বাংলাদেশে এক বছরের মতো তৃতীয় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি মাসে মাসে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের যে নীতি নেয়া হয়েছে, তারই আওতায় দুই মাসের মধ্যে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। কিন্তু বাড়তি দাম দেয়ার পরেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন মানুষের মধ্যে।
একই আশঙ্কা রয়েছে বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিশ্লেষকদের মধ্যেও। পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতউল্লাহ বলছেন, ‘গরমের সময় লোডশেডিং এবারও হবে। তার কারণ হলো, এটার পেছনে যেসব প্রধান সমস্যা, তা তো দূর হয়নি। জ্বালানি সংকট তো থেকেই যাচ্ছে।’
‘আমাদের দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ক্রাইসিস আছে। এলএনজি বা এলপিজি দাম অনেক চড়া, সেই পয়সা আমাদের নেই। কয়লা যদি কিনতে হয়, অনেক টাকা, সেটাও নেই। তেলের দামও চড়া, সেখানেও পয়সা নাই, ডলারের দামও বেশি। এসব মিলে আর বিতরণ ব্যবস্থা মিলিয়ে আমার মনে হয়, এবার গরমে তীব্র সংকট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা আছে। অনেক সংকট, কিন্তু এসব সংকটের সমাধান করা খুব কঠিন।’
তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেছেন, ‘সবমিলিয়ে গত বছরের পরিস্থিতি কিন্তু এখন নেই। পরিস্থিতি অনেক ভালো হয়েছে এবং আমরা এতোটুকু বলতে পারি, গত বছরের পরিস্থিতি তৈরি হবে না। গ্রাহকদের একটা স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারবো, আমরা এইভাবে এগোচ্ছি।
উৎপাদন নিয়ে জটিলতা
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বাংলাদেশের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। সেই সঙ্গে আমদানি হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।
এই বছর গ্রীষ্ম, রমজান এবং সেচের চাহিদা হিসাব করে ধরে কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্র রয়েছে ১৫৪টি। যার মধ্যে বেশিরভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
কিন্তু ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে গত বছর তীব্র চাহিদার সময়েও ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হয়।
ফলে বেশ কয়েক বছর পর সারা দেশের বাসিন্দারা তীব্র লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হন। এমনকি শীতের সময়েও দেশের অনেক স্থানে লোডশেডিং করতে হয়েছে।
এই বছর থেকে বাংলাদেশের বড় দুইটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ আসতে শুরু করেছে। এই দুইটি কেন্দ্র মিলিয়ে মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ২৬০০ মেগাওয়াটের বেশি।
ডিজেল বা গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে না পারলেও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এসব কেন্দ্রের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন কর্মকর্তারা।
কিন্তু ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে এসব কেন্দ্রের উৎপাদন অব্যাহত রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ডলার সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় কয়লা আমদানি না হওয়ায় বাংলাদেশের অন্যতম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপালে জানুয়ারি মাসে উৎপাদন একমাস বন্ধ রাখা হয়।
জুন মাস থেকে রামপালের দ্বিতীয় ইউনিটের পুরো দমে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এই কেন্দ্রের দুটি ইউনিট চালু রাখতে যে পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন রয়েছে, সেটার সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন কেন্দ্রটির কর্মকর্তারাই।
বাংলাদেশের বড় আরেকটি প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার আশাবাদের কথা জানানো হলেও সেখানকার সঞ্চালন লাইনের কাজ এখনো পুরোপুরি শুরুই হয়নি। ফলে ২০২৫ সালের আগে সেই বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা দেখছেন না কর্মকর্তারা।
বিশ্লেষকদের মতামত
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সেই অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন না হওয়ায় এবারও একই রকম চিত্র দেখা যেতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন, বিদ্যুতের স্বাভাবিক সরবরাহ নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপরে। ডলারের সিচুয়েশনটা তো এখনো ঠিক হয়নি। হয়তো কিছুটা ইম্প্রুভ করেছে, কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সেই কারণে আমরা তো পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছি না। কারণ জ্বালানি কিনতে হলে যতটা ডলার লাগবে, সেই ডলার তো তারা দিতে পারবে না। না দিতে পারলে সমস্যা থাকবেই এবং লোডশেডিংও করতেই হবে। এর কোন বিকল্প আমি দেখছি না।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই বছরেও ডিজেল সাশ্রয় করতে গিয়ে ডিজেল নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়া গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও ঠিক মতো গ্যাস দেয়া যাচ্ছে না।
তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেছেন, এই চাহিদাকে মাথা রেখে আমরা আমাদের উৎপাদন পরিকল্পনা সাজিয়েছি।
যেখানে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট গ্যাস থেকে পাওয়া যাবে, পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল থেকে আর সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট কয়লা থেকে আসবে। এছাড়া কিছু সোলার আর হাইড্রোপাওয়ার আছে। ডিজেলটা আমরা স্ট্যান্ডবাই হিসাবে রাখতে চাই।
এসডব্লিউএসএস/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ