সমাজের রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা না করে লিঙ্গ পরিবর্তন করেছিলেন। ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বছর তিনেক আগে। সন্তানের অভিভাবক হতে চলেছেন ভারতের কেরলের রূপান্তরিত যুগল। আনন্দের এই মুহূর্ত ভাগ করে নিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাও আবার স্পেশ্যাল ফটোশুটের ছবি শেয়ার করে।
কেরলের কোঝিকোড় শহরের বাসিন্দা জিয়া ও জাহাদ। ছেলে হিসেবে জন্ম হয়েছিল জিয়ার। কিন্তু মন থেকে নিজেকে মেয়ে করতেন। সাবলম্বী হওয়ার পর নিজের লিঙ্গ পালটে ফেলেন জিয়া।
প্রায় একটি গল্প জাহাদের। মেয়ে হিসেবে জন্ম হয়েছিল তার। কিন্তু বরাবর ছেলে হতে চেয়েছিলেন। তারপর লিঙ্গ পরিবর্তন করান। অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে যেতে হয়েছে দু’জনকে। তাই তিন বছর আগে যখন দেখা হয়েছিল আত্মিক টান অনুভব করেছিলেন।
একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন জিয়া ও জাহাদ। জিয়ার স্বপ্ন ছিল মা হওয়ার। জাহাদ চেয়েছিলেন বাবা হতে। তবে জন্মসূত্রে যেহেতু জাহাদ মেয়ে লিঙ্গ পরিবর্তন করার পরও গর্ভধারণ তিনিই করেছেন।
জিয়ার দাবি, রূপান্তরিত যুগল হিসেবে তারাই ভারতে প্রথম স্বাভাবিকভাবে মা ও বাবা হচ্ছেন। আনন্দের এই সময় পাশে পেয়েছে কিছু বন্ধু আর পরিবারের সদস্যদের। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই শেয়ার করেছেন ফটোশুটের ছবি।
ছবির ক্যাপশনে জিয়া জানিয়েছেন, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে। কিন্তু হার কখনও মানেননি। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি জাহাদ। তাই সন্তানের জন্মের আগেই তার নাম ঠিক করে ফেলেছেন।
জীবন, এই নামই রাখছেন রূপান্তির যুগল। আট মাস সম্পূর্ণ জাহাদের। আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। সুস্থ সন্তানের জন্ম হোক, এই আশা তাদের।
প্রসঙ্গত, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামাজিকভাবে উপর্যুপরি হেনস্তার স্বীকার হওয়া, বিপরীত লিঙ্গে অধিক সুরক্ষা নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে বলে মনে করা, একটি বিশেষ লিঙ্গের মানুষকে সমাজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে মান্য করা অথবা এক লিঙ্গের মানুষের ভেতর বিপরীত লিঙ্গের আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সিংহভাগ বিদ্যমান থাকায় সম্প্রতি মানুষের লিঙ্গ পরিবর্তনের হার বেড়েছে বিশ্বজুড়ে।
তবে এসব কারনগুলোর পাশাপাশি জেন্ডার ডিসফোবিয়ায় ভোগা মানুষেরা তাদের জন্মের সময় প্রাপ্ত লিঙ্গ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক ধরনের ফোবিয়া বা অসন্তুষ্টির কারনেও লিঙ্গ পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকে থাকেন।
শরীরে কাঙ্খিত লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হরমোন প্রয়োগ, যেমন পুরুষ হতে চাইলে নারীদেহে টেস্টোস্টেরন এবং নারী হতে চাইলে পুরুষদেহে প্রজেস্টেরন হরমোন প্রয়োগ, সার্জারির মাধ্যমে শরীরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঙ্গগুলো কেটে বাদ দেওয়া এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সাধারণত লিঙ্গ পরিবর্তন করা হয়।
ডেনমার্কে বিশ্বে প্রথম সফলভাবে লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারিটি হয় ১৯৫২ সালে। জর্জ জোর্গেনসন নামের সাবেক এক মার্কিন সৈন্যে লিঙ্গ পরিবর্তন করে পরিণত হন হলিউডের তত্কালীন সময়ে পরিচিত মুখ ক্রিস্টিন জোর্গেনসনে।
তবে সামাজিক প্রতিরক্ষা ও ব্যক্তিগত আকাঙ্খার জের ধরেই লিঙ্গ পরিবর্তন করার দাবিকে মানতে নারাজ বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, সামাজিকভাবে প্রভাবিত ফ্যাক্টরগুলোর চেয়ে মানুষের জন্মের আগে জিন ও হরমোন দ্বারা সৃষ্ট জৈব রাসায়নিক সিগন্যাল লিঙ্গ পরিবর্তন আকাঙ্খার উপর বেশী প্রভাব ফেলে।
মনুষ্য ভ্রুণ ক্রমবিকাশের খুব প্রাথমিক ধাপে লিঙ্গ নির্ধারনকারী হরমোন যখন তৈরি হয়, ঐ সময় তার হরমোন লেভেল কোনো কারণে বদলে গেলে ফিনোটাইপেও এর প্রভাব পড়ে। ফলশ্রুতিতে প্রকৃতিগতভাবে নির্দিষ্ট এক লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ করার স্বাভাবিক যে প্রবণতা কাজ করার কথা, তা বিঘি্নত হয় অথবা ক্ষেত্রবিশেষ ঐ ব্যক্তির বাহ্যিক যৌনাঙ্গের গঠনও প্রভাবিত হয়।
কিন্তু লিঙ্গ পরিবর্তন করে কুখ্যাত অপরাধীর গা ঢাকা দেওয়ার প্রচলন শুরু হওয়া, পরিবারের আশা আকাঙ্খার প্রেক্ষিতে জোর করে সন্তানকে লিঙ্গ পরিবর্তনে বাধ্য করা ও মানুষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে প্রভাব পড়ার শঙ্কায় সমালোচিত হয়ে আসছে আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানের এ পদ্ধতিটি।
তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের উপর ভিত্তি করে প্রণিত ‘ইয়গিয়াকার্তা’ নীতিমালা বলছে, প্রত্যেকটি ব্যক্তির নিজ লিঙ্গের প্রতি অনুভূত অন্তর্নিহিত ভাবনা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে অস্ত্রপ্রচারের দ্বারা, চিকিৎসাগতভাবে বা অন্য কোনো উপায়ে স্বাধীনভাবে লিঙ্গ নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে।
সেই সাথে লিঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রীতিনীতি যেমন পোশাক, বক্তব্য, ব্যবহারের সামঞ্জস্যপূর্ণতা ঐ ব্যক্তির পছন্দমতোও হতে পারবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ