করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশেই। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মানও কমেছে। এতে আমদানি পণ্যের খরচ বেড়েছে। এসব মিলে পণ্যের দামে পাগলা হাওয়া বইছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান এমনকি শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশে পণ্যের দাম বেশি হারে বেড়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ পণ্য ও পরিষেবার মূল্য দক্ষিণ এশিয়ার গড় দামের চেয়েও বেশি।
বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশে আধা কেজি পাউরুটির দাম ৬২ টাকা, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
তিনি বলেন, আধা কেজি পাউরুটির দাম পাকিস্তানে ৪৫ টাকা; ভারত ও নেপালে ৪৮ টাকা। এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও একই পরিমাণ পাউরুটির দাম ৫০ টাকা, যা বাংলাদেশের তুলনায় যথেষ্ট কম।
রাজধানীতে সিপিডির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘স্লোডাউন ইন গ্লোবাল ইকোনমি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস ফর বাংলাদেশ: হাউ টু ট্যাকেল?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছে সংগঠনটি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলমান মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ সমস্যায় পড়েছে।
জনগণ যাতে স্বাভাবিকভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সেটি নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর আমদানিতে অগ্রিম আয়কর, অগ্রিম কর এবং নিয়ন্ত্রক শুল্ক অপসারণের সুপারিশ করেন।
তিনি আরো বলেন, ন্যূনতম মজুরি উপার্জনকারী শ্রমিকরা যাতে অন্তত মৌলিক খাবার কিনতে পারে তা নিশ্চিতের জন্য মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের উচিৎ সবক্ষেত্রেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করা।
সম্মেলনে বক্তারা আরো বলেন, দেশে বর্তমানে ১ কেজি গরুর মাংস কিনতে গুণতে হয় ৬৮৪ টাকা, যা দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে সর্বোচ্চ। তাছাড়া, বিশ্বব্যাপী গরুর মাংসের গড় দামের (৫৪৯ টাকা) চেয়েও বেশি এটি।
সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে এক কেজি গরুর মাংসের দাম প্রতি কেজি ৩৭৫ টাকা, যা বাংলাদেশের ৬৮৪ টাকার প্রায় অর্ধেক। অন্যদিকে, ভারতে গরুর মাংসের দাম প্রতি কেজি ৫৮০ টাকা, নেপালে প্রতি কেজি ৪৬৫ টাকা এবং শ্রীলঙ্কায় প্রতি কেজি ৫৪৫ টাকা।
সেখানে বলা হয়, সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ঐতিহাসিক (ভয়াবহ) অবস্থায় চলে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস দেখা দিচ্ছে৷ বাংলাদেশ এর বাইরে নয়।’
মূল্যস্ফীতির লাগামহীন অবস্থা। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যর দামও বেশি। এটা কমার কোনো লক্ষণ নেই।
খাদ্যসংকটের আভাস স্পষ্ট। এ জন্য স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করে সিপিডি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির লাগামহীন অবস্থা। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যর দামও বেশি। এটা কমার কোনো লক্ষণ নেই।
খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুইটি কাছাকাছি অবস্থান করছে। তবে বাজারের চিত্রে দেখা যায় পণ্যমূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য প্রকৃত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা উচিত।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় চারজনের একটি পরিবারে ২২ হাজার ৪২১ টাকা খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে। মাছ-মাংস বাদ দিলেও ৯ হাজার ৫৯ টাকা লাগবে। এটা কম্প্রোমাইজ ডায়েট বা আপসের খাদ্যতালিকা।
বেতন প্রতিবছর ৫ শতাংশ বাড়লেও সেটা ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম৷
২৯টি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে করহার অনেক বেশি। এ জন্য এটার প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপর। ১০ থেকে ৯০ শতাংশ কর রয়েছে। এটা কমানো গেলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমত।
আমদানি খরচ বেশি। এ জন্য আমদানিতে বিকল্প বাজার দেখতে হবে। পণ্য আনতে গেলে ভারত ছাড়া সব দেশ থেকে খরচ বেশি৷
এদিকে, গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২২-এ বাংলাদেশকে খাদ্য সংকটে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডা. ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সামর্থের বাইরে যেয়ে খরচ করার হারও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যোৎপাদন কমতির দিকে। ব্যাপক খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কায় পড়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ। বাইরে থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী বছর দেশগুলোয় খাদ্য ঘাটতি বড় সংকটের আকার নেবে। মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা এসব দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশেরও।
বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে এফএও। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সংস্থাটির ক্রপ প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন শীর্ষক প্রান্তিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশভুক্ত দেশ আছে নয়টি, বাংলাদেশসহ যার তিনটিই আবার দক্ষিণ এশিয়ার।
জলবায়ু পরিবর্তন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে চাপে পড়েছে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা। জ্বালানি সংকট ও আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারের অস্থিরতায় ক্রমেই জটিল রূপ নিচ্ছে পরিস্থিতি। বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে সার ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনেও। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় অভ্যন্তরীণ নানা প্রভাবক এ সংকটকে স্থানীয় পর্যায়ে আরো মারাত্মক করে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমশই লাগামহীন হয়ে পড়েছে। করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই পরিস্থিতি কেমন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবজির দাম বাড়লেও কৃষক যে লাভবান হবে তা কিন্তু হচ্ছে না। কৃষক যেসব পণ্যের দাম ৫ টাকা পাচ্ছে সেসব পণ্য কারওয়ান বাজারে আসতে আসতে তিনগুণ দাম বাড়ছে । অর্থাৎ একটি সিন্ডিকেট এ দাম বাড়াতে মূল ভূমিকা পালন করছে। দেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ার এই অস্বাভাবিক অবস্থায় দিশাহারা মানুষ। তারপরও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে।
এসডব্লিউ/এমন/কেএইচ/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ