বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার পথে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত চীন ক্রমেই শিল্পোৎপাদন বাড়িয়ে তুলছে। এর সঙ্গে বাড়ছে দেশটির শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানি ক্ষুধাও। এ ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করছে দেশটি। হয়ে উঠেছে বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল আমদানিকারক। চীন নিজে আমদানিনির্ভর হলেও এ দেশই আবার বাংলাদেশে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানি তেল (গ্যাসোলিন, ডিজেল, ফুয়েল অয়েল, কেরোসিন, লুব্রিক্যান্ট ইত্যাদি) আমদানির সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর একটি।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে কভিডের প্রাদুর্ভাবে বাণিজ্য খাতে ভাটা পড়লেও ওই সময় দেশটি থেকে দেড় হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল বা পেট্রোলিয়াম আমদানি হয়েছে প্রায় ৭৭ কোটি ডলারের। সে সময় দেশে আমদানীকৃত পরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের ২৯ শতাংশেরও বেশি এসেছে চীন থেকে।
চলতি ২০২২ সালের আগস্টেও চীন থেকে পণ্য আমদানির তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে ছিল পরিশোধিত জ্বালানি তেল। এ সময় দেশটি থেকে ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
নিজেই আমদানিকারক হওয়ায় পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম রফতানিতে চীনের কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ বা তুলনামূলক সুবিধা তেমন একটা নেই। ওইসি ছাড়াও ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের নানা গবেষণায় ও পর্যবেক্ষণেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণভিত্তিক একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন নানজিংভিত্তিক হোহাই ইউনিভার্সিটি এবং জিয়াংশি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নরমাল ইউনিভার্সিটির চার গবেষক।
কী উল্লেখ আছে গবেষণায়?
১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাণিজ্যের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তাদের গবেষণায় বলা হয়, আরসিএ মান (রিভিলড কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ বা প্রত্যক্ষ তুলনামূলক সুবিধা) বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম বাণিজ্য থেকে বাংলাদেশ বা চীন কেউই তেমন কোনো সুবিধা নিতে পারছে না। এ আড়াই দশকে দুই দেশের জন্যই জ্বালানি বাণিজ্যে আরসিএ মান ছিল ১-এর নিচে। ‘ট্রেড ইন্টেনসিটি অ্যান্ড রিভিলড কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ: এন এমপিরিক্যাল অ্যানালাইসিস অব ট্রেড বিটুইন চায়না অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে তাদের এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আরসিএ হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি নির্দিষ্ট দেশের কোনো নির্দিষ্ট পণ্য আমদানি বা রফতানির তুলনামূলক সুবিধার পরিমাপক। এক্ষেত্রে আরসিএ মান ১-এর কম হওয়ার অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট দেশটি থেকে উল্লিখিত পণ্য আমদানি বা রফতানিতে তুলনামূলক সুবিধা পাওয়া যায় বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে কম।
এ অবস্থায় চীন থেকে বড় মাত্রায় পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে নির্ভরতার পেছনে বাণিজ্যিক সুবিধার চেয়ে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিকগুলো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্যমতে, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম রফতানিতে তুলনামূলক সুবিধার জায়গা থেকে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও চীনের ওপর একটু বেশিই নির্ভরশীলতা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আসে চীন থেকে। অথচ বাংলাদেশ ও চীন দুই দেশই প্রায় একই উৎস থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে।
আমদানিনির্ভর হওয়ায় জ্বালানি রফতানির সক্ষমতায় চীনের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন দেশটির বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত লি জিমিংও। কিছুদিন আগেই ঢাকায় কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, চীন নিজেই এলএনজিসহ নানা ধরনের জ্বালানি পণ্য আমদানি করে। তাই এসব জ্বালানি পণ্য রফতানি করার মতো অবস্থা চীনের নেই।
একই অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট তীব্রতা পেলে তার দেশ চুপচাপ বসে থাকবে না। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে বেইজিং। সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ নিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের অনুরোধের বিষয়টি বেইজিংকে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও শ্রীলংকার ক্ষেত্রে এতটা জোরালোভাবে সহায়তার কথা জানায়নি চীন। যদিও দেশটিতে সংকটের মাত্রা ছিল তুলনামূলক বেশি। আবার কলম্বোর সঙ্গে চীনের বেশ সখ্যতাও তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন রাজাপাকসে সরকারের সময়ে দেশটিতে একের পর এক বৃহদায়তনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি রাজাপাকসেরাও প্রত্যক্ষ আনুকূল্যে দেশটিতে চীনের আধিপত্যও দিনে দিনে বেড়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে সে সুবিধার ব্যাপ্তি আরো বেড়েছে।
চীনা মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ বাড়ার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও চীনের পরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানির সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেহেতু চীন নিজেই জ্বালানি তেলের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু দেশটি থেকে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানিতে আরসিএ ভ্যালু ভালো হওয়ার কথা না। তবে দেশটির জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা অনেক বেশি।
এক্ষেত্রে আমদানীকৃত জ্বালানি তেল পরিশোধনের পর চাহিদার অতিরিক্ত যা উদ্বৃত্ত থাকে, সেটিই রফতানি করে দেশটি। চীনের টেন্ডারদাতারা কম মূল্যে সরবরাহের ঘোষণা দিয়ে কাজ পেতেই পারেন। এছাড়া এখন দেশটি রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করছে। সে হিসেবে সামনের দিনগুলোয় দেশটির পরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানির সক্ষমতা আরো বাড়তে যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ