বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হওয়া সংজ্ঞা হচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা। দেশে প্রথম খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। তবে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাটি ছিল ১৯৯৪ সালের। এর পর থেকে যতগুলো সরকার এসেছে, সবাই এর সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালেও দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত ১৪ বছরে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
এদিকে, পাবনার ঈশ্বরদীতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় জেলে যাওয়া ১২ কৃষকের পরিবার দুশ্চিন্তায় আছে। আর ঋণের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া একই গ্রামের আরও ২৫ কৃষক গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়িছাড়া হয়েছেন।
বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে কৃষকরা
পরিবারগুলোর দাবি, কৃষকদের সবাই দরিদ্র। অনেকে ঋণের টাকা পরিশোধও করেছেন। এরপরও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন কীভাবে আদালতে যাবে, স্বজনদের জামিন করাবে, বুঝতে পারছে না পরিবারগুলো।
প্রসঙ্গত, অল্প টাকা ঋণের দায়ে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারি গ্রামের ৩৭ জন কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তাদের মধ্যে ১২ জনকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার সবাইকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
গ্রেপ্তার কৃষকেরা হলেন ভাড়ইমারি গ্রামের শুকুর প্রামাণিকের ছেলে আলম প্রামাণিক (৫০), মনি মণ্ডলের ছেলে মাহাতাব মণ্ডল (৪৫), মৃত সোবহান মণ্ডলের ছেলে আবদুল গণি মণ্ডল (৫০), কামাল প্রামাণিকের ছেলে শামীম হোসেন (৪৫), মৃত আয়েজ উদ্দিনের ছেলে সামাদ প্রামাণিক (৪৩), মৃত সামির উদ্দিনের ছেলে নূর বক্স (৪৫), রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আকরাম (৪৬), লালু খাঁর ছেলে মোহাম্মদ রজব আলী (৪০), মৃত কোরবান আলীর ছেলে কিতাব আলী (৫০), হারেজ মিয়ার ছেলে হান্নান মিয়া (৪৩), মৃত আবুল হোসেনের ছেল মোহাম্মদ মজনু (৪০) ও মৃত আখের উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আতিয়ার রহমান (৫০)।
সূত্র মতে, ভাড়ইমারি গ্রামটির বেশির ভাগ বাড়ি একচালা, দোচালা টিনের ঘর। গ্রামজুড়ে সবার মধ্যে চাপা আতঙ্ক। গ্রেপ্তারের ভয় যেন তাড়া করছে সবাইকে। নিজে থেকে কিছুই বলতে চাচ্ছেন না কেউ। অনেক কথার পর উত্তর মিলছে একটা। গ্রেপ্তার কৃষকদের পরিবারে চলছে নীরবতা। অন্য বাড়িতে পুরুষেরা নেই। গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি ছেড়েছেন তারা।
গ্রেপ্তার কৃষকদের স্বজন ও গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের গ্রামে ভাড়ইমারি উত্তর পাড়া সবজি চাষি সমিতি নামের একটি সমিতি রয়েছে। এতে মোট সদস্যসংখ্যা ৩৭। ২০১৬ সালে সদস্যরা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে গ্রুপভিত্তিক একটি ঋণ নেন।
তাদের প্রতিজনের ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অনেকেই এই ঋণের টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে অনেকের আবার ২ থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত বাকি আছে। সাতজন কৃষক টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে গ্রুপভিত্তিক ঋণের কারণে সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের রসিদ কোথায়, জানতে চাইলে কৃষকদের পরিবারের সদস্যরা সেটি দেখাতে পারেননি।
গ্রেপ্তার কৃষকদের পরিবারের দাবি, কৃষকদের সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। কেউ শ্রমিক, কেউবা ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা মামলার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। হঠাৎ করেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তারা বিষয়টি জানতে পেরেছেন।
ভাড়ইমারি উত্তর পাড়া সবজি চাষি সমিতির সভাপতি ও ছলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য বিলকিস নাহার জানান, স্বল্প সুদে কৃষকদের ঋণ দেওয়ার কথায় তিনি কৃষকদের জন্য এই ঋণের ব্যবস্থা করেন। সমিতির নামে মোট ১৬ লাখ টাকা ঋণ বরাদ্দ হয়। পরে ব্যাংক তাদের জানায়, ১৫ শতাংশ সুদ দিতে হবে। এত টাকা সুদের কথা শুনেই কৃষকেরা ক্ষিপ্ত হন। এরপরও তারা ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। এখন ব্যাংক আরও ১২ লাখ টাকা দাবি করছে। এত টাকা কৃষকদের দেওয়ার সামর্থ্য নেই। ফলে ব্যাংক মামলাটি করেছে।
বিলকিস নাহার বলেন, ‘আমি কৃষকদের উন্নয়নে ঋণের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু সেটা যে তাদের ক্ষতির কারণ হবে, জানতাম না। বিষয়টি নিয়ে নিজেই খুব বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছি। গ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া কৃষকদের জামিনের জন্য চেষ্টা করছি।’
ভাড়ইমারি গ্রামের কৃষকদের ঋণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড পাবনা শাখার ব্যবস্থাপক কাজী জসীম উদ্দীন বলেন, ‘আমি পাবনায় নতুন এসেছি। আসার আগেই মামলাটি হয়েছে। তাই বিস্তারিত জানি না। রোববার অফিস খুললে সব বুঝতে পারব।’
কথা হয় গ্রেপ্তার কৃষক রজব আলীর স্ত্রী বুলিয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার স্বামীর ৩০ হাজার টাকা ঋণ ছিল। তিনি ৩০ হাজার ৭৮৬ টাকা পরিশোধ করেছেন। এরপরও মামলা হয়েছে। তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন তিনি দুই সন্তান নিয়ে অসহায় বোধ করছেন।
বুলিয়া খাতুন বলেন, ‘আমরা তো মামলা লিয়ে কিছু জানতেম না। পুলিশ বাড়িত আসার পর জানবের পারছি। এহন কী হরব বুঝবের পারতেছিনে। খুব চিন্তে হচ্ছে। গিরামের মেম্বরের কাছে গেছিলেম, হে জামিনির কথা কয়ছে।’
ছলিমপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ওই গ্রামের বাসিন্দা মহির মণ্ডল বলেন, ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় পুলিশ প্রতিদিনই গ্রামে আসছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে সবাই বাড়ি ছেড়েছেন। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হওয়ায় নিজ দায়িত্বেই আমি সবার সঙ্গে কথা বলেছি। গ্রেপ্তার কৃষকদের প্রতিটি পরিবার দরিদ্র ও অসহায়। তারা আইন-আদালত কিছুই বোঝে না। সবাই আমাকে ধরেছে। কৃষকদের জামিনের জন্য আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে।’
ঋণ খেলাপিরা পায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। এখানে বছরের পর বছর ধরে খেলাপিদের নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। আইন সংশোধন করে একাধিকবার ঋণ তফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আর এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েই বড় বড় ঋণখেলাপি খেলাপির তালিকা থেকে বাইরে থেকে গেছেন। হয়েছেন আরও ক্ষমতাবান।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। আবার প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহক।’
খেলাপি ঋণ নিয়ে এবার সত্যিকারের নতুন এক বিপদে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এত দিন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ বাড়তে দেওয়া হয়েছে, আর এখন পরিস্থিতি সামাল নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যাংক খাতে। এখন দুষ্ট ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক ভালো ব্যবসায়ীও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে সামনে খেলাপি ঋণ আরও বেশি বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। সে সময় খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেওয়া হয়। তখন নিয়ম ছিল তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করা যায় না। কিন্তু বেশির ভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। এরপরেই ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ