প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’-এর পরের দিন পালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাক ফ্রাইডে এমন একটা দিন, যেদিন সেখানকার মানুষরা পাগলের মতো কেনাকাটা করে। কারণ, এই ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে আমেরিকার ক্রিসমাস শপিং মরসুমের সূচনা হয়। ১৯৫২ সালে এই দিনটি প্রথম উদযাপিত হলেও ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামটি কয়েক দশক ধরে অজানা থেকে যায় সকলের কাছে।
এদিকে সময়ের সাথে সাথে এটি বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়া মহাদেশ – এমনকি বাংলাদেশেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই দিনে ব্যবসায়ীরা পণ্যের উপর বিশেষ ছাড় প্রদান করে থাকে আর এই ছাড় এর পরিমাণ থাকে অবিশ্বাস্য আর তা ক্রেতাদের মধ্যে হিড়িক পড়ে যায়।
কথিত আছে ব্ল্যাক ফ্রাইডে তে ১০০০ ডলার মূল্যের একটি টিভি ২০০ ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়। ওয়ালমার্টের মতো বৃহত্তর কোম্পানি তাদের নেট মুনাফা ১ জানুয়ারি থেকে শুরু করে বছরের ১৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে ১৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারে।
কিন্তু ব্ল্যাক ফ্রাইডে যদি এত বড় অর্থনৈতিক সুযোগ দেয়, তাহলে এর নামের সঙ্গে ‘ব্ল্যাক’ যুক্ত হলো কীভাবে? অর্থনীতির ভাষায় ‘ব্ল্যাক’ শব্দটি একটি নেতিবাচত শব্দ এবং অর্থনীতিতে বড় অঘটনকে ব্যাখ্যার সময় এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন, ১৯২৯ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতনের ঘটনাকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক থার্সডে’। চলুন জানা যাক গোটা ইতিহাস।
ব্ল্যাক ফ্রাইডের ইতিহাস
সাধারণত কালো শব্দটি নেতিবাচক হলেও ব্যবসায়ীদের জন্য এটি ইতিবাচক দিক নির্দেশ করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামকরণ এবং ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। ১৮৬৯ সালের দিকে আমেরিকায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল।
তখন ব্যবসায়ীরা এমন একটি দিনের কথা ভেবেছিল, যে দিনটিতে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে পন্য বিক্রির পরিমাণ এতবেশি বেড়ে যাবে – বিক্রির সূচক এক লাফে অনেক উপরে উঠে যাবে। সাধারণত হিসাবের খাতায় লোকসানের হিসাব লাল কালিতে লেখা হলেও এ দিবসের শুরুর দিন থেকেই হিসাব-নিকাশ কালো কালিতে লেখা হয়। সেই থেকে পন্যবিক্রির কৌশল হিসাবে এই দিনটিকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়।
এইদিনে সকাল হওয়ার আগেই ক্রেতাদের লম্বা লাইন দেখা যায়। প্রতিবছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ শুক্রবারকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়। নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার হচ্ছে – থ্যাংকস গিভিং ডে এবং থ্যাংকস গিভিং ডে এর পরের দিন অর্থাৎ নভেম্বর মাসের চতুর্থ শুক্রবার হচ্ছে ব্ল্যাক ফ্রাইডে।
বিভিন্ন অনলাইন বিপণন সংস্থায় যে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’ চলছে, তা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেছেন। অবিশ্বাস্য কম দামে পাওয়া যাবে আপনার চাহিদার জিনিসটি, এমনই দাবি নিয়ে হাজির হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রেতারা। কিন্তু কী এই ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’? আদৌ কি তার সঙ্গে উৎসবের বা আনন্দের কোনোরকম যোগ আছে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
অগ্রহায়ণ মাসে যেমন বাংলায় নতুন শস্য উঠলে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেমনি এই সময়টায় আসে থ্যাংকসগিভিং। আর নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার পালিত হয় ব্ল্যাক ফ্রাইডে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে কী জানার জন্য আপনি যদি আন্তর্জালের শরণাপন্ন হন, সেখান থেকে জানা যাবে এক মজার ঘটনার কথা।
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে। সস্তায় জিনিস কেনার জন্য সেখানে এমন ভিড় হয়েছিল যে পুলিশকে নাওয়া খাওয়া ফেলে ভিড় সামলাতে হয়েছিল। আর তারাই এই দিনটার নামকরণ করেছিল ব্ল্যাক ফ্রাইডে। যদিও ইতিহাস ঘাঁটলে এই দিনটির অন্যরকম এক তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। যা এতটাও সরল নয়, আর এত আনন্দের তো নয়ই।
অজানা অধ্যায়
সেসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির একটি বড় ভিত্তি ছিল দাস ব্যবসা। এই দাসদের অবস্থা পশুর চেয়েও খারাপ ছিল। আফ্রিকা থেকে কালো মানুষদের গায়ের জোরে বন্দি করে নিয়ে আসা হত আমেরিকায়। দাসের জোগানে যেহেতু কমতি ছিল না, সুতরাং তাদের বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা নিয়েও মাথা ঘামাতেন না সাহেব প্রভুরা। অখাদ্য খাবার আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থেকে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হত তাদের। পারিশ্রমিকের বালাই ছিল না, উলটো পান থেকে চুন খসলেই শরীরে পড়ত চাবুকের আঘাত।
এই দাসদের বেচাকেনার জন্য বরাদ্দ দিন ছিল এই দিনটি, যাকে আমরা ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলে জানি। আসলে অক্টোবর মাসের শেষ দিনে হ্যালোইন, নভেম্বর মাসে থ্যাংকসগিভিং, ডিসেম্বরে বড়দিন পেরিয়েই নতুন বছরের প্রস্তুতি… এতরকম উৎসবের তোড়জোড় করার জন্য ধনীদের কাজের লোক প্রয়োজন হত। পাশাপাশি খামারবাড়িতেও তখন ফসল তোলার মওশুম। এর জন্য প্রয়োজন অনেক শ্রমিক। তাই নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার আমেরিকার প্রায় সর্বত্রই বসত একটা বিশেষ ধরনের হাট। এই হাটে শুধুমাত্র দাস বেচাকেনা হত। কালো মানুষদের বেচাকেনার দিনটিকে ব্ল্যাক ফ্রা্ইডে বলা হত।
১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি এই ঘৃণ্য দাসপ্রথার অবসান ঘটান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন। অথচ তারপরেও অবসান ঘটল না ব্ল্যাক ফ্রাইডের।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কালো মানুষদের মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব হলেন সারা বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা। এদিকে ভিয়েতনাম তখন কেঁপে উঠছে মার্কিন সেনাদের বুটের আওয়াজে। আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের মনোভাব যখন পৃথিবীর সামনে এসে পড়েছে, তখনই আবার জাগিয়ে তোলা হল ব্ল্যাক ফ্রাইডে-কে।
থ্যাংকসগিভিং-এর ঠিক পরেই শুরু হল কেনাকাটায় বিশাল ছাড় দেওয়া। নেহাতই বাণিজ্যিক ভাবনার মোড়কে উসকে দেওয়া হল কালো মানুষদের প্রতি ঘৃণার সেই স্মৃতি। আর আজও অজান্তেই সেই ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে এই বিশেষ নামকরণটি। যেমন বয়ে চলেছে মানুষে মানুষে ঘৃণা, ভেদাভেদ, ভাগাভাগির ইতিহাসও।
এসডব্লিউএসএস/১৩০৪
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ