গত রবিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। তা নিয়ে এখনো নানামুখী আলোচনা চলছে। এরইমধ্যে এবার তিন পুলিশ সুপারকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আদান–প্রদান করতেন, কোনো কাজ করতেন না।
এই কর্মকর্তারা হলেন পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার মো. মির্জা আব্দুল্লাহেল বাকী ও দেলোয়ার হোসেন মিঞা।
গতকাল মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ তিন এসপিকে অবসরে পাঠানোর ভিন্ন ভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারি করে। জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (৫৭ নম্বর আইন)-এর ৪৫ ধারার বিধান অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। ’
গত রবিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে ‘বাধ্যতামূলক’ অবসরে পাঠানো হয়। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের এই কর্মকর্তাকে কেন এভাবে অবসরে পাঠানো হলো, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। কেউ কেউ ভাবছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার হয়তো পুলিশ ও প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, আরও প্রায় পাঁচ থেকে ছয় জন সচিবসহ সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেককেই জনস্বার্থে অবসরে পাঠানো হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, সরকারবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছিল বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে উল্লেখ করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে তাদের চাকরির পূর্ববর্তী রেকর্ড মিলিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
মির্জা আব্দুল্লাহেল বাকী বিসিএস ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি পাবনা, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, টাঙ্গাইল ও গোপালগঞ্জে এসপির দায়িত্বে ছিলেন। আব্দুল্লাহেল বাকী রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক বা পিপিএম (সেবা) পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি আর পদোন্নতি পাননি। তার ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন অতিরিক্ত আইজি ও ডিআইজি।
দেলোয়ার হোসেন মিঞা ও মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী বিসিএস ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তা। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির আমলে জামালপুল ও মুন্সীগঞ্জ জেলার এসপি ছিলেন। শহীদুল্লাহ চৌধুরী পিপিএম পদকপ্রাপ্ত। দেলোয়ার হোসেনও বিএনপির আমলে একাধিক জেলার এসপি ছিলেন। এসপি পদের পর এ দুজনেরও আর পদোন্নতি হয়নি।
আরও প্রায় পাঁচ থেকে ছয় জন সচিবসহ সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেককেই জনস্বার্থে অবসরে পাঠানো হতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আব্দুল্লাহেল বাকীর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি এবং দেলোয়ার হোসেন মিঞা ২০২৬ সালের ৪ জুন।
পুলিশ ও জননিরাপত্তা বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি এই কর্মকর্তাদের বিষয়ে দুটি সংস্থা থেকে গোপন প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে একজন কর্মকর্তা কয়েক দিন আগে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। গোপন ওই প্রতিবেদনের সূত্রে তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হতে পারে। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা বলছেন, দীর্ঘদিন সরকার তাদের পদোন্নতি দিতে পারছে না বলে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে।
অবসরে পাঠানো সিআইডির এসপি আবদুল্লাহেল বাকী তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না। এখন তারা (সরকার) অনেক কিছু বলতেই পারেন। কিন্তু আমি কাজ না করলে তো আমাকে কয়েক দিন আগেও দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিতে দুবাই পাঠাতেন না। দীর্ঘদিন আমাকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি, আমি জানি না।’
মির্জা আব্দুল্লাহেল বাকী গণমাধ্যমকে আরও বলেন, ‘সারা দিন অফিসেই ছিলাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। একজন সাংবাদিক ফোন করে খবরটা জানান। শুনেই চমকে যাই। যা-ই হোক, এখন চাকরি নাই, এটাই সত্য। তবে জোরগলায় বলতে পারি, আমি সরকারবিরোধী নই, কোনো দলেরও ছিলাম না। পুলিশে যোগ দেওয়ার পর পেশাদারির সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করেছি। ’
তাহলে কেন অবসরে পাঠানো হলো—এমন প্রশ্নে আব্দুল্লাহেল বাকী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে এ বিষয়ে কোনো পুলিশ সদর দপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ’
বিরোধী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১০ দিন আগেও সরকারি সফরে দুবাই গিয়েছি। সব সময় সরকারি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করেছি। ’
মির্জা আব্দুল্লাহেল বাকী বলেন, ‘আমার জুনিয়ররাও প্রমোশন পেয়ে ওপরে উঠে গেছে। তাদেরকে আমার স্যার বলতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই অপমান সহ্য করতে হয়েছে। আর্থিক সামর্থ্য থাকলে ১০ বছর আগেই চাকরি ছেড়ে দিতাম। ’
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তারা কোনো কাজ করেন না। হাজিরা দিয়ে চলে যান। তাদের পেছনে ৮–১০ জন কনস্টেবল থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা ফেসবুকে ভুয়া সংবাদ আদান–প্রদান করেন। পুলিশ সদর দফতর আমাদের কাছে তাদের অবসরে পাঠানোর প্রস্তাব পাঠালে আমরা তা বাস্তবায়ন করেছি।’
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। তবে যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের এভাবে হঠাৎ অবসরে পাঠানোতে দেশের জনগণের মনে যেমন নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমনি এটাও অনুমান করা যায়, হয়তো সচিবালয়ের বা প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি তৈরি হতে পারে। সরকারের উচিত ছিল পরিষ্কার করে বলা, কেন সচিব ও এসপিদের হঠাৎ অবসরে পাঠানো হলো। এটি না করা হলে এ নিয়ে জনমনে বোধ করি আরও বেশি সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে।
তারা বলেন, তারা যদি কোনো অপরাধ করেই থাকেন, কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত কমিটি করা হলো না? কেন তাদের কোনো কঠিন শাস্তির আওতায় না এনে স্রেফ অবসরে পাঠানো হলো? সরকারকে তো এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে হবে। দেশের জনগণের অধিকার আছে বিষয়গুলো জানার। তাদের ট্যাক্সের টাকাতেই কিন্তু এই আমলাদের বেতন দেওয়া হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৩
আপনার মতামত জানানঃ