চলমান সপ্তম পাঁচশালা তথা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার চেয়ে সদ্য অনুমোদিত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ লাখ কমিয়ে ধরা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সময় ১৮ থেকে ১৯ লাখ লোক বছরে শ্রমবাজারে যুক্ত হবেন। গত জুনে শেষ হওয়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-২০) সরকার ১ কোটি ২৯ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। অষ্টম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনায় ১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে।
এদিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে জানানো হয়েছে, ওই পরিকল্পনায় প্রতিশ্রুত ১ কোটি ২৯ লাখের বিপরীতে ৯৫ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরেছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ লাখ কর্মসংস্থান কম হয়েছে ওই পাঁচ বছরে। যার অর্থ দাঁড়ায় ব্যর্থতার হার চার ভাগের এক ভাগের চেয়েও বেশি। এটা লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে পড়ে থাকা।
গতবারের তুলনায় এবার দ্বিগুণের বেশি অর্থ ব্যয় করে লক্ষ্য কমিয়ে ধরা হচ্ছে। কিন্তু তার কতটা অর্জন করা যাবে, সেই প্রশ্ন থাকছেই। কারণ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও কোন খাতে এই কর্মসংস্থান হবে, কোন ধরনের কর্মসংস্থান হবে, প্রতিবছর কী পরিমাণ হবে, এসব কিছু বিস্তারিত নেই।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শুরুতেও এই দুর্বলতা দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষেও এমনসব তথ্য উঠে এসেছে, যা অর্থনীতিবিদদের জন্য কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। ওই পরিকল্পনার লক্ষ্য অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও বিনিয়োগ, রপ্তানি, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও প্রবাসী আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ধারেকাছেও পৌঁছানো যায়নি। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী এটা হওয়ার কথা না থাকলেও সরকারের তথ্য উপাত্ত তেমনই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন পাঁচশালা পরিকল্পনাও আগের পথেই হাঁটছে।
দুই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবারের পরিকল্পনায় গতবারের চেয়ে ব্যয় ধরা হয়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। গতবারের ৩২ লাখ কোটি টাকার বিপরীতে এবার খরচ হচ্ছে ৬৫ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু গতবারের তুলনায় এবার কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা কমিয়ে ধরা হয়েছে। গতবারের ১ কোটি ২৯ লাখ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণের বিপরীতে এবার কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ লাখ কমিয়ে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার নির্ধারণ করা হয়েছে।
২৯ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল মঙ্গলবার শেরেবাংলা নগরে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে অষ্টম পাঁচশালা পরিকল্পনার অনুমোদন দেয়া হয়। এনইসির সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে মোট ৬৪ হাজার ৯৫৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বিদেশি উৎস থেকে আসবে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ।
২০১৫ সালের অক্টোবরে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদনের পর পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য ব্যয়ের লক্ষ্য চূড়ান্ত করা হয়েছে ৩১ লাখ ৯০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ ব্যয় করে আগামী পাঁচ বছরে দেশী-বিদেশী মিলে নতুন ১ কোটি ২৯ লাখ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মোট ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৩ লাখ ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে শেরেবাংলা নগরে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকটির সভাপতিত্ব করেন। সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য জ্যেষ্ঠ সচিব আসাদুল ইসলাম ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
অর্থের সংস্থান প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগে আমরা অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভর করছি। এটি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ঠিক বিপরীত। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা ৮৮ শতাংশ বিদেশি অর্থায়ন এবং ১২ শতাংশ দেশীয় অর্থায়নের ওপর নির্ভর করেছিলাম। এবার আমরা উল্টোটা করছি।’ এদিকে মোট বিনিয়োগের মধ্যে সরকারি খাত থেকে আসবে ১২ হাজার ৩০১ দশমিক ২ বিলিয়ন টাকা, যার আকার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। আর বেসরকারি খাত থেকে আসবে ৫২ হাজার ৬৫৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন টাকা, যার আকার ৮১ দশমিক ১ শতাংশ।
পরিকল্পনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে। সরকার আশা করছে, গেল অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হলেও চলতি অর্থবছর শেষে তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতির অবস্থার উন্নতি ঘটবে। এরপর প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ৮ দশমিক ২২ থেকে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে উন্নীত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অষ্টম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনায় ১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ লাখ ৫ হাজারের কর্মসংস্থান হবে বিদেশে। এই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ দশমিক ০১ মিলিয়ন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ দশমিক ১৩ মিলিয়ন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ২৬ মিলিয়ন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে সরকার।
সরকার জানিয়েছে, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রতিপাদ্য ‘সকলের সাথে সমৃদ্ধির পথে’। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে সরকারের আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই। এই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাই হবে এসডিজি বাস্তবায়নের ভিত্তি।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১২২০
আপনার মতামত জানানঃ