মিথ ও মিথ্যে। খুব কাছাকাছি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে এই দু’টো শব্দ। এতটাই কাছাকাছি যে আলাদা করা শক্ত হয়ে ওঠে। আমেরিকার এরিয়া ৫১ (Area 51) তেমনই এক নাম, যাকে ঘিরে এই দুই শব্দের দাপাদাপি গত কয়েক দশক ধরেই চলছে। কেউ বলেন, এখানে ভিনগ্রহীদের আস্তানা।
আবার কেউ বিশ্বাস করেন, ১৯৬৯ সালে আমেরিকার ‘মিথ্যে’ চন্দ্রাভিযানের পুরোটাই শ্যুট করা হয়েছিল এখানে! বলাই বাহুল্য, সবটাই মিথ।
তবে এটা সত্য যে বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় স্থানগুলোর তালিকায় আছে এরিয়া ৫১ নামক এক জায়গা। জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ এই স্থানে লুকিয়ে আছে নানা রহস্য। তবে আজও তা ভেদ করতে পারেননি কোনো বিজ্ঞানী কিংবা গবেষকরা।
আমেরিকার নেভাডা স্টেটের দক্ষিণে, লাস ভেগাস থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাহাড়ঘেরা মরুভূমির মধ্যে আছে নেভাদা টেস্ট অ্যান্ড ট্রেনিং রেঞ্জ। আধুনিক মারণাস্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাগার। ২৯ লাখ একর জুড়ে থাকা এই রেঞ্জে আমেরিকা ৫০০টিরও বেশি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
আর এই নেভাদা টেস্ট অ্যান্ড ট্রেনিং রেঞ্জের ভেতরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন ও সবচেয়ে রহস্যময় এলাকা এরিয়া ৫১। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে বলে আসছে, এরিয়া ৫১ হলো আমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত সামরিক বিমান ঘাঁটি।
তবে সত্যিই কি এরিয়া-৫১ একটি বিমানঘাঁটি নাকি সেখালে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রহস্য? আসলে স্থানটি ঘিরে মার্কিন সেনার অস্বাভাবিক মাত্রার সুরক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবী জুড়ে সন্দেহ ও কল্পনার জন্ম দিচ্ছে।
কিছুটা অতীতে যাওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে রুপো ও শিসার খনি ছিল গ্রুম লেকের নিকটবর্তী এই অঞ্চল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই পাণ্ডববর্জিত জায়গাটার দখল নেয় মার্কিন সেনা। উদ্দেশ্য, মূলত গোপন সামরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা। এখানে বলে রাখা যাক, এই গ্রুম লেক আদৌ কোনও হ্রদ নয়। মরুভুমির মাঝখানে এটা একটা সমতল ভূমি। আর সমতল বলেই একে অনায়াসে বিমানের রানওয়ে হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
যাই হোক, জায়গাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার ‘কোল্ড ওয়ার’-এর পরিস্থিতি চরমে উঠলে। ১৯৫৫ সালে এর নাম দেওয়া হয় এরিয়া ৫১। এখানেই তৈরি হয়েছিল ইউ-২ বিমান। দাবি ছিল, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়তে পারা ওই বিমান ফাঁকি দেবে রাশিয়াকে। সোভিয়েত রাডার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র, সবাইকে। যদিও সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে ১৯৬০ সালেই একটি ইউ-২ বিমানকে গুলি করে নামায় সোভিয়েত রাশিয়া।
এরপর এখানে তৈরি হয় এ-১২ বিমান। মাটি থেকে ৯০ হাজার ফুট উঁচুতে ২২০০ কিমি প্রতি ঘণ্টার দুরন্ত গতিতে ওড়ার ফলে কোনও রাডারের সাধ্য রইল না এর টিকিটিরও আন্দাজ পাওয়া! পুরো আমেরিকাকে চক্কর লাগাতে এই বিমানের লাগত ৭০ মিনিট। আর এই ভয়ানক দ্রুত গতিই তাকে করে তুলল ‘ইউএফও’! সাংবাদিক অ্যানি জেকবসেন তাঁর বইয়ে দাবি করেছেন, ‘‘টাইটানিয়ামের শরীর আর ওই বুলেটের মতো গতি! সূর্যের আলোয় বিমানটির বিচ্ছুরণ দেখলে যে কারওই মনে হবে ওটা ভিনগ্রহীদের যান।’’
তবে এরও বেশ আগে ১৯৪৭ সালে রোসওয়েল বিমান দুর্ঘটনার পর থেকেই এই জায়গা ঘিরে ভিনগ্রহীদের আনাগোনার জল্পনার শুরুয়াৎ। বলা হয়েছিল, ওটা বিমান নয়। ইউএফও। যেটা চালাচ্ছিল নাৎসিদের গবেষণাগারে তৈরি এক অদ্ভুতদর্শন প্রাণী, যার চেহারা মানুষের সঙ্গে সামান্যই মেলে! কিন্তু সিআইএ এই বিমান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর থেকেই গল্পের ইউএফও মহাকাশে উঠতে থাকে ঘনঘন।
এবং রবার্ট লেজার। ১৯৮৯ সালে তিনি নিজেকে দাবি করেন এরিয়া ৫১-এর প্রাক্তন কর্মী হিসেবে। লাস ভেগাস নিউজ স্টেশনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি ওখানে ভিনগ্রহীদের মহাকাশযান দেখেছেন। এবং সেই যানের প্রযুক্তির নকল করে আমেরিকা অত্যাধুনিক বিমান বানানোর চেষ্টা করে এই গোপন ঘাঁটিতে। আরও কত কী!
আমেরিকার ভূখণ্ডে থাকা সবচেয়ে সুরক্ষিত কিছু জায়গা যেমন, পেন্টাগন, হোয়াইট হাউস, নাসার সদর দপ্তর ও বিভিন্ন লঞ্চ প্যাডেও অনুমতি নিয়ে সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারেন। তবে এরিয়া ৫১ এর আশপাশে মিডিয়া বা জনসাধারণের প্রবেশাধিকার একেবারেই নিষিদ্ধ।
এই স্থানের চারপাশে কোনো প্রাচীর দেওয়া না থাকলেও পরিবেশের সঙ্গে গিরগিটির মতো মিশে আছেন হাজার হাজার সেনারা। খালি চোখে তাদেরকে দেখা যায় না। নিষেধ সত্ত্বেও যদি কেউ এরিয়া ৫১ তে প্রবেশের চেষ্টা করে তাহলে সেনারা অতর্কিত গুলি করে মেরে ফেলে। সেই অনুমতিও দেওয়া আছে তাদের।
এরিয়া ৫১ এর চারপাশে একটি নোটিশ লাগানো আছে, যেখানে লেখা- ‘ইউজ অব ডেডলি ফোর্স অথোরাইজড’। সেনারা ছাড়াও সবার অলক্ষ্যে সেখানে হাজার হাজার মোবাইল সিসি ক্যামেরা, মোশন ডিটেকটর, লেসার ডিটেকটর, সাউন্ড ডিটেকটর, গন্ধ শোঁকার ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোনও স্থানটির সুরক্ষায় আছে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এরিয়া ৫১ নামক স্থানের উপর দিয়ে কোনো বিমান ওড়ারও অনুমতি নেই। এই স্থানের উপরের আকাশেও কড়া নজরদারি চালানো হয়, এজন্য ১৫৫ মাইল উত্তরে ৯ হাজার ৪০০ ফুট উঁচু বেলডে পাহাড়ের চূড়ায় বসানো আছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এয়ার রুট সার্ভেল্যান্স রাডার।
এরিয়া ৫১ কি সত্যিই সেনাবাহিনীর বিমান ঘাঁটি নাকি অন্য কিছু, সেই রহস্য আজও উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে অনেকেরই ধারণা, ওই স্থানে ভিনগ্রহের প্রাণীরা থাকে ও আসা-যাওয়া করে!
এই স্থানের পাশেই আছে দ্য এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল হাইওয়ে। সেখান থেকে নাকি দেখা যায়, অদ্ভুত সব আকাশযান এরিয়া ৫১ নামক স্থানে ওঠানামা করে। পৃথিবীর কোনো বিমানের সাথে সেগুলোর নাকি কোনো মিল নেই।
এদিকে, বিজ্ঞানী বব লেজার জানিয়েছিলেন, এরিয়া ৫১ ঘাঁটিতে এমন কিছু মৌলিক পদার্থ নিয়ে গবেষণা করা হয় যা আবিষ্কারের কথা আমেরিকা বিশ্বকে জানায়নি। তার মতে, সুপারনোভা বা বাইনারি স্টার সিস্টেম থেকে আমেরিকা সম্ভবত এমন একটি মৌলিক পদার্থ সংগ্রহ করতে পেরেছে।
যে পদার্থটির মাত্র এক কেজি দিয়ে ১০ মেগাটনের ৪৭টি হাইড্রোজেন বোমা বানানো যাবে। এমন নানা তত্ত্বের প্রচলন আছে নিষিদ্ধ স্থান এরিয়া ৫১ নিয়ে। তবে ওই স্থানের আসল রহস্য এখনো সবারই অজানা।
তবে কেন এমন করে রহস্যের চাদরে মোড়া এরিয়া ৫১? নিঃসন্দেহে এই গোপন মার্কিন ঘাঁটি এখনও পুরোমাত্রায় সক্রিয়। ১৯৭০ সালের পর থেকে আরও কড়া হয়েছে নিরাপত্তা। অথচ জায়গাটার সামনে গেলে সেভাবে কিছু বোঝার জো নেই। জালের বেড়া আর সাধারণ দরজা। এইটুকু তো নিরাপত্তা।
যদিও একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, তা নয়! চারপাশে ভরতি ক্যামেরা। আর তারা নাগাড়ে নজর রেখে চলেছে। স্থানীয়দের কথায়, এখানে কোনও মরু কচ্ছপ কিংবা খরগোশ ঢুকে পড়লেও টের পেয়ে যায় মার্কিন সেনা।
‘গুগল আর্থ’-এর সাহায্যে দেখা যায় এখানে নিত্যনতুন নির্মাণ গজিয়ে উঠছে। খুব ভোরের দিকে আধো অন্ধকারে আকাশ থেকে কারা যেন এখানে এসে নামে। নাহ, ইউএফও নয়। লাস ভেগাসের ম্যাকারান বিমানবন্দর থেকে কর্মীদের সেই সময়ই উড়িয়ে আনা হয় এখানে।
লেখক ও ঐতিহাসিক পিটার মার্লিনের ধারণা, সম্ভবত অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, সামরিক যানের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় এই গোপন ঘাঁটিতে। বিশেষ করে মনুষ্যবিহীন সেন্সরচালিত বিমানের!
একদিন হয়তো সিআইএ আবার মুখ খুলবে। জানাবে সাতের দশকের পর থেকে এখানে ঠিক কী ধরনের পরীক্ষা চলত। ততদিন ধরে পাক খেতে থাকুক কল্পনার মহাকাশযান। অবশ্য সেই মিথকেও কমজোরি মনে করার উপায় নেই। নাহলে কি আর সেই রোমাঞ্চকে কার্যত মান্যতা দিয়ে ১৯৯৬ সালে এখানকার রাস্তার নাম রাখা হয় ‘একস্ট্রা টেরেস্ট্রিয়াল হাইওয়ে’ অর্থাৎ ভিনগ্রহীদের সড়ক।
এসডব্লিউএসএস/০৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ