ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ। প্রতিনিয়ত বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না ঋণ আদায়ের হার। খেলাপি ঋণের সিংহভাগই অনাদায়ী রয়ে যায়। আবার খেলাপি ঋণ নামের বিপদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রভিশন ঘাটতি। ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে সংস্থান রাখার মতো যথেষ্ট মুনাফা হচ্ছে না। এতে আর্থিক খাতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে খাতটির বিপদগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। সেইসঙ্গে ব্যাংক খাতের উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মতে, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। বাংলাদেশে এ হার ৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকে ২০ শতাংশের বেশি। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে উদ্বেগ জানিয়েছে আইএমএফ। সন্দেহজনক লেনদেন ও অর্থপাচার নিয়েও উদ্বেগের কথা জানায় সংস্থাটি।
আইএমএফের এসব প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়— সাধারণত খেলাপি ঋণের হিসাব দুইভাবে করা হয়। এর একটি গ্রস এবং অপরটি নিট। গ্রস হিসাবে খেলাপি ঋণ বেশি হলেও নিট হিসাবে কম। যা ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। এ কারণে করোনাকালীন সময়ে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে।
সংস্থাটি জানতে চেয়েছে— ব্যাংকখাতে কেন খেলাপি বাড়ছে। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে।
রোববার (৩০ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এক বৈঠকে খেলাপি ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশের সঙ্গে এর প্রতিকার বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির প্রতিনিধি দলটি এদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, কেন্দ্রয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমানসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠকে আইএমএফের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়।
এছাড়া, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে দেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের কারণে লোকসানের তথ্য এবং রুগ্ন শিল্প পুনর্বাসনের পরিকল্পনা সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
আইএমএফ এর সঙ্গে সভায় উপস্থিত ছিলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এমন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর বিপুল খেলাপি ঋণকে ব্যাংকখাতের জন্য বড় ঝূঁকি হিসেবে উল্লেখ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো পরিচালনার সঙ্গে যেহেতু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্পৃক্ত, তাই এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছে সংস্থাটি।
একই দিন সকালে ন্যশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ’র (এনবিআর) সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এত বেশি ট্যাক্স অব্যাহতি কেন তা জানতে চেয়েছে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের ট্যারিফ রেট অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি উল্লেখ করে তা কমিয়ে আনা কিংবা কবে নাগাদ কমানো হবে – সেই পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে তারা।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের ট্যারিফ রেট অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি উল্লেখ করে তা কমিয়ে আনা কিংবা কবে নাগাদ কমানো হবে – সেই পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে তারা।
পাশাপাশি, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিষয়েও এনবিআর পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে।
সভায় ট্যাক্স অব্যাহতির যৌক্তিকতা তুলে ধরে তা কমিয়ে আনার বিষয়ে চলমান কার্যক্রম তুলে ধরা হয় এনবিআরের পক্ষ থেকে। এছাড়া ট্যারিফ রেটও কমিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা জানানো হয় বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি প্রেজেন্টেশন দিয়ে আইএমএফকে বলেছে, কোভিড পরিস্থিতির কারণে ২০২০ এর মার্চ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালনারেবল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্যান্ডেমিক পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করতে ব্যাংকগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে।
তাছাড়া, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারি উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কম সুদের হারে ঋণ প্রদান করে এবং কোনো চার্জ আরোপ ছাড়াই বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমে জড়িত থাকার জন্য অনেক অবদান রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংকখাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১.২৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড এর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কোভিড পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে ঋণের মোরাটোরিয়ামের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়ার পরও এতবেশি খেলাপি ঋণে বিস্ময় প্রকাশ করে সংস্থাটি বলেছে, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা এখাতের জন্য মারাত্বক ঝুঁকি তৈরি করছে।
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকের টোটাল আউটস্ট্যান্ডিং এর এক-চতুর্থাংশই খেলাপি। সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপির হার টোটাল আউটস্ট্যান্ডিং এর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
অন্যদিকে, ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ধ্বসে পড়া বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ টোটাল আউটস্ট্যান্ডিং এর অর্ধেকেরও বেশি এবং বিডিবিল’র খেলাপি ঋণ ৩৬%.
খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিবছরই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে পৃথক চুক্তি করে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো, তবে লক্ষমাত্রা অনুযায়ী খেলাপি ঋণ আদায়ে সফলতা দেখাতে পারছে না। এবছরও তার ব্যতিক্রম নয়।
২০২২ সালে ১২৪০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করলেও বছরের প্রথম ছয় মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ৯৯ কোটি টাকা। এই অর্জন লক্ষমাত্রার ৮% এরও কম।
একইভাবে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক দু’টির এবছর ১০০০ কোটি টাকা করে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষমাত্রা রয়েছে। কিন্তু ছয় মাস শেষে সোনালী ব্যাংক আদায় করেছে ১৬৪ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংক আদায় করেছে ২৩২ কোটি টাকা।
বেসিক ব্যাংকের ১১৫৬ কোটি টাকা খেলাপি আদায়ের লক্ষমাত্রা থাকলেও আদায় করেছে মাত্র ১৪৬ কোটি টাকা।
কেবল খেলাপি ঋণই নয়, রিটেন অফ ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর ব্যার্থতার চিত্রও উঠে এসেছে আইএমএফ এর আলোচনায়। রাষ্ট্রায়ত্ব পাঁচটি ব্যাংকের এবছর রিটেন অফ করা ঋণের ১৬৭০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষমাত্রা থাকলেও গত জুন শেষে আদায় হয়েছে মাত্র ২০১ কোটি টাকা।
উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক বড় ধরনের মূলধন সংকটে রয়েছে। ব্যাংক চারটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। মূলধন ঘাটতি থাকার কারণে এসব ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে চায় না বিদেশি ব্যাংকগুলো। এজন্য বাড়তি কমিশন দিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন নিয়ে বিভিন্ন সময় আইএমএফ গুরুত্ব দিলেও এবার এক্ষেত্রে বাড়তি গুরুত্বারোপ করছে সংস্থাটি। কারণ, ব্যাংকখাতে ঋণ ও আমানতের সুদহার নির্ধারণ, ঋণের মোরাটোরিয়াম, খেলাপি ঋণ পুনঃর্গঠন ও পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়াসহ ২০১৮ সাল থেকে ব্যাংকখাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চাপানো হয়েছে।
এর আগে বুধবার (২৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ সফরে আসে আইএমএফ প্রতিনিধি দলটি। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কয়েকটি সেশনে বৈঠক করে প্রতিনিধিদলটি। বৈঠকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহ আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়। এ দিন বিকেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বসে দলটি। বৈঠকে রিজার্ভসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ