সম্প্রতি ঢাকায় এক আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিষ্ফোরক সব মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধ ও দুর্নীতির চমকপ্রদ সব তথ্য উঠে এসেছে তার বয়ানে। ওই সভায় সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে বলে স্বীকার করেছেন ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের এই আমলা। মন্তব্য করেন, কর্মকর্তাদের অপরাধপ্রবণতা এত পরিমাণে এখন বেশি যে প্রতিদিন তিন-চারটি করে বিভাগীয় মােকদ্দমা শুনতে হয় এবং বিভাগীয় মােকদ্দমায় অনেকের শাস্তি হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
জনপ্রশাসনসচিব বলেন, ভাঙ্গার (উপজেলা) ইউএনও সাহেব বন্দুক কিনেছেন, রাতের বেলায় সেটি জাহির করার জন্য তিনি ফায়ার করলেন। এ রকম করতে হবে কেন? সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কী করতে পারব, কী করতে পারব না; সেটি আমরা জানি। আচরণবিধি ছাড়াও অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ কী, তা আমরা জানি। এগুলাে আমাদের মেনে চলতে হবে। আমি প্রত্যেক কর্মকর্তাকে বলব, আমরা সরকারি কর্মকর্তা; অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ যেন না করি। আমার যে দায়িত্ব, সেটি যেন পালন করি।
জনপ্রশাসনসচিব জানান, আরেকজন কর্মকর্তা ফেসবুকে লিখেছেন, অমুক ব্যাচের কর্মকর্তা তাে এত দিন এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার-ভূমি) ছিলেন। আমাদের কেন এসি ল্যান্ড থেকে এক বছর পর প্রত্যাহার হবে। এটি আমরা বুঝি, কেন তিনি ফেসবুকে দিয়েছেন। কারণ হলাে, তার খাওয়াটি আসলে কম হয়েছে। এক বছরে হয়নি, আরও দুই বছর যদি খেতে পারতেন, তাহলে উনার পেটটি ভরত।
অপর এক ঘটনার উল্লেখ করে জনপ্রশাসনসচিব বলেন, ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শন করা হলাে, এটি ফেসবুকে দেওয়ার কী হলাে? যেন তার আগে কেউ ভূমি অফিস পরিদর্শন করেননি। তিনি বলেন, আরেক কর্মকর্তা ভালাে গান গাইতে পারেন। তিনি গান গেয়ে ফেসবুকে দিলেন। কেন? কোনাে কোনাে কর্মকর্তা শুনি প্রায়ই সংগীতানুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। আমি মনে করি, এটি সঠিক নয়। তার কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলােতে বসে আয়ােজন করতে পারেন। এটি ফেসবুকে দেওয়ার কিছু নেই।
অভিজ্ঞতার চিত্র তুলে ধরে শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, একজন কর্মকর্তা একটি ব্যাচের পক্ষে। তিনি এপিডি (জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ােগ ও পদায়ন শাখার অতিরিক্ত সচিব) সাহেবকে বললেন, স্যার আমার ঢাকায় পােস্টিং দরকার। এপিডি জিজ্ঞেস করলেন, কেন? তিনি বললেন, স্যার, আমি তাে ওই ব্যাচের সভাপতি। ব্যাচের কাজকর্ম করতে হয়। এই জন্য ঢাকায় আসা প্রয়ােজন। ব্যাচের সভাপতি হলেই ঢাকায় পােস্টিং লাগবে? কেন? আমি চাকরি শুরু করেছি সুনামগঞ্জে। ২৫ বছর পরে ঢাকায় এসেছি। মাঠেই ছিলাম।
জনপ্রশাসনসচিব বলেন, পেকুয়ার ইউএনও; তার ওখানে কী একটি ঘটনা ঘটল, যে ঘটনার সঙ্গে ইউএনওর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তিনি একাত্তর টিভিতে গিয়ে বক্তৃতা দিলেন। একটা প্রশ্নেরও জবাব ইউএনও দিতে পারলেন না। বললেন, আমি ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি। হু আর ইউ, ওসিকে নির্দেশ দেওয়ার। এগুলাে কিন্তু জনগণ বা অন্য সার্ভিসের লােকজন ভালােভাবে নেয় না।
জনপ্রশাসনসচিব বলেন, আমার সম্মান যদি কোনাে জায়গায় বজায় থাকে, তাহলে যাব। কই, আমরা তাে যাই না। আমরা যাই, যখন বুঝি ওখানে গেলে মর্যাদা থাকবে, অবান্তর কোনাে প্রশ্ন করা হবে না, এ রকম ক্ষেত্রে যাই। আমরা কিন্তু এ বিষয়ে একটি সার্কুলার দিয়েছি। সার্কুলার মানে আচরণবিধিটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। আমাদের কোনাে কর্মকর্তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমােদন ছাড়া এটিতে (গণমাধ্যমে) যাবে না। আমাদের খেয়াল করতে হবে।
নবাগত কর্মকর্তাদের আচরণ সম্পর্কে জনপ্রশাসনসচিব বলেন, ৩৭তম বিসিএসের একটি ফোরাম হয়েছে। তারা একজন উচ্চপদের কর্মকর্তাকে নিয়ে সভা করেন। অথচ তারা এখনাে চাকরিতেই যােগ দেননি। বিভাগীয় মামলার বিচারে মানবিক দিক বিবেচনা করা হয় বলে জানান শেখ ইউসুফ হারুন। তিনি বলেন, একজন কর্মকর্তা অপরাধের দায়ে যখন অভিযুক্ত হন, তার ফোরামের লােকজন নিয়ে জনপ্রশাসনসচিবের কাছে আসেন। বলেন, স্যার ও তাে ভালাে কর্মকর্তা। পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে করে ফেলছেন, তাকে মাফ করেন। এগুলােতে আমরা চরমভাবে বিব্রত হই। অপরাধের ক্ষেত্রে মানবিক কারণগুলাে কিছু বিবেচনা করা হয়। অনেকের তাে অনেক বড় শাস্তি হওয়া উচিত। তারপরও পরিবেশ- পরিস্থিতিসহ সবকিছু বিবেচনা করা হয়।
২৪ ডিসেম্বর ২০২০ রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। বৃহস্পতিবার আয়ােজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হােসেন। তিনি ভার্চুয়ালি যােগ দেন। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মাে. মােস্তাফিজুর রহমান। জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন ছিলেন বিশেষ অতিথি। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসােসিয়েশনেরও মহাসচিব।
পরবর্তীতে এসব বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এটি একটি অভ্যন্তরীণ অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে প্রশাসন পরিবারের সদস্যদের ভুলত্রুটি সংশােধনের জন্য তিনি এভাবে বলেছেন। তিনি বলেন, সব কর্মকর্তা নয়, গুটিকয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযােগ রয়েছে। তাদের নিয়মকানুনের মধ্যে আনতে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে বিশ্লেষক মহল মনে করেন, জনপ্রশাসন সচিবের বক্তব্যে প্রশাসনের বাস্তব একটি চিত্র উঠে এসেছে। সচিব দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তার দায়িত্ব ছিল নিয়ম লঙ্ঘনকারী, অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের শাস্তির মুখোমুখি করা। কিন্তু তার বক্তব্যে তীব্র সমালোচনার ঝাঁজ থাকলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের ওপর জোরারোপ করতে দেখা যায়নি। কথা খরচের চেয়ে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা গেলেই সরকারি কাজে তাড়াতাড়ি শৃঙ্খলা প্রতিস্থাপিত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডাব্লিউ/পিএ/আরা/১১১০
আপনার মতামত জানানঃ