ওকলাহোমা, অ্যালাবামা, জর্জিয়া, টেনেসি এবং নর্থ ক্যারোলাইনা— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও মধ্যবর্তী অঞ্চলে একাধিক রাজ্যে বাস যুক্তরাষ্ট্রের আদি বাসিন্দা। তবে সভ্য সমাজের থেকে বেশ খানিকটা দূরে, নিভৃতে, প্রকৃতির কোলেই বসবাস। অবশ্য নিজেদের ভাষায় ‘চেরোকি’ বলেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন এই বিশেষ উপজাতির মানুষরা।
মজার বিষয় হল, আজকের সভ্য সমাজ যেখানে এখনও খুঁজে চলেছে ভিনগ্রহীদের উপস্থিতি, সেখানে দাঁড়িয়ে এই প্রাচীন উপজাতি গোষ্ঠীরা নাকি দীর্ঘদিন ধরেই বসবাস করছেন ‘তেনাদের’ সঙ্গে।
হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এমনটাই জানায় চেরোকিদের ইতিহাস এবং মাইথোলজি। এই গল্পের সূত্রপাত হয় ১৮৯৮ সালে। প্রথমবার চেরোকিদের ওপর বিস্তারিত গবেষণা চালান মার্কিন নৃতাত্ত্বিক জেমস মুনির। তার গবেষণাতেই উঠে আসে চেরোকি-লোককথায় উল্লেখিত আশ্চর্য ক্ষমতাশালী এই ভিনগ্রহীদের কথা।
চেরোকি-ভাষায় যাদের নাম ‘নুনেহি’। তারা নাকি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত চোখের সামনেই, আবার রূপ নিতে পারত যেকোনো মানুষের। তাছাড়া নিমেষের মধ্যে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছে যাওয়া বা টেলিপোর্টেশন এবং অতিমানবিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল নুনেহিরা।
নুনেহিদের ইতিবৃত্তে যাওয়ার আগে, চেরোকি মাইথোলজির কথাও বলে নেওয়া যাক খানিক। চেরোকিদের বিশ্বাস, মহাজগতে মোট তিনটি বিশ্ব রয়েছে—আপার ওয়ার্ল্ড, মিডল ওয়ার্ল্ড এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড।
পৃথিবীর পরিধি ছাড়িয়ে গোটা ব্রহ্মাণ্ডজুড়ে যে ‘আরেক পৃথিবী’ ছড়িয়ে রয়েছে সেটাই তাদের কাছে আপারওয়ার্ল্ড। অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে ঠিক যেভাবে স্বর্গ কল্পনা করা হয়, এও অনেকটা তেমনই। অন্যদিকে মিডল ওয়ার্ল্ড হল, আমাদের এই বাসভূমি, পৃথিবী।
আর শেষবিশ্ব ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ হল ভূপৃষ্ঠের নিচে লুকিয়ে থাকা এক আশ্চর্য জগত। আর তিন জগতেই অবাধ বিচরণ যাদের, চেরোকি-লোককথায় তারাই ‘নুনেহি’ বলে পরিচিত।
এমনকি ‘নুনেহি’ কথাটির অর্থও ‘ট্রাভেলার’ বা ‘পরিব্রাজক’। স্বাভাবিকভাবেই নুনেহিরা বহির্বিশ্ব থেকে এই নশ্বর পৃথিবীতে এসে বসবাস শুরু করেছিল বলেই ধরে নেন চেরোকিরা।
চেরোকি লোককথা অনুযায়ী, এই আশ্চর্য প্রজাতির প্রাণীরা বার বার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের। কখনও আহত পথিক কিংবা রোগাক্রান্তদের সাহায্য করেছেন। কখনও খাবার জুটিয়েছেন তীব্র খরার দিনে। আবার শ্বেতাঙ্গ আক্রমণ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের সময়ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন তারা চেরোকিদের সঙ্গে।
এ তো গেল লোককথার গল্প। কিন্তু এমন লোককথা তো কমবেশি ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের সমস্ত প্রান্তেই। ভারতেও বিভিন্ন উপজাতির মাইথোলজি ঘাঁটলেও সন্ধান মিলবে এমনই অতিপ্রাকৃত বহু প্রাণী, দৈত্য-দানোর উপস্থিতি। তা-বলে সত্যিই একসময় পৃথিবীতে রাজত্ব ছিল তাদের, এমনটা কি ধরে নেওয়া যায়? নিঃসন্দেহে না।
তার জন্য যে প্রয়োজন প্রামাণ্য নথি কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর। আর এখানেই আর পাঁচটা লোককথার থেকে পৃথক হয়ে যায় চেরোকি ও নুনেহিদের গল্প।
জর্জিয়া, ওকলাহোমা, নর্থ ক্যারোলাইনা-সহ একাধিক মার্কিন রাজ্যের জনহীন প্রান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে আশ্চর্য সব প্রাচীন নির্মাণ। নির্মাণ বলতে, আদতে সেগুলো প্রাচীন বসতি। ১৮৯৮ সালে গ্রন্থ রচনার সময় নৃতাত্ত্বিক জেমস মুনিরও এই বাড়িগুলির সম্পর্কে তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করেন স্থানীয় চেরোকিদের থেকে।
সে-সময় তাদের মুখেই শোনা যায় এক আশ্চর্য কাহিনি। এই বাড়িগুলিতেই নাকি বসবাস করেন নুনেহিরা। তবে অদৃশ্য হওয়ায় তাদের দেখতে পাওয়ার উপায় নেই। এই বাড়িগুলির ভিতরে আবর্জনা ফেলে আসা হলে নাকি তা উধাও হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। আদতে নুনেহিরাই নাকি তাদের ঘর পরিষ্কার করেন।
চেরোকিদের এই গল্প ফেলে দেওয়াই যেত, তবে শ্বেতাঙ্গ বসতিস্থাপকদের প্রাচীন নথিতেও এই একই গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায় ভিন্নভাবে। তারাও নাকি প্রত্যক্ষ করেছিলেন এমন আশ্চর্য ঘটনা। অবশ্য ভিনগ্রহীদের উপস্থিতি কিংবা অতিমানবিক কোনো শক্তির কথা উল্লেখ করেননি তারা।
বরং, স্রেফ ‘ম্যাজিক’ বলেই চিহ্নিত করেছিলেন শ্বেতাঙ্গরা। এই নথিকেও কি উড়িয়ে দেওয়া চলে? ‘সভ্য’ জেমস মুনির ফেলে দিতে পারেননি এই নথির বয়ান।
তবে তিনি নিজেও এই পরীক্ষা করে দেখেছেন। তাতে লাভ হয়নি খুব একটা। অবশ্য, মরুপ্রান্তরে অবস্থিত প্রাচীন বসতিগুলির নির্মাণকাজ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে অবাক করেছিল তাকে।
বাড়িগুলির যা বয়স, তাতে পাথর কেটে এহেন নির্মাণ তৈরির কোনো যন্ত্রই অনুপস্থিত ছিল তৎকালীন সময়ে। এমনকি বেশ কিছু আশ্চর্য পাথরের মূর্তিও পান তিনি, যেগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের মিল নেই কোনো। বরং, তা দেখতে ভিনগ্রহী বা যন্ত্রমানবের মতোই।
শুধু চেরোকিই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রাচীন উপজাতি হোকিদের লোককথাতেও উল্লেখ পাওয়া যায় ‘অ্যান্ট ম্যান’ নামের একইধরনের এক আশ্চর্য প্রাণীর। তাদের বৈশিষ্ট্যও প্রায় একই। তবে কি সত্যিই ভিনগ্রহীরা একসময় বাসা বেঁধেছিল পৃথিবীতে? বা এখনও সভ্য সমাজের অন্তরালে মিশে রয়েছে তারা?
নাকি এইসব নির্মাণ, লোককথা কোনো হারিয়ে যাওয়া উন্নত সভ্যতার বিবর্তিত ইতিহাস? তেমনটা হতেই পারে, অবশ্য এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর হদিশ মেলেনি যুক্তরাষ্ট্রে। সবমিলিয়ে তাই রহস্যের অন্তরালেই রয়ে গেছে চেরোকি-লোককথা এবং ভিনগ্রহী নুনেহিরা।
এসডব্লিউএসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ