দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয় পোশাক এবং রেমিট্যান্স খাতকে। দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা আসে এ দুই খাত থেকে। কিন্তু নানা কারণেই খাত দুটিতে ক্ষয় ধরেছে। একইসাথে এই দুর্যোগকালীন বাড়ছে আশঙ্কা ও আতঙ্ক।
পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি
সেপ্টেম্বরের মতো চলতি অক্টোবর মাসেও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়তে চলেছে বাংলাদেশ।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ২০ দিনে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১.৭৭ বিলিয়ন ডলারের যা, গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২.১৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০ দিনে পোশাক রপ্তানি কমেছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রধান বাজারগুলোতে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় ১১ মাস পর গত সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মত সাড়ে সাত শতাংশ পোশাক রপ্তানি কমে যায় বাংলাদেশের।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, চলতি মাসে এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে এবং আগামী কয়েক মাস এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে।
পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় এর কাঁচামালের চাহিদাও কমে গেছে ব্যাপকহারে। এর ফলে সুতা ও তুলার দাম কমে গেছে। গত ছয় মাসের মধ্যে এখন তুলার দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
আইসিই ফিউচারস ইউএসের তথ্যমতে, গত মে মাসের তুলনায় সর্বশেষ ২২ তারিখের হিসাব অনুযায়ী, তুলার দাম কমেছে ৫০ শতাংশ। এর ফলে স্থানীয় স্পিনিং মিল মালিকদেরও বিপুল পরিমাণ তুলা ও সুতার স্টকপাইল হয়ে আছে। অতীতে বাড়তি দামে তুলা কেনার পর এখন তারাও লোকসানে পড়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা এ পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছেন।
কমেছে রেমিট্যান্সে
প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে সব ব্যাংকে ডলারের দর নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১০৭ টাকা, আগে যা ছিল ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা। তবে রপ্তানির ক্ষেত্রে ডলারের দর ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রোববার বৈঠকে বসে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রবাসী আয়ে ডলারের এই নতুন দর ১ নভেম্বর থেকে সব ব্যাংকে কার্যকর হবে। তবে রপ্তানি নগদায়ন বিল কার্যকর হবে সোমবার থেকে।
আমদানির ক্ষেত্রে আগের মতোই রেমিট্যান্স আহরণ ও রপ্তানি বিল নগদায়নে ব্যাংকগুলোর গড় খরচের সঙ্গে এক টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করবে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ স্প্রেড সীমা হবে এক টাকা।
ডলার নিয়ে প্রায় এক মাস পর বৈঠক করল এই দুই সংগঠন। এর আগে সবশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর বৈঠকে প্রবাসী আয়ে ডলার প্রতি ৫০ পয়সা কমিয়ে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। ওই বৈঠকে প্রবাসী আয় ছাড়া রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দরে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন বাফেদা চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম।
প্রবাসী আয়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা কমানোর কারণ হিসেবে আফজাল করিম বলেন, `বর্তমানে ডলারের ওপর চাপ কমে আসায় নতুন দর নির্ধারণ করা হয়েছে৷ ১ নভেম্বর থেকে নতুন দর কার্যকর হবে। যেসব ব্যাংকে ডলার কেনা রয়েছে তারা ডলারের দর এই সময়ের মধ্যে সমন্বয় করবে।’
পৃথিবীজুড়েই সব উন্নয়নশীল দেশ দুটো সমস্যায় পড়েছে – এক, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং দুই, এক্সচেঞ্জ রেট আয়ত্তে রাখতে না পারায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটাই হবে আন্তঃব্যাংক ডলার বিনিময় হার। এতে আমদানিকারকের খরচ কমবে বলে মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশে দেশে মুদ্রার দরপতনের যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সাত মাসের কম সময়ে দেশের মুদ্রার দর পতন হয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। এই যুদ্ধ শুরুর আগে ডলারের দর ছিল ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা।
আর্থিক সংকট সামলাতে কী ভূমিকা রাখতে পারবে আইএমএফের ঋণ?
প্রায় চারশো কোটি ঋণ চেয়ে গত ২৪শে জুলাই আইএমএফের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশের সরকার।
গত বেশ কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। টাকার সাথে ডলারের বিনিময় হার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যায়ের ভারসাম্য ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সেই সংকট সামলাতেই এখন আইএমএফের কাছে ঋণ চাইছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও ঋণ পাওয়ার চেষ্টা চলছে।
যখন কোন দেশ ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা রিজার্ভ নিয়ে সংকটে পড়ে, তখন সাধারণত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দ্বারস্থ হয়।
কিন্তু আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। অতীতে এরকম শর্তের কারণে বাংলাদেশে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু হয়েছিল।
তবে আর্থিক খাতের সংস্কারের এসব শর্তের বাস্তবায়ন অজনপ্রিয় হয়ে ওঠার আশঙ্কায় অনেক সময় সরকার ঋণ নিতে চায় না।
কিন্তু এবার রিজার্ভ সংকটের কারণে সেসব ঝুঁকি নিয়েই আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে সরকার।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”পৃথিবীজুড়েই সব উন্নয়নশীল দেশ দুটো সমস্যায় পড়েছে – এক, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং দুই, এক্সচেঞ্জ রেট আয়ত্তে রাখতে না পারায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এসব ঘাটতি সামলাতে গিয়ে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। কাজেই এই জায়গায় এখন কাজ করতেই হবে। ”
তিনি বলেন, ”আমি মনে করি, এই জায়গাতেই আইএমএফ ভূমিকা রাখতে পারবে। আইএমএফের প্রোগ্রামের মূল বিষয় কিন্তু টাকা নয়, বরং অর্থিক নীতির সংস্কার। ফলে যে ডেলিগেশন আসবে, সরকার এবং আইএমএফের মধ্যে আলোচনায় সেটা পরিষ্কার হবে। সেই সংস্কারগুলোই হবে আসল বিষয়, যেটা আর্থিক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলবে।”
এখন বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিমাসে ১২০ কোটি ডলার বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এর ফলে রিজার্ভ লেভেলও কমে যাচ্ছে। ফলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন সরকারকে এমন একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যাতে বাজার তার নিজস্ব গতিতেই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৫
আপনার মতামত জানানঃ