কলম্বাসের আবিষ্কারের ৩০ হাজার বছর আগেই ছিল আমেরিকার অস্তিত্ব। সেখানে পাওয়া যায় মানুষের বসবাসের চিহ্ন। উত্তর আমেরিকায় সর্বশেষ গ্লাসিয়াল যুগের আগেও মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি। সেটা প্রায় ১৯ হাজার থেকে ২৬ হাজার বছর পূর্বের সময়ের কথা। ধারণা করা হয়, এই এলাকা খুব বেশি জনবহুল না হলেও বসতি স্থাপন করেছিল কিছু মানুষ। ২৯ থেকে ৫৭ হাজার বছর আগে হিমবাহ গলে আমেরিকা ডুবেছিল বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। তবে সঠিক সময়টা এখনো জানা না গেলেও স্পষ্ট যে, কলোম্বাসের আবিষ্কারের বহু বছর আগেও আমেরিকায় মানুষের অস্তিত্ব ছিল।
তাছাড়া কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশে পা রাখা প্রথম ইউরোপিয়ান নন। তথ্য অনুযায়ী, তারও ৫০০ বছর আগে লেইফ এরিকসন নামের আইসল্যান্ডের একজন পরিব্রাজক উত্তর আমেরিকায় পা রাখেন। তবে কলম্বাসের এই কথিত আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাসের তলায় চাপা আছে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের আর্তনাদ। দাসে পরিণত হওয়া অসহায় মানুষের যন্ত্রণা। কারণ, কলম্বাস খুনী ও অত্যাচারী শাসক হিসেবে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত করেছিলেন। এক; দাস বাণিজ্য ও আমেরিকায় আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের গণহত্যা।
মূলত ১৪৮৩ সালে পর্তুগালের রাজা জন দ্বিতীয়র কাছে কলম্বাস তার পরিকল্পনা জমা দেন। তাতে ছিল আটলান্টিক হয়ে পশ্চিমের দিকে ইন্ডিজে যাওয়ার পরিকল্পনা। উল্লেখ্য, বর্তমান এশিয়া মহাদেশের পুরোটাকেই তখন ইন্ডিজ বলা হতো। রাজা যখন রাজি হলেন না, তখন তিনি ওই পরিকল্পনা স্পেনের রাজা ও রানির কাছে পেশ করেন। স্পেনের রাজদরবার তার অভিযান অনুমোদন করেন। তাকে ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের ভাইসরয় হিসাবে নিযোগ দেন।
আজ থেকে ৫২৮ বছর আগে ৩ আগস্ট ক্রিস্টোফার কলম্বাস সান্তামারিয়া, পিন্টা, নিনা নামে তিনিটি জাহাজ ও ৮৭ জন নাবিক নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। এবং ওই যাত্রায় তিনি ভুলবশত আমেরিকার ভূখন্ড আবিষ্কার করেন। সরলমনা স্থানীয় আদিবাসীরা তাদেরকে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানান। কলম্বাসের একটি ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজও মেরামত করে দেন তারা।
কলম্বাস বাহিনী হিস্পানিওলা দ্বীপের একটি প্রদেশে এক নির্দেশ দেন। ১৪ বছরের উপরের সব আদিবাসীকে তিন মাস পরপর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ জমা দিতে হবে তাদের। এই নির্দেশ মানতে যারাই ব্যর্থ হত তাদেরই দুই হাত কেটে ফেলা হত। হাত কাটার ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা যেত তারা। অনেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে।
অভ্যর্থনা জানাতে আসা আদিবাসীদের দেহে স্বর্ণের অলঙ্কার দেখে কলম্বাস অনুমান করেন আশেপাশের কোথাও স্বর্ণের খনি রয়েছে। আদিবাসীদের সরলতা কলম্বাসকে মুগ্ধ করে। চতুর কলম্বাস মুহূর্তেই কষে নেন অংক। তিনি ধারণা করেন, খুবই কম পরিশ্রমে ওই ভূখণ্ডের সব কিছু নিজের দখলে নিতে পারবেন। তিনি আমেরিকার মূল মালিক আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেন এবং স্পেনে গিয়ে আরো ১২০০ ইউরোপীয়কে সঙ্গে নিয়ে আসেন।
শুরু হয় নির্মমতা, চলে গণহত্যা। কলম্বাস বাহিনী হিস্পানিওলা দ্বীপের একটি প্রদেশে এক নির্দেশ দেন। ১৪ বছরের উপরের সব আদিবাসীকে তিন মাস পরপর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ জমা দিতে হবে তাদের। এই নির্দেশ মানতে যারাই ব্যর্থ হত তাদেরই দুই হাত কেটে ফেলা হত। হাত কাটার ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা যেত তারা। অনেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। তবে তাদের পরিণতি হয়েছে আরো ভয়াবহ। হিংস্র কুকুর দিয়ে খুঁজে বের করে নির্মম অত্যাচার করে মেরে ফেলা হত। অনেক আদিবাসীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।
হিস্পানিওলা দ্বীপে বসবাসকারীরা ছিল আরাওয়াক গোত্রের। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, কলম্বাসের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় বাহিনীর নির্মমতা সইতে না পেরে ৫০ হাজার আদিবাসী বিষ খেয়ে গণ-আত্মহত্যা করেছিলেন। মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতেন যাতে ইউরোপীয়রা ওই বাচ্চাদেরকে কুকুরের খাবারে পরিণত করতে না পারে। এরপরও যারা বেঁচে ছিলেন তাদেরকে দাসে পরিণত করেন কলম্বাস।
কলম্বাসের সময়ের কিছু নির্মমতার ইতিহাস উঠে এসেছে তার নিজস্ব জার্নাল ও চিঠিতে। আরো তথ্য পাওয়া যায় স্পেনের ঐতিহাসিক বার্তোলমে দা লাস কাসাস এর লেখা ‘হিস্টোরি অব দ্য ইন্ডিজ’গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, কলম্বাস বাহিনী তাদের ছুরি ও তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করার জন্যও আদিবাসীদের টুকরো টুকরো করে কাটতো। নিষ্পাপ শিশুদের শিরচ্ছেদ করতো। কলম্বাস যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলে নামকরণ করেছিলেন সেই আদিবাসীদের একটা বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
এরপর ইউরোপীয়রা নিজেদের বিলাসী জীবন নিশ্চিত করতে সেবকের প্রয়োজন বোধ করে। শুরু করে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মানুষদের নিয়ে আসা। আর এভাবেই আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন। এখনকার আফ্রিকান আমেরিকানরাই সেই সময়ে দাস হয়ে আসা আফ্রিকান। তারা কিন্তু স্বেচ্ছায় আমেরিকায় আসেননি, তাদেরকে জোর করে ধরে আনা হয়েছিল দাস হিসেবে।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ