করোনা মহামারি ও চলতি বছর দেশে চার দফা বন্যার কারণে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার এ বছর কর্মহীন, অসহায় মানুষদের প্রচুর পরিমাণে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে। ফলে সরকারের মজুত খাদ্যের পরিমাণ দ্রুত কমেছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। খাদ্য মন্ত্রণালয় কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও এই চক্রকে চালের দাম বাড়ানো থেকে নিবৃত রাখা যায়নি। এখন আমনের ভরা মৌসুমেও তারা চালের দাম বাড়াচ্ছে।গত দুই-তিন দিনের ব্যবধানে রাজধানীসহ সারা দেশে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর চার দফা বাড়ল চালের দাম।
এখন আমনের ভরা মৌসুম। প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতে ধান-চালের দাম কম থাকে। কিন্তু এবার উলটো ঘটনা ঘটেছে। দাম বেশি। ধানের দাম গত মৌসুমের তুলনায় মণপ্রতি দুই শ থেকে আড়াই শ টাকা বেশি। বেশি চালের দামও। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে সরু চাল নাজিরশাইল/মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, মোটা চাল ইরি/স্বর্ণার ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ, আর মাঝারি মানের চাল পাইজাম/লতার দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
জানা যায়, গত বছর আমন মৌসুমে ১ কোটি ৫৫ লাখ টনের কিছু বেশি চাল উৎপাদন হয়েছিল। তবে চলতি আমন মৌসুমে বন্যায় ৩৫টি জেলার আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমন চালের উৎপাদন প্রায় ১০ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কমে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার টনে নামতে পারে। কিন্তু তাতে দেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই।
পরপর তিনটি ফসলের মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন। কম দামে বিদেশ থেকে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারি গুদামে সবচেয়ে বেশি চালের মজুদ। তারপরেও কেন এমন হবে চালের বাযার?
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো সেই শক্তিশালী কারসাজি চক্রই এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিংয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় অধরাই থেকে গেছে চক্রটি। সরকারি নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় পণ্যের দাম বাড়ায় বলে তারা মনে করেন।
এদিকে উত্তরবঙ্গে হাজার হাজার টন ধান মজুতে সৃষ্ট সংকটেই চালের দাম বেড়েছে বলে মিলারদের অভিযোগ। তারা বলছেন, ধান মজুতের ফলে দাম বেশি, এ কারণেই চালের দাম বাড়ছে। এছাড়া দেশে ৩৫টি জেলায় চার দফা বন্যার একটা প্রভাব পড়েছে। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের বড় অংশ মিলাররা নিজেরাও কিনে মজুত করেছেন। এছাড়া এখন প্রান্তিক কৃষকের হাতে ধান নেই। তাই ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে চালের দাম বাড়ছে—এই অজুহাত ঠিক না।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দাম বাড়ুক-কমুক চাষিরা যেন সরাসরি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বেচতে না পারে-এ ব্যাপারে করণীয় সবই করছে এই সিন্ডিকেট। তাদের চেইন গ্রামের ক্ষেত-খামার থেকে রাজধানীসহ দেশের সকল মোকামে-আড়তে। অধরা এরা। ধরা খাওয়ার তালিকায় শুধু কৃষক আর সাধারণ ক্রেতারা। নিজেদের উৎপাদিত চালের দাম কমতি-বৃদ্ধি দুটোর একই ফল কৃষকদের জন্য। বাজারে দাম বাড়লে তাদের হাতে বাড়তি কিছু যায় না। আর কমলে তাদের প্রাপ্তিও কমে। সাধারণ ক্রেতাদের ভাগ্যও কাছাকাছি। দাম কম-বেশি যা-ই হোক পকেট খসছেই তাদের। আবার সরকারও উভয় সংকটে। দাম বাড়লে ক্রেতারা গালমন্দ যা করার সরকারকেই করে। ফড়িয়াদের দোষে না। চেনেও না। সব দোষ ছোড়ে সরকারের দিকে। আর দাম পড়ে গেলে কৃষকদের বদদোয়ার টার্গেটও সরকার। মাঝখানে ফায়দা উসুলের স্টিয়ারিংয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এদের দৌরাত্ম্য ঠেকানোর সরকারি নানা উদ্যোগ মার খাচ্ছে। মাঝখানে ফায়দা লুটে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। লোকসানের কোনো ঝুঁকিতেই নেই মধ্যস্বত্বভোগীরা। শীত-গরম, রোদ-বৃষ্টি, বন্যা-খরায় কিছু যায় আসে না তাদের। করোনা-কলেরায়ও লোকসান গুনতে হয় না এদের। বাজারকে অস্থির করার যাবতীয় কৌশল রপ্ত করা এই চক্র কৃষক, ক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, সরকার সবাইকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে যাচ্ছে। সরকারের নানা উদ্যোগ এবং অভিযানেও দিব্যি অধরাই থাকছে।
মূলত বাজারে নজরদারি ভেঙে পড়ায় এমন হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এ কারণে বাজারের এই অবস্থা। এ কথা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, সরকারের নজরদারির অভাবে দেশে এখন চাইলেই যে কেউ পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। ব্যবসায়ীদের এই চক্রের সাথে সরকারের উপর মহলের কেউ জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার। যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাদের কেউ এই চক্রের সাথে জড়িত কি না তা-ও দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর কারণ দেখা যাচ্ছে নীতিনির্ধারণ জনবান্ধব নয়। সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর বেশির ভাগ হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। সে জন্য নাগরিকদের মধ্যে মাঠপর্যায়ে অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাবান কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে ব্যবসায়ী চক্রকে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দিচ্ছেন।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১১৫০
আপনার মতামত জানানঃ