বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপদজনক মাত্রায় চলে গেছে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিদ্যুতের লোডশেডিং করাসহ সাশ্রয়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যাতে জ্বলানি আমদানির খরচ নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। এর মধ্যেই বাংলাদেশ আইএমএফ’র ঋণ পাচ্ছে। প্রথম কিস্তিতে শর্তহীন হলেও পরবর্তী কিস্তিগুলো কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সরকার পাবে। আমরা ধরে নিই এই ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তি আর তার ৬ মাস পরে আরেকটি কিস্তি সরকার পেলো। অর্থাৎ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী নির্বাচনের আগে আইএমএফ’র দুইটি কিস্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ হবে এক বিলিয়ন ডলারেরও কম। সরকার অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ চাইছে। সরকার প্রত্যাশিত সব ঋণ পেলে সেটা আইএমএফ’র ঋণ সহ সাকুল্যে আড়াই বিলিয়ন ডলার হবে। এতে কিছুটা স্বস্তি পেলেও রিজার্ভ যেন গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে সরকাররের। চলুন জেনে নেওয়া যাক প্রকৃত চিত্রটা।
রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র
সরকারের দিক থেকে রিজার্ভের যে পরিমাণ আমাদের জানানো হচ্ছিল, সেটা থেকে কমপক্ষে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে; এই আলোচনা দেশে অর্থনীতিবিদ এবং সচেতন মানুষ দীর্ঘদিন থেকেই করছিলেন। কিন্তু সরকার সেটাই কান দেয়নি। ক্রমাগত একই প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গেছে। সেটা আপাতত ভেঙে পড়লো আইএমএফ এর কারণে।
লেনদেনের ভারসাম্যের সমস্যা লাঘবের জন্য আইএমএফ’র কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের আবেদন করেছে সরকার। এক্ষেত্রে আইএমএফ অনুমিতভাবেই বেশকিছু শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চর্চা এবং মানদণ্ড মেনে নিতে হবে। শেষপর্যন্ত সরকার সেই ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে রিজার্ভ হিসাব করতে বাধ্য হয়েছে।
আইএমএফ’র প্রতিনিধিদল দেশে থাকাকালীন সময়ে রিজার্ভের পরিমাণ কত এই প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর জানিয়েছিলেন সেই আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে। এখানেও দেখলাম সেই পুরনো বিষয়, দেশের নাগরিকদের কথাকে সরকার পাত্তা না দিয়ে নতি স্বীকার করেছে বৈদেশিক চাপের কাছে।
এবার প্রশ্ন, কোন আট বিলিয়ন ডলার বাদ দেয়ার কথা হচ্ছে। সরকার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, ইডিএফ) এ ৭ বিলিয়ন ডলার দিয়েছিল রিজার্ভ থেকে। কাগজে-কলমে বলা হয়েছিল রপ্তানিকারকরা যখন তার কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করেন তখন এই ফান্ড থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেবেন এবং সেটা দিয়ে পণ্য প্রস্তুত করে রপ্তানির পর সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রায়ই ঋণ পরিশোধ করবেন। এছাড়া আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে রিজার্ভের ডলার ব্যবহার করা হয়েছিল।
বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, পায়রা বন্দরের ড্রেজিং, বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ কেনা এবং শ্রীলঙ্কাকে ধার দেয়া বাবদ মোট ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ সর্বমোট আট বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দেয়ার কথা হচ্ছে। যারা গভীর অর্থনীতির জ্ঞান রাখে না, তারাও নিশ্চয়ই এটুকু বুঝতে পারছি, আলোচ্য খাতগুলোতে যে ডলার ব্যয় করা হয়েছে তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই সেগুলো নয়-ছয় হয়নি তবুও সেই ডলার কি আমরা ‘চাহিবামাত্র’ হাতে পাবো? সেই ডলার কি আমি ব্যবহার করতে পারবো?
রিজার্ভের ক্ষেত্রে মুহূর্তের সিদ্ধান্তে ব্যবহারযোগ্য নগদ অর্থ ছাড়া কোনো বিনিয়োগ রিজার্ভ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। তদুপরি এই বিনিয়োগের অর্থও নষ্ট হয়েছে বিরাট অংকে। এই মুহূর্তে সরকারের দাবি করা ৩৪ বিলিয়ন ডলার নয়, বাংলাদেশের সত্যিকার রিজার্ভ (ব্যবহারযোগ্য) আছে ২৬ বিলিয়ন ডলার।
এই রিজার্ভ কি যথেষ্ট?
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই রিজার্ভ আসলে কতোটা এবং এটা আমাদের সামনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কি আদৌ যথেষ্ট? আমরা জানি, বাংলাদেশ অনাদিকাল থেকেই ট্রেড ডেফিসিট-এর দেশ। অর্থাৎ ডলারের অংকে আমরা রপ্তানি যতটা করি, আমদানি করি তার চাইতে অনেকটা বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার এই ঘাটতি পূরণ করে আমাদের রিজার্ভ থাকার এবং কখনো বাড়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিটেন্স। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে যোগ হয় বৈদেশিক রাষ্ট্র, ব্যাংক এবং দাতা সংস্থার ঋণ এবং বিদেশিদের বাংলাদেশ সরাসরি বিনিয়োগ (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, এফডিআই)।
সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে যত, আয় হয়েছে তার চাইতে অনেক কম। ফলে রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে খুব দ্রুত। তার চাইতেও বড় কথা যে গতিতে এতদিন রিজার্ভ কমছিল, সামনের পরিস্থিতি আরও অনেক খারাপ এবং রিজার্ভ কমার গতি বাড়বে আরও অনেক বেশি। নাগরিকদের মধ্যে যথেষ্ট আলোচনা নেই, কিন্তু আমাদের দেশের রিজার্ভের ওপরে সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি করতে যাচ্ছে কতোগুলো স্বল্পমেয়াদি বেসরকারি ঋণ এবং কতগুলো পিছিয়ে দেয়া (ডেফার্ড) এলসি’র মূল্য পরিশোধ।
বৈদেশিক ঋণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুন শেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল আট দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের জুন শেষে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দুই বছরে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৯ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর স্বল্পমেয়াদি বেসরকারি ঋণ দ্রুত বেড়েছে।
দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বায়ার্স ক্রেডিট (এটা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নয়)। বায়ার্স ক্রেডিট হচ্ছে কোনো আমদানিকারককে কোনো রপ্তানিকারক নিজে অথবা কোনো বৈদেশিক ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় দেয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ। ২০২০ সালের জুনে বায়ার্স ক্রেডিটের পরিমাণ ছিল চার দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার ও ২০২২ সালের জুনে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দুই বছরে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়েছে পাঁচ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার বা ১০৯ শতাংশ।
এই ঋণের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এগুলো পরিশোধ করতে হয় ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে। অর্থাৎ এর মধ্যে বেশকিছু ঋণ এই বছর শেষ হওয়ার আগেই পরিশোধ করতে হবে এবং বাকিটা করতে হবে আগামী বছরের জুনের মধ্যে। এদিকে ব্যাংকগুলোর উপর একটা প্রচণ্ড বড় চাপ তৈরি করছে করোনার সময় এবং তার পরে মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া (ডেফার্ড) এলসি’র দায় পরিশোধ। এই ধরনের এলসি’র দায় সর্বমোট কত আছে পুরো অংকটা স্পষ্টভাবে জানা যায় না, কিন্তু এটাও কয়েক বিলিয়ন ডলার হবে।
তবে এই অংক সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারবো বর্তমানের একটা ঘটনা থেকে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো যে অসংখ্য পণ্যের এলসি খুলছে না শতভাগ মার্জিন দেয়ার পরও তার প্রধান কারণ ব্যাংকগুলো এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডেফার্ড এলসি’র দায় পরিশোধ করছে। এসব কিছুর সঙ্গে আছে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দুই বিলিয়ন ডলারের মতো বকেয়া। এই ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে অকল্পনীয় পরিমাণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা এবং ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া নিয়ে আমাদের দেশে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল।
কিন্তু আমরা এখন দেখতে পারছি এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনেকগুলোকেই বিদ্যুতের মূল্য এবং ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছিল বৈদেশিক মুদ্রায়। অর্থাৎ মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রার নয়-ছয় হয়েছে এই খাত থেকেই। শীতের সময়টা সরকার কিছুটা স্বস্তিতে আছে এক দিক থেকে। বিদ্যুতের চাহিদা কম আছে বলে সরকারকে প্রাথমিক জ্বালানি কম আমদানি করলেও চলছে। কিন্তু এই সহনীয় সময়টা থাকবে সর্বোচ্চ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ মার্চেই যখন প্রচণ্ড গরম পড়তে শুরু করবে তখন দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে অনেক বেশি। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল এবং গ্যাসের মতো প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি বৃদ্ধির বিরাট চাপ যুক্ত হবে।
আগে যেসব ঋণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেয়া বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ। কিন্তু সরকারের নিজের সরাসরি দায় আছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য কোনো দেশ থেকে (লাইন অব ক্রেডিট, এলওসি) কিংবা আন্তর্জাতিক ব্যাংক এবং সংস্থা থেকে ঋণের সুদ এবং কিস্তি পরিশোধ। এই অর্থবছরেই ২.৭৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে এই বাবদ, যা আগামী অর্থবছরে হবে ৩.২৮ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় মূল্যপতন হতে পারে খুব দ্রুত। গণমাধ্যমগুলোতে সরকার দ্রুত বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে বলেছে। একটি দেশ যেটি রিজার্ভের সংকটে পড়ে গেছে, যে দেশে জ্বালানি সংকটের কারণে খোদ রাজধানীতে দিনে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছিল শীতের আগেই, যে দেশে সামনে একটা নির্বাচনকে ঘিরে চরম অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সে দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সহজে এবং সহসা বিনিয়োগ করতে আসবেন, এটা মনে করার আসলে কোনো কারণ নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ