তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে সরকারি চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই অবসরে পাঠানো হয়েছে। রবিবার (১৬ অক্টোবর) এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিএনপি ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কথিত অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
তবে এ তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে আরো পাঁচ সচিবকে। শুধু সচিব নন, কয়েক জন অতিরিক্ত সচিবও আছেন এই তালিকায়। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ১২।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই ১২ জনের দৈনন্দিন চলাফেরা, মোবাইল ফোনে যোগাযোগসহ দেশে-বিদেশে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে অবসরের প্রায় এক বছর আগে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। বর্তমান সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত কয়েক জন সচিবও এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। এদের কারো কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতে পারে, সে বিষয়ে শীর্ষমহলে আলোচনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পদোন্নতিবঞ্চিত কয়েক জন কর্মকর্তা সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছেন এমন কিছু তথ্য নিয়ে আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। পরে একাধিক কর্মকর্তার এ ধরনের কার্যক্রমে জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আসে। এরপর তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম মনিটরিং শুরু করি। তাতেই মেলে ষড়যন্ত্রের তথ্য। পুরো বিষয়টি সরকারের শীর্ষমহলে জানানো হয়।’
দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, মকবুল হোসেন পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের উলটো দিকে একটি অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করছিলেন। সেই অফিস পরিচালনা করেন বিএনপির এক শীর্ষ নেতা।
সূত্রগুলো বলছে, অভিযুক্ত এসব কর্মকর্তা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাদের কেউ কেউ লন্ডনে যোগাযোগ রেখেছেন এমন তথ্যও অনুসন্ধানে মিলেছে। ফলে গুরুতর অপরাধে জড়িত পাঁচ সচিবকে আগাম অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি সচিব ও অতিরিক্ত সচিব মিলিয়ে যে ১২ জনের তালিকা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে। সবাইকে অবসরে পাঠানো না হলেও কঠোর মনিটরিংয়ে রাখা হবে।
সরকারের শীর্ষমহল থেকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার অনুমোদন মিলেছে। ফলে অবসরে পাঠানো কারো কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাটি এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আলামত সংগ্রহ করছে।
সূত্র জানায়, প্রশাসনের শুধু এই কর্মকর্তারাই নন, মধ্যম ও জুনিয়র পর্যায়ের কিছু গ্রুপ লন্ডনকেন্দ্রিক যোগাযোগ রাখছে। এসব খবর সরকারের কাছে আছে। এদের মধ্যে যারা চিহ্নিত, তাদের বিভিন্নভাবে বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তথ্যসচিবের বিষয়টি কেন্দ্র করে সবাইকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাদের মধ্যে দোটানা ভাব আছে, তাদের বিষয়ে এটি পরিষ্কার বার্তা বহন করবে।
এই অবসরের মাধ্যমে প্রায় দেড় দশকের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্বিতীয় বারের মতো এক জন তথ্যসচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো। ২০০৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হেয় করে কবিতা লেখার অভিযোগে তৎকালীন তথ্যসচিব আ ত ম ফজলুল করিমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল সরকার। তিনি লেখকমহলে আবু করিম নামে পরিচিত ছিলেন।
আইনে কী বলা হয়েছে
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মকবুল হোসেনকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী সরকারি চাকরি হতে অবসরের কথা বলা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে।
এ ধারায় বলা হয়েছে ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ পঁচিশ বছর পূর্ণ হবার পর যে কোনো সময় সরকার, জনস্বার্থে, প্রয়োজনীয় মনে করলে কোনো রূপ কারণ না দেখিয়ে তাকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারবে’।
পদোন্নতিবঞ্চিত কয়েক জন কর্মকর্তা সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছেন এমন কিছু তথ্য নিয়ে আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। পরে একাধিক কর্মকর্তার এ ধরনের কার্যক্রমে জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আসে।
তবে শর্ত থাকে যে যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
মূলত এই ধারার আওতাতেই সরকার যে কোন কর্মকর্তাকে এমনকি তাকে কিছু না জানিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অর্থাৎ চাকরি থেকে অবসর দেয়ার আগে কি কারণে অবসর দেয়া হচ্ছে সেটি জানাতে সরকারের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
মকবুল হোসেনের কী অপরাধ?
গত রবিবার অবসরে পাঠানো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে সরকার অবসরে পাঠায়। এ নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন চলছে দেশ জুড়ে। এর মধ্যেই গতকাল সোমবার সচিবালয়ে নিজের অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মকবুল হোসেন। তিনি দাবি করেন, এ ধরনের কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনি জড়িত নন, বরং ছাত্রজীবনে তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন।
সাবেক সচিব বলেন, সরকার আমাকে জনস্বার্থে অবসরে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে অন্য কোনো কারণ আছে বলে আমার জানা নেই। সরকার আমাকে অবসরে পাঠানোয় অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে থাকলে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেতাম, সেগুলো হয়তো পাব না। তবে অবসরের সব সুযোগ-সুবিধা পাব।
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি জানি না আমাকে কেন অবসরে পাঠানো হলো। মানুষকে ফাঁসি দিলেও তো একটা ট্রায়াল হয়। কিন্তু আমি জানি না কোন কারণে এই সিদ্ধান্ত।
লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিযোগে এমন শাস্তি দেয়া হয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা লন্ডেনে গিয়েছিলাম মার্চে, একটা টিম নিয়ে। আমাদের প্রেসের দায়িত্বে আছেন আশিকুন্নবি। তার কাছে জিজ্ঞাসা করলে পরিষ্কারভাবে বিষয়টি জানা যাবে।
তিনি বলেন, প্রবাদে আছে, হাতি যখন কাদায় পড়ে, চামচিকাও লাথি মারে। আমি মার্চে লন্ডন গিয়েছিলাম। এই অভিযোগের বিষয়টি সত্য হলেও সেটা তো মার্চ মাসে হয়েছে। এখন তো অক্টোবর। এতদিন এ প্রশ্ন আসেনি কেন?
তিনি বলেন, আমি তারেক রহমানকে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না এবং তারেক রহমানকে দেখার ইচ্ছাও আমার নেই।
তার চাকরির মেয়াদে বিএনপি সরকারের আমলেও তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে মকবুল বলেন, সামনাসামনি তাদের দেখা হয়নি। তিনি তো মন্ত্রীও ছিলেন না, এমপিও ছিলেন না। টেলিভিশনে তাকে দেখেছি, সেটা তো স্বাভাবিক।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আপনাদের তো জানার অনেক পথ আছে। এ ধরনের কোনো বিষয় যদি আপনাদের নলেজে আসে এবং সেটা যদি বস্তুনিষ্ঠ হয়, অবশ্যই তা পত্রিকায় প্রকাশ করবেন। আমি বাংলাদেশের যেখানেই থাকি, আমাকে এই প্রশ্ন করবেন যে আপনি লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেছেন কি-না, ওমক জায়গায় বিএনপির লোকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কি-না বা আপনার সংযোগ বিএনপির সঙ্গে আছে।
তিনি বলেন, শুধু আজ বা কাল নয়, কোনো সময় যদি এমন কোনো সংযোগ আমার সঙ্গে পান, আমাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন।
নিজের কাজের সম্পর্কে তিনি বলেন, আপনারা তথ্যসংগ্রহ করেন, আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম কি না। দুর্নীতি ২ রকমের। একটা আর্থিক দুর্নীতি, আরেকটা ইন্টেলেকচুয়াল দুর্নীতি। আপনারা প্রতিদিন এখানে আসবেন। আমি ইন্টেলেকচুয়াল ও আর্থিকভাবে কতটা স্বচ্ছ ছিলাম, কতটা অস্বচ্ছ ছিলাম, তা জানতে পারবেন।
বাধ্যতামূলক অবসর কি কোনো শাস্তি
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান এবং সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বিবিসিকে বলেন, এটা কোনো শাস্তি নয় কারণ এতে তিনি অবসরকালীন সব সুবিধা পাবেন।
আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, তবে এটি অস্বস্তির নিজের ও পরিবারের জন্য। আর্থিক ক্ষতি এই অর্থে যে বাকী মেয়াদের বেতন ভাতা পাচ্ছে না। তবে দেখার বিষয় হলো একদিকে কেউ মেয়াদ শেষের আগে চাকুরী হারাচ্ছেন আবার কেউ কেউ মেয়াদ শেষ করেও ৩/৪ বার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন।
অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলছেন, বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া যেতে পারে গুরুতর অসদাচরণের জন্য অর্থাৎ জনস্বার্থে, যাতে তার দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত না হতে পারে।
তিনি বলেন, কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশে নানা কারণে অনেক ভালো কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি।
আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলছেন, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে কখনোই সরকার ব্যাখ্যা দেয় না, যা নিতান্তই অনুচিৎ।
তিনি বলেন, সরকার যাকে পছন্দ করছে না তাকে পঁচিশ বছর হলেই সরিয়ে দেবে আর কাউকে মেয়াদ শেষের পরেও ৩/৪ বার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবে, এটা কেমন কথা। পুরো বিষয়টা আসলে সবসময়ই সরকারের খেয়াল খুশি মতো। এতে কোনো স্বচ্ছতা নেই।
তার মতে এটি কোনো শাস্তি নয় কারণ অপরাধের জন্য হলে তো বিভাগীয় মামলা দিয়ে চাকুরিচ্যুত করতে পারতো।
তিনি বলেন, আবার হতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অপরাধ করেছেন কিন্তু সরকার তার অপরাধের শাস্তি না দিয়ে বাধ্যতামূলক অবসরের মাধ্যমে সেফ এক্সিটের (নিরাপদ প্রস্থান) সুযোগ দিলো।
তিনি অবশ্য মনে করেন খুব অনিবার্য না হলে বাধ্যতামূলক অবসরের বিধান ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ তিনি মনে করেন এতে প্রশাসনের সব স্তরেই একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ