বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভাগীয় শহর বরিশালে বিরোধী দল বিএনপি সমাবেশের একদিন আগেই সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ হয়ে শহরটি অন্য সব জেলা ও উপজেলাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সাথেই বাস যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে শুক্রবার রাত থেকেই। এমনকি বরিশাল থেকে পার্শ্ববর্তী অন্য জেলা ও উপজেলায় কোন ধরনের গণপরিবহন চলাচল করছে না।
যদিও বিএনপির মিডিয়া সেলের দায়িত্বে থাকা নেতা জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন যে পটুয়াখালী, ভোলাসহ বেশ কিছু জায়গায় বিএনপি কার্যালয়ে হামলা হলেও বরিশালে সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের দিক থেকে অসহযোগিতা তারা পাননি। বরিশাল ইতোমধ্যেই বিএনপি সমর্থকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। বাধা দেয়া হতে পারে এমন কিছু জায়গার তালিকা আমরা প্রশাসনকে দিয়েছি। আশা করি তারা সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন।
আসলে রাজনীতি নিয়ে এখন অনেকেই বেশ চাঙা বোধ করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে কয়েকটি বিভাগে বিএনপির ধারাবাহিক সফল জনসভায় সরকারবিরোধীদের অনেকেই বেশ উৎসাহিত। তাঁরা দেখছেন, নানা বাধাবিপত্তির পরও এসব জনসভায় দলের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা অংশ নিচ্ছেন।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপে আ’লীগ
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, বিএনপি কী এমন কৌশল বা সাংগঠনিক উদ্যোগ নিল, যাতে কর্মী-সমর্থকেরা এতটা উদ্বুদ্ধ হলো! কিন্তু এর পাল্টা প্রশ্ন হলো, আসলেই কি এখানে কোনো কৌশল কাজ করেছে? নাকি সরকারি দল ও পুলিশের হামলা, মারধর ও গুলি বন্ধ হওয়াতেই সমর্থকেরা সমাবেশে হাজির হতে শুরু করেছেন? ভোলা, নারায়ণগঞ্জ বা মুন্সিগঞ্জে যা ঘটেছে, তা অব্যাহত থাকলে এসব জনসভা কতটা সফল হতো?
এখানে বলে রাখা ভালো, বিএনপির জনসভার আগে বাস, লঞ্চ বা নৌঘাটে ধর্মঘট বা পরিবহন বন্ধ রেখে যে ‘বাধা’ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোকে বাধা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগুলো নতুন কিছু নয়। এসব বাধা দূর করেই বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে।
বিএনপির জনসভাগুলো সফল হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ বা কৌশল আছে বলে মনে হয় না। বিএনপি একটি বড় দল, এর কর্মী-সমর্থকেরা সুযোগ পেলে দলের কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সরকারের দমন-পীড়ন ও প্রতিহিংসার মুখে পড়েছেন।
দু–দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই ক্ষমতা ধরে রেখেছে। ‘বিরোধী-পীড়নের’ কাজটি ভালোভাবে করতে না পারলে এটা সম্ভব হতো না। ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির জন্য পীড়নপর্বটি বেশ দীর্ঘই হয়ে যাচ্ছে। এখন একটু সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। তিন মাস আগেও আওয়ামী লীগ যতটা কঠোর ছিল, সেই একই অবস্থানে থাকলে বিএনপি কি এভাবে সফল কর্মসূচি পালন করতে পারত?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন বিএনপিকে কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে? সরকারি দল কি ‘ভালো’ হয়ে গেল? নাকি চাপে পড়ল? পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে মনে হয় আওয়ামী লীগ চাপে পড়েছে। এই চাপ দুই দিকের। একটা ভেতরের, আরেকটা বাইরের। ভেতরের চাপটি মূলত অর্থনৈতিক। আমদানি-রপ্তানি, শিল্প উৎপাদন, দ্রব্যমূল্য, খাদ্য পরিস্থিতি, রিজার্ভের অবস্থা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যা শোনা যাচ্ছে, তা বেশ উদ্বেগজনক। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য নিজেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন। দেশের অর্থনীতি দুর্দশার মধ্যে না পড়লে বিরোধী দলের প্রতি আওয়ামী লীগ এখন যতটা ‘নমনীয়তা’ দেখাচ্ছে, তা দেখাত বলে মনে হয় না।
অর্থনৈতিক সংকটের বাইরে যে ‘রাজনৈতিক’ কারণে আওয়ামী লীগ চাপে পড়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের অতিমাত্রায় ‘রাজনৈতিক সক্রিয়তা’। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে বিশ্বের ৩৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ সবচেয়ে বেশি ‘রাজনীতি সক্রিয়’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ উচ্চ মাত্রায় এবং ২৯ ভাগ মানুষ মধ্যম মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়। এর মানে, বাংলাদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়। জরিপটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে। আর ২০১৬ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট এক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো এমন রাজনীতিতে আচ্ছন্ন দেশ আমি আর দেখিনি।’ (লাইভ মিন্ট, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬)।
‘রাজনীতি সক্রিয়’ জনগণের ‘রাজনীতিতে আচ্ছন্ন’ দেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছে। যে কায়দা ও কৌশলে এই দুটি নির্বাচন হয়েছে, তা জনগণের সামনে বিস্ময় হিসেবে হাজির হয়েছে। হতবাক হয়ে তাঁরা দেখেছেন, যে ভোটের রাজনীতি তাঁদের ‘রাজনীতি-সক্রিয়’ করেছে, সেই ভোটে তাঁদের আর কোনো অধিকার নেই। ভোট আর ‘উৎসব’ নয়, ভোট মানে নতুন কোনো কৌশল।
একই সঙ্গে ভোটবঞ্চিত জনগণ এখন টের পেতে শুরু করেছে, গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে ‘উন্নয়নের’ যে স্লোগান আওয়ামী লীগ সামনে নিয়ে এসেছিল, সেখানে বড় ফাঁকি রয়ে গেছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য যে শুধু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নয়—দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচার বড় ভূমিকা রেখেছে, সেটাও জনগণের সামনে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থান
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একসাথে কাজ করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক হয়, জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে এবং অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হয় সেজন্য সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সমঝোতায় আনার উদ্যোগ যৌথভাবে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করবে বলে জানা গেছে।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভারতের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। উপমহাদেশের ভারসাম্য, চীনের আধিপত্য রোধ এবং উগ্র জঙ্গিবাদ মোকাবেলাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে তালেবানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়া, পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ এবং সশস্ত্র সংগঠন গুলোর উত্থান এবং এই উপমহাদেশে একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর এই নির্বাচনের ব্যাপারে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র একসাথে অভিন্ন কৌশল নিয়ে যদি কাজ না করে তাহলে সেটি এই অঞ্চলের শান্তি, সম্প্রীতি এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি হতে পারে। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে, সেটি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এরকমই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে দুই দেশের কূটনীতিকদের কৌশলগত আলোচনায়।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এরমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। আর এই অভিমতের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তিনি একদিকে যেমন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করছেন, অন্যদিকে সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের কোনো অবস্থান নেই। বাংলাদেশে ভারতের নতুন হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা এসেছেন। আসার পর তিনি সবকিছু বুঝে ওঠার চেষ্টা করছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ নিয়ে বা কোনও বিষয়ে তিনি আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তৃতা-বিবৃতি দেন নাই। ভারতের এর আগের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বাংলাদেশের জনগণই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অতি আগ্রহের কারণে ভারত এখন বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলছে। কারণ, কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এসডব্লিউএসএস/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ