প্রায় পাঁচ বছর পরিত্যক্ত ছিল সিলেটের বিয়ানীবাজর গ্যাসক্ষেত্রের ১ নম্বর কূপ। এবার এই কূপ থেকেই নতুন করে গ্যাস-সংযোগ দেয়া হয়েছে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে। সোমবার সন্ধ্যায় এই সংযোগ দেয়া হয়। প্রথম দিন থেকেই এই সংযোগের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে প্রতিদিন ৮০ লাখ (৮ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস। উল্লেখ্য, ২৩ বছর গ্যাস তোলার পর পাঁচ বছর আগের পরিত্যক্ত বিয়ানীবাজার-১ গ্যাসকূপে আবারও গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উত্তোলনের পর গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করার পর ২০১৭ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে কূপটি ফেলে রাখা হয়।
এদিকে সম্প্রতিই জানা যায় বর্তমানে যে মজুদ আছে তা দিয়ে আগামী নয় বছর চলা যাবে। বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ যে নিম্নগামী সে সম্পর্কে কয়েক বছর আগে থেকে পেট্রোবাংলা তাদের পূর্বাভাসে দেখিয়ে আসছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে এই ঘটনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন না বাড়ানোর ফলে এই খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে, আর সে কারণেই এখন বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে তীব্র সংকট। অর্থাৎ আমদানি নির্ভরতাই মূলত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
এদিকে, নতুন এই সরবরাহ শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফএল) মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল প্রামাণিক বলেন, ‘সকাল থেকেই সঞ্চালন লাইনে গ্যাস সরবরাহ শুরুর কথা ছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আজ সারা দিন আমরা গ্যাস ফ্লো আউট করি। এরপর সন্ধ্যা ৬টা থেকে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ শুরু করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে রোববার বিকেলে আমরা পরীক্ষামূলক সব কাজ সম্পন্ন করি। গ্যাসের চাপ পরীক্ষার (টেস্টিং) কাজও রোববার সম্পন্ন হয়।’
১ নম্বর কূপ থেকে প্রতিদিন ৮০ লাখ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি একই গ্যাসক্ষেত্রের ২ নম্বর কূপ থেকেও প্রতিদিন ৭০ লাখ ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।
এসজিএফএল সূত্রে জানা গেছে, বিয়ানীবাজার গ্যাসক্ষেত্রটি সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফএল) আওতাধীন। এই গ্যাসফিল্ডের ১ নম্বর কূপ থেকে ১৯৯১ সালে গ্যাস তোলা শুরু হয়। ২০১৪ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে আবার উত্তোলন শুরু হলেও ওই বছরেরই শেষ দিকে তা আবারও তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকেই এই কূপটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ওই কূপে নতুন অনুসন্ধান চালিয়ে আবারও গ্যাসের মজুত পায়। ১০ নভেম্বর ওই কূপে গ্যাসের মজুতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর গ্যাসের চাপ পরীক্ষা শেষে কূপ থেকে দ্রুত জাতীয় সঞ্চালন লাইনে গ্যাস দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়।
এসজিএফএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে এই কূপের ৩ হাজার ২৫৪ মিটার গভীরে ৭০ বিলিয়ন (৭০০ কোটি) ঘনফুটের বেশি গ্যাস মজুত আছে। গ্যাসের চাপ পরীক্ষার পর দেখা গেছে কূপটি দৈনিক ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে সক্ষম।
‘তবে কারিগরি বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে দৈনিক ৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এতে দৈনিক ১২৫ থেকে ১৩০ ব্যারেল ঘনীভূত তরল (কনডেন্সড) গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
দেশে গ্যাস সংকটের সময়ে এ কূপ থেকে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে গ্যাস সরবরাহ একটি আনন্দের সংবাদ উল্লেখ করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ত্রিমাত্রিক সিসমিক জরিপও চলছে। সেই জরিপ থেকে নতুন গ্যাস ফিল্ড পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০২৫ সাল নাগাদ দেশের সব কোম্পানি প্রায় ৪৬টি কূপ খননের মাধ্যেমে ৬১ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট গ্যাস বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।’
বর্তমানে এসজিএফএল এর আওতায় পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র আছে। এগুলো হলো হরিপুর গ্যাস ফিল্ড, রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড, ছাতক গ্যাস ফিল্ড, কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ড ও বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড।
এর মধ্যে ছাতক গ্যাস ফিল্ড বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। বাকিগুলোর ১২টি কূপ থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ৯ কোটি ১০ লাখ ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এ বছরের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, নতুন গবেষণায় তারা বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলছেন, ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর দেশটি সাগরে তাদের অংশে গ্যাসের অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে ব্যাপক বিনিয়োগ করে।
ফল হিসেবে তারা এখন সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করে নিজেরা ব্যবহারের পর চীনে রপ্তানিও করছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটি গত ১০ বছরেও হয়নি বলে বলছিলেন অধ্যাপক ইমাম।
তিনি বলেছেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং সংকটের মুখে অনাবিষ্কৃত এ ক্ষেত্রটিতে দ্রুত অনুসন্ধান শুরু করা প্রয়োজন, একমাত্র তাহলেই জ্বালানি খাতে স্বস্তি পাওয়া সম্ভব।
এসডব্লিউ/এসএস/২২৫২
আপনার মতামত জানানঃ