ভারতে কলকাতার অ্যাপোলোর মতো পাঁচতারা হাসপাতালে অপারেশন টেবিলে কার্যত যৌন নিগৃহিতার মুখোমুখি এক নারী। দিলেন নাতিদীর্ঘ লোমহর্ষক বর্ণনা।
যৌন নির্যাতিতা, বিশেষ করে অপারেশন থিয়েটারে অজ্ঞান অবস্থায়, অর্ধচেতনে থাকা যে নারীকে যৌন নির্যাতন করা হয় তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ এককথায় কঠিন। কিন্তু নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন।
দক্ষিণ কলকাতার গড়ফার বাসিন্দা ৩৯ বছর বয়সী নারী জানালেন, ‘অ্যানেস্থেসিয়ার ঘোর তখনও কাটেনি, বুঝতে পারছিলাম আমার ডানদিকে দাঁড়ানো লোকটি কিছু একটা ঘটাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম সব কিছু, কিন্তু অর্ধ চেতন ছিলাম। কিছু করবো সেই ক্ষমতা ছিলো না।’
এরপর অশ্রু সজল কণ্ঠে নির্যাতিতা বলেন, ওই অবস্থায় যন্ত্রণায় আমার বাম চোখে জল চলে আসে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রলিতে আমার বাঁ পাশে দাঁড়ানো লোকটি বলে, আরে এর তো জ্ঞান ফিরে এসেছে। এরপর ওরা দ্রুত আমাকে বেডে নিয়ে যায়।
এরপর জ্ঞান ফিরতেই নির্যাতিতা তার স্বামীকে দিয়ে ফুলবাগান থানায় এফআইআর দায়ের করেন। হইচই শুরু হয়। শুরু হয় ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাও।
ওই নারী বলেন, লালবাজার থেকে এক মহিলা পুলিশ অফিসার মৌসুমী চক্রবর্তী আসেন এবং তার ক্ষত পরীক্ষা করে বলেন যে, খুব বিশ্রীভাবে তার ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার অপারেশন হয় গলব্লাডারের। তারপরই এই ঘটনা। নির্যাতিতা জানান, ঘটনার সময় অপারেশনকারী চিকিৎসক ওখানে ছিলেন না। সোমবার নির্যাতিতা কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছেন সুবিচারের আশায়।
কারণ, তার মনে হচ্ছে ঘটনাটি চাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। শনিবার রাতে অ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তারা একটি ছাপানো বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে।
বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, এক রোগিনী হাসপাতালে অপারেশনের পর তার সঙ্গে ঘটা এক ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। যথাযথ ব্যবস্থাটি কী তা বলা হয়নি। পুলিশের আচরণও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। যেমন ঊর্ধ্বে নয় অ্যাপোলো হাসপাতালের আচরণও।
হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়ার ঘোরে থাকা নারীর ওপর নির্যাতন সম্পর্কে আদালত কী বলে তার অপেক্ষায় সবাই। নির্যাতিতা নারী অবশ্য শেষ দেখতে চাইছেন। তার কথা, আর কাউকে যেন কখনও অজ্ঞান অবস্থায় আমার মতো অভিজ্ঞতার শিকার হতে না হয়!
তবে ভারতীয় নারীদের যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা অনেকটাই দৈনন্দিন হয়ে উঠেছে। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী দেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বাড়ছে। দেশটিতে প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হন অন্তত ৮৬ জন নারী। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) তাদের ২০২১ সালের জরিপ প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে।
এনসিআরবির প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে ২০২১ সালে নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা ৪ লাখ ২৮ হাজার ২৭৮। এর মধ্যে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৩১ হাজার ৬৭৭টি। সেই হিসেবে ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৮৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এ ছাড়া, দেশটিতে প্রতি ঘণ্টায় নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়।
ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে এগিয়ে রাজস্থান। রাজ্যটিতে বিগত বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬ হাজার ৩৩৭ জন। রাজস্থানের পরেই মধ্যপ্রদেশের অবস্থান। রাজ্যটিতে ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৯৪৭ জন। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা মহারাষ্ট্রে গত বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৪৯৬ জন। এরপরের স্থান দুটি উত্তর প্রদেশ ও দিল্লির। রাজ্যটি দুটিতে গত বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন যথাক্রমে ২ হাজার ৮৪৫ এবং ১ হাজার ২৫০ জন। তবে ভারতীয় শহরগুলোর মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হন দিল্লিতেই। আর সবচেয়ে নারীদের জন্য নিরাপদ শহর কলকাতা।
এদিকে, নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে উত্তর প্রদেশ। প্রতি লাখ হিসাবে ভারতে নির্যাতিতার গড় ৬৪.৫। এই গড় অনুযায়ী গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আসামের। রাজ্যটিতে প্রতি লাখে গড়ে ১৬৮ দশমিক ৩ জন নারী নির্যাতিতা হন। এরপরই কেন্দ্রশাসিত দিল্লি এবং তারপরই ওডিশার অবস্থান।
এসডব্লিউএসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ