বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ডলার সংকটের ক্ষত এখন বেশ জোরেশোরেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সামনের দিনগুলোয় বিষয়টি বড় ধরনের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। এ নিয়ে তাদের বক্তব্য হলো একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলেও এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি।
আবার ডলার সংকটে এখন প্রয়োজনমাফিক জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ভুগছে জ্বালানি সংকটে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তা বাংলাদেশের সার্বিক ঋণমানে প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি এ ঋণের বোঝা একপর্যায়ে রাষ্ট্রের ওপর এসে বর্তানোরও বড় আশঙ্কা রয়েছে।
জড়িয়ে যাচ্ছে ঋণের জালে
বৃহৎ ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর নিজ নিজ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মীয়মান ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৪৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৭৬ কোটি ডলারের ঋণ অর্থায়ন হয়েছে চীনা উৎস থেকে।
নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪৯ কোটি ৯২ লাখ ডলার। ওরিয়ন গ্রুপের সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ৮৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশী উৎস থেকে গৃহীত বেসরকারি খাতের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের স্থিতি চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮১৯ কোটি ডলারের বেশি, যার মধ্যে ৪১০ কোটি ডলারই নিয়েছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ ঋণের একটি অংশ এখন খেলাপি হওয়ার পথে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তাদের ভাষ্যমতে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও রিজার্ভ সংকট বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। তারা চাইলেও মধ্যস্থতাকারী দেশী ব্যাংকগুলো বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে উদ্যোক্তারা নির্দিষ্ট সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। বিদেশীদের কাছে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচতে এরই মধ্যে কেউ কেউ ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। আবার ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান মেয়াদ বৃদ্ধিতে অসম্মত হলে অন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বেশি সুদে ঋণ নিয়ে দায় সমন্বয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদ্যুতে বড় প্রকল্পগুলোর বিপরীতে বিদেশী ঋণ আছে। এগুলো যদি ঋণগ্রহীতা দিতে না পারেন, তাহলে যিনি গ্যারান্টার তিনি পরিশোধ করবেন। বিষয়টি বিবেচনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্যই ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যে দায় সৃষ্টি হয়, সেটাকে কনটিনজেন্ট লায়াবিলিটি (বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটলে যে দায় সৃষ্টি হয়) বলা হয়। এ ধরনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গিয়েছে। কোনো কোনো উদ্যোক্তা হয়তো প্রকৃত অর্থেই বিপদে পড়বেন। আবার কেউ কেউ এর সুযোগও নিতে পারেন। দুদিক থেকেই ঝুঁকিটা বাড়ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকেও বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ পাওনা অর্থ পাচ্ছে না বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিক্রি করার কথা। যদিও বছর বছর লোকসান ও দায়দেনার বোঝা ভারী হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির বেসরকারি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে সময়মতো বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ মূল্য পরিশোধের সক্ষমতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) জানিয়েছে, বর্তমানে শুধু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) কাছেই বিপিডিবির দেনা রয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
উৎপাদন নিয়ে সমস্যা
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম এখন পড়তির দিকে থাকলেও স্পট মার্কেট থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মূল জ্বালানি এলএনজি আমদানি করতে পারছে না বাংলাদেশ। মার্কিন একটি কোম্পানির সঙ্গে এলএনজি আমদানিতে সমঝোতা হয়েছে সামিট গ্রুপের। যদিও ডলার সংকটের কারণে উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বড় প্রকল্পগুলোর প্রায় সব’কটিতে সরকারের গ্যারান্টি আছে। যেগুলো এরই মধ্যে সচল হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একদিকে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি করে ফেলেছে, অন্যদিকে যেটুকু উৎপাদন হচ্ছে, সঞ্চালন লাইনে বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে সেটিকে গ্রাহকের কাছে নেয়া যাচ্ছে না, যা এক ধরনের অদূরদর্শিতার প্রমাণ।
এমন পরিস্থিতিতেও নতুন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। কিছু প্রকল্প যৌক্তিকতা ছাড়া নবায়নও করা হচ্ছে। বর্তমান সংকট সাময়িক নয় আবার দীর্ঘমেয়াদিও নয়। অন্তত আরো ছয় মাস থেকে এক বছর থাকতে পারে। যদি ডলার সংকট থাকে তাহলে প্রতিটি প্রকল্পই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অনেক বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। আমাদের ক্ষতি ও ঝুঁকি বেশি হয়ে যাচ্ছে, যা সামনে আরো বাড়বে।
এসডব্লিউএসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ