সিম কার্ড হচ্ছে কোনো মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হওয়ার মাধ্যম। সিম কার্ড অনেক আগের প্রযুক্তি, যা অনেকদিন ধরেই সেবা প্রদান করে আসছে। তবে সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তি পরিবর্তনের যে গতি তাতে সিম কার্ডের প্রযুক্তি পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পৃথিবীর অনেক দেশই সিম কার্ডের প্রাথমিক যুগ থেকে ই-সিমের যুগে প্রবেশ করেছে। মূলত এই খাতে এখন অবধি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিটি হলো ই-সিম।
নতুন ধরনের এই সিম প্রযুক্তি, যা প্রচলিত সিম ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে সক্ষম হয়েছে। তবে পার্থক্য হলো এটি সিম এর মত রিমুভ করা যায় না, বা অন্য ফোনে প্রবেশ করানো যায়না। এটি সরাসরি ফোনের মধ্যে এমবেডেড করা থাকে। তবে জানা গেছে, গ্রাহক চাইলে ব্যবসায়ের জন্য একটি নম্বর এবং ব্যক্তিগত কলের জন্য অন্য একটি নম্বর ব্যবহার করতে পারবেন। আবার একই ডিভাইসে বিদেশে ব্যবহারের জন্য একটি ডেটা রোমিং সিম যুক্ত করতে পারবেন।
এমনকি ব্যবহারকারী সম্পূর্ণ আলাদা ভয়েস এবং ডেটা প্ল্যান রেখে ই-সিম ব্যবহার করতে পারেন। বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠান ই-সিম চালু করার ঘোষনা দিলে মানুষের মাঝে এই প্রযুক্তি নিয়ে কৌতুহল তৈরি হয়েছে।
ই-সিম কী?
ই-সিমের সহজ অর্থ হলো একটি এমবেডেড সিম কার্ড। এখানে কোনোপ্রকার ফিজিক্যাল সিম কার্ড জড়িত নয়। ব্যবহারকারীদের কখনোই ফিজিক্যালি সিম কার্ড অদলবদল করার প্রয়োজন পড়বে না এই প্রযুক্তিতে। তবে এই প্রযুক্তিটি কার্যক্ষম করতে হলে এটি নেটওয়ার্ক বা ক্যারিয়ার দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। যদিও এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে সমস্ত নেটওয়ার্ক ই-সিমের অপারেশন চালু করেনি।
আরো সহজভাবে বললে, একটি ই-সিম হলো মূলত ফোনের ভিতরে একটি চিপ যার কাজ NFC চিপের মতোই। তবে এর পেমেন্ট প্রযুক্তি পুরোপুরি এপল-পে কিংবা গুগল-পে এর মতো। আবার একটি ই-সিমের তথ্য পুনরায় লিখনযোগ্য। অর্থাৎ, গ্রাহক চাইলেই একটি কলের মধ্যদিয়ে নিজের অপারেটর পরিবর্তন করে নিতে পারবেন।
এই সিমের ডেটা প্ল্যান এমনভাবে প্রোগ্রামিং করা হয় যাতে করে এই সকল তথ্য নতুন করে যোগ করা কিংবা পরিবর্তন করা সহজ হয়। একটি মোবাইল ডিভাইসের একাউন্টে ই-সিম সহ ডিভাইসগুলোকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংযুক্ত করা যায়।
কোন নেটওয়ার্কে ই-সিম সাপোর্ট করে?
ই-সিম শুধুমাত্র নির্বাচিত কিছু ক্যারিয়ারে সাপোর্ট করে। ব্যবহারকারীদের হয় একটি ক্যারিয়ার এপ থাকতে হবে নয়তো একটি QR কোড থাকবে যা দ্বারা সহজেই স্ক্যান করা সম্ভব। আবার ব্যবহৃত ক্যারিয়ারটি হতে হবে উল্লেখিত অপারেটিং সিস্টেম সহায়ক। অর্থাৎ, ই-সিমের পুরো পরিচালনা কিংবা সাপোর্টিং সিস্টেম একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
আমরা যদি পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যুক্তরাজ্যে শুধুমাত্র EE, O2, Vodafone ই-সিমের সেবা প্রদান করছে। আবার এদের মধ্যে Vodafone শুধুমাত্র অ্যাপল ঘড়িতে এটির সেবা চালু রেখেছে। আবার এমন নয় যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক আগে থেকেই এই সেবা চালু করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালের শেষদিকে ব্রিটেন এমন পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করে।
ব্রিটেনে একটি ই-সিম পেতে হলে অপারেটর নির্দেশিত দোকান থেকে POP করতে হয়। আবার নির্দিষ্ট এপের মাধ্যমে চালু করতে হলে গ্রাহক পরিষেবায় কল করে নিয়ম মেনে ই-সিম প্যাক একটিভ করা হয়। EE প্রতিষ্ঠানের সিম কিনতে গেলে একটি প্যাক দেয়া হয় যাতে কোনো সিম থাকে না। সিমের পরিবর্তে সেখানে কিছু নির্দেশনা উল্লেখ থাকে যার মাধ্যমে ই-সিম একটিভ করা যায়। সকল নির্দেশনা অনুসরণ করার পরিপ্রেক্ষিতে সিমের প্যাকে থাকা QR কোডটি স্ক্যান করার মাধ্যমে EE অপারেটিং সিস্টেম চালু হয়।
উল্লেখ্য যে, প্রথাগত সিমের মতোই ই-সিম প্যাকের নির্দিষ্ট নম্বর থাকে যার মাধ্যমে সেটিকে নির্দেশ করা হয়। শুধুমাত্র যুক্তরাজ্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া সহ প্রায় সব দেশেই ই-সিমের অপারেটিং একই ধরণের হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের শর্তাবলী, POP সেবা পরিবর্তন পদ্ধতি ভিন্ন হয়। ই-সিমযুক্ত ডিভাইসগুলোর অন্যতম আকর্ষণ হলো সহজে ক্যারিয়ার পরিবর্তনের সুবিধা।
যদিও ই-সিম স্মার্টফোনের নির্মাতাদের মাধ্যমে এম্বেড বা স্থাপন করা থাকে। তবে এর তথ্য সহজেই পুনর্লিখন করা যায়। যার কারণে কয়েকটি সহজ পদক্ষেপেই এসব তথ্য পুনর্লিখনের মাধ্যমে অন্য কোনো ক্যারিয়ার বা সিম কোম্পানিতে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়। প্রচলিত ফিজিক্যাল সিম পরিবর্তনের তুলনায় এতে আপনার সময় কম লাগবে। এ ছাড়া সিম ট্রে না খুলেই সহজে আপনি ক্যারিয়ার পরিবর্তন করতে পারবেন।
অ্যাপলের তথ্যমতে, ১৯০টি দেশ ও অঞ্চলে ৪০০টিরও বেশি ক্যারিয়ার বর্তমানে ই-সিম সেবা দিয়ে থাকে। এর অর্থ হলো আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীরা এখন খুব সহজেই স্থানীয় ক্যারিয়ারগুলোর সেবা নিতে পারবে। যা তাদের অত্যধিক রোমিং চার্জ এড়াতে সাহায্য করবে।
ই-সিমের সুবিধা
আমরা ইতোমধ্যেই ই-সিমের প্রাথমিক কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা জানতে পেরেছি। তবে প্রতিটি প্রযুক্তি সামনে আসে মানুষকে সহজলভ্য সুবিধা দিতে। ফোনের ক্ষেত্রে ই-সিমও সেটিই করবে বলে আশা করা যায়।
তাত্ত্বিকভাবে ই-সিমের সুবিধা হওয়া উচিত, ব্যবহারকারী নিজ দেশের বাহিরে গেলে তার প্রধান নম্বরের অ্যাকসেস বজায় রেখে ফোনকে একটি রোমিং ই-সিম যুক্ত করে বিদেশেও নম্বরটি চালু রাখা যায়। বর্তমান সময়ে বিদেশে গেলে সিম পরিবর্তন করলে হোম নম্বরের অ্যাকসেস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেন গ্রাহকরা। ই-সিম এই সমস্যা থেকে গ্রাহকদের মুক্তি দিতে পারে।
এই প্রযুক্তি ফোন নির্মাতাদের একটি সুবিধা দেয়। প্রযুক্তিবিদদের ধারণা এটি ফোন নির্মাতাদের আরো ছোট ডিভাইস তৈরিতে উৎসাহ দিবে। কারণ যে ডিভাইসে ই-সিম যুক্ত করা হবে সেখানে সিম-ট্রে কিংবা আনুসাঙ্গিক সকল ট্রে সরিয়ে ফেলা হবে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে সিম তৈরি বা বিপণন করার জন্য বাজারে লোকবল বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না।
এছাড়াও ল্যাপটপ, ট্যাবলেট মতো দ্রুত ডিভাইসের জন্যেও ই-সিম আদর্শ প্রযুক্তি হতে পারে। কারণ এই ধরণের ডিভাইসে বিরামহীন ইন্টারনেট প্রয়োজন পড়ে যার নিশ্চয়তা শুধুমাত্র ই-সিম দিতে পারে।
ভোডাফোন (Vodafone) ইতোমধ্যেই ই-সিমের ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ই-সিম ব্যবহারের জন্য ডিভাইসে বাড়তি কোনো জায়গা কিংবা চিপসেট প্রয়োজন পড়েনা বলে এই প্রযুক্তি ইন্টারনেটের সঙ্গে অতীতের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ হতে পারে। অতীতে বহু চেষ্টার পরেও ফিটনেস ট্র্যাকার, এবং ডিজিটাল চশমা প্রযুক্তিকে স্ট্যান্ড অ্যালোন, ফোর-জি, ফাইভ-জি প্রযুক্তিতে যুক্ত করতে পারেননি গবেষকরা। কিন্তু ই-সিমের বিপ্লবে সেটিও এখন সম্ভব হয়েছে।
ই-সিমের অসুবিধাসমূহ
পছন্দের ক্ষেত্রে এটি গ্রাহকদের জন্য একটি অসুবিধা হতে পারে। যদি একটি ফোন কোম্পানি একচেটিয়াভাবে এই প্রযুক্তিটি বিক্রি করা শুরু করে তাহলে অন্য ফোন সেট গ্রাহকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে না। তখন দেখা যাবে হ্যান্ডসেটগুলো শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের সঙ্গেই প্রি-লোড হবে যার ভবিষ্যৎ অনেকটাই সংকুচিত।
এছাড়াও গ্রাহকেরা তাদের ব্যবহৃত নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ না করলে সহজে ই-সিম পরিবর্তন করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রেও একটি সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়, যেটি খুব সহজেই সমাধানযোগ্য নয়! আমরা জানি যে, ক্লাউড ব্যাকআপে সিম কার্ডের তথ্য এবং নম্বর সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই জনপ্রিয়, সহজলভ্য। কিন্তু যেসব ব্যবহারকারী অপেক্ষাকৃত কমদামী ফোন ব্যবহার করেন তাদের জন্য সিম থেকে ই-সিমে পদার্পণ করা সহজ হবে না।
তাই বলা যায় এটি যতোটা প্রযুক্তি সহায়ক ততটাই অসুবিধাজনক। হয়তোবা অদূরভবিষ্যৎ দিনগুলোতে মানুষ ই-সিমে আসার জন্যেই ডিভাইস পরিবর্তন করবে। কিন্তু একটি ডিভাইসে নির্দিষ্ট অপারেটরের ই-সিম আমাদের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে কতোটা ব্যবসা সফল হবে বলা কঠিন। কারণ অতীতে সিটিসেল একটি সিমের ডিভাইস বাজারে এনে দেউলিয়া হয়েছিল। বর্তমানে ই-সিম হলেও প্রযুক্তিটি যেহেতু একই সেহেতু আশঙ্কা থেকেই যায়। কারণ অপারেটর পরিবর্তনের জন্য গ্রাহক অবশ্যই তার বর্তমান অপারেটরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশে ই-সিম কতোটা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে।
কোন কোন স্মার্টফোনে ই-সিম রয়েছে?
ই-সিম গ্রহণের দিক দিয়ে অ্যাপল সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। মার্কিন বাজারের জন্য নকশা করা সব আইফোন ১৪ স্মার্টফোন সম্পূর্ণরূপে ই-সিমের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন বাজারের বাইরের জন্য তৈরি মডেলগুলোতে ফিজিক্যাল সিম কার্ডের পাশাপাশি ই-সিম ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। ২০২০ এবং ২০২২ এর ছোট আইফোন এসই সহ; আইফোন ১১, এক্সএস, এক্সআর, ১২ এবং ১৩ সিরিজের ডিভাইসগুলোর সবগুলোই ই-সিম সাপোর্ট করে। অ্যান্ড্রয়েডের দিক দিয়ে বেশ কয়েকটি পিক্সেল এবং স্যামসাং ডিভাইসে ই-সিম সাপোর্ট করে। পিক্সেল ২ থেকে পিক্সেল ৭ প্রো পর্যন্ত প্রতিটি পিক্সেল ডিভাইস ই-সিম সাপোর্ট করে। সব স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২০, এস২১, এবং এস২২ সিরিজের স্মার্টফোন ই-সিম সাপোর্ট করে। এ ছাড়া স্যামসাং ফ্লিপ অ্যান্ড ফোল্ড সিরিজ এবং নোট ২০ সিরিজ ই-সিম সাপোর্ট করে।
অপো ফাইন্ড এক্স৩, এক্স৩ প্রো, এক্স৫, এবং এক্স৫ প্রো সবই ই-সিম সাপোর্ট করে থাকে। এ ছাড়া সনি’র এক্সপেরিয়া ১ আইভি, সনি এক্সপেরিয়া ৫ আইভি, সনি এক্সপেরিয়া ১০ থ্রি লাইট, এবং সনি এক্সপেরিয়া ১০ আইভি ই-সিম সাপোর্ট করে। ই-সিম সম্পূর্ণরূপে নতুন কোনো প্রযুক্তি নয়। এটি বেশ অনেকদিন থেকেই আছে। কিন্তু এর বেশ কিছু সুবিধা থাকা সত্ত্বেও গ্রাহকদের মধ্যে এটি নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। স্মার্টফোন নির্মাতারা এটি ধীর গতিতে গ্রহণ করছে। তবে ই-সিম ধীরে ধীরে গ্রহণ করা হলেও এর রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। ই-সিম গ্রহণে অ্যাপলের সাম্প্রতিক সাহসী পদক্ষেপ আরও অনেক অ্যান্ড্রয়েড ব্র্যান্ডকে প্রায় নিশ্চিতভাবে সেদিকে ধাবিত করবে। আমরা দেখেছি অ্যাপল যখন হেডফোন জ্যাক সরিয়ে পানিরোধী পরীক্ষায় সফল হয়। অ্যান্ড্রয়েড নির্মাতারা সেটি অনুসরণ করে। এবারও প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় অ্যান্ড্রয়েড নির্মাতারাও একসময় এতে যোগ দেবে।
এসডব্লিউএসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ