানার কিনারায় বসে আছেন। তার মুখমন্ডলটি আমার, কিন্তু মুখ আমার নয়। তিনি একটি যৌন কাজ করছেন….।”
তিনি বলছেন, মহিলাটির মুখের সাথে বাকি দেহের রঙের গরমিল থেকে বোঝা যায় যে এটাতে একজনের দেহে আরেকজনের মুখ জুড়ে দেয়া হয়েছে।
“এই মহিলাটির গায়ের চামড়ার রং আমার চেয়ে অনেক বেশি রোদে পোড়া, তবে আমার গায়ে যে উল্কি তার গায়ের উল্কিও হুবহু এক।”
“মহিলাটি কিছু একটা টেক্সটের দিকে তাকাচ্ছেন, – এটা হচ্ছে ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে তাকে অপমান করার আমন্ত্রণ, এবং সেই ব্যক্তিটি হচ্ছি আমি। ”
ওই টেক্সট বার্তায় হেলেনকে বর্ণনা করা হচ্ছে “মাই ব্লনড্ জিএফ”, যার অর্থ “আমার সোনালি চুলের প্রেমিকা।”
ট্রমার শিকার
ডিপফেক ছবির শিকার হওয়া কারো যে ‘ট্রমা’ বা মানসিক আঘাতের অভিজ্ঞতা হয় তা খুবই বাস্তব।
ইমেজ-ভিত্তিক যৌন অত্যাচারের বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ডারাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লেয়ার ম্যাকগ্লিন। তিনি বলছেন, এর প্রভাব জীবনকে বিপর্যস্ত এবং ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়।
“অনেক ভিক্টিমের একারণে সামাজিক বিভাজন ঘটে যায়। তাদের জীবন ওই ঘটনার ‘আগে’ ও ‘পরে’ এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পেশাগত, ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত বা সার্বিকভাবে ভালো থাকা-না-থাকা সবকিছুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।”
ছবিতে হেলেন বলেন, “আমার মনে হতো যেন ওই ছবিগুলো আসল, যারা তাদের নিজের ছবিকে ওই ধরনের পরিবর্তন করা অবস্থায় দেখেনি – তাদেরকে এটা বোঝানো খুব কঠিন।”
“তারা সরাসরি আমাকে কিছু করেনি, কিন্তু এইসব ছবিগুলোকে আমার মাথায় গেঁথে দিয়েছে। আমি ওগুলোকে আর আমার ‘না-দেখা’ বানাতে পারছি না।”
“এমনকি যে ছবিতে কোন পরিবর্তন করা হয়নি – সেটার দিকেও আমি আর আগের মত করে তাকাতে পারছিনা।”
মরিস বলছেন, হেলেন ওই ছবিগুলো দিয়ে যেন “সংক্রমিত” হয়ে গেছেন।
“একটা ছবিকে সেই ছবি তোলার মুহূর্তটির স্মৃতি থেকে আলাদা করা যায় না। সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হলো, হেলেনের ক্ষেত্রে সেই স্মৃতিগুলো বদলে দেয়া হয়েছে। ছবিগুলোতে কতগুলো মিথ্যে স্মৃতি বসিয়ে দিয়ে সেই মিথ্যেগুলোকে তার মনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে তার যে মানসিক আঘাত, তা আসলেই পরিমাপ করা যায় না।”
“এটা হচ্ছে মানসিকভাবে আক্রমণের শিকার হবার মতো একটা অভিজ্ঞতা।”
অসহায় পুলিশ
হেলেন আরো বলছিলেন, এই ছবিগুলো কে তৈরি করেছে তা জানতে না পারার অকল্পনীয় দুশ্চিন্তার কথা।
“ওই ছবিগুলোর প্রতিটিতেই আমার চোখ সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যে এই ছবিগুলো তৈরি করেছে তার কোন মুখ নেই।”
পুলিশ যে এ ব্যাপারে কিছু করতে অক্ষম সেটা জেনে তিনি আরো বেশি আতংকিত হয়েছিলেন। পুলিশ তাকে বলেছিল, তারা কিছু করতে পারবে না কারণ এখানে কোন অপরাধ সংঘটিত হয়নি। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আইনে ডিপফেক ছবি তৈরি করাটা বেআইনি নয়, তবে স্কটল্যান্ডের আইনে পুলিশ এর তদন্ত করতে পারে।
তবে ব্রিটেনে একটি অনলাইন নিরাপত্তা আইনের খসড়া এখন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে – যাতে সম্মতিসূচক নয় এমন ডিপফেক ছবিক তৈরি করাকে বেআইনি করা হবে।
রোজি মরিস বলছেন, এ ছবিটি দিয়ে তিনি কিছু প্রশ্ন তুলতে চেয়েছেন এবং তিনি মনে করেন এ বিষয়টির দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত।
এসডব্লিউএসএস/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ