যখন কোনো কারণে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর কোনো ঋণ বা ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়া যায় না বা সম্ভব হয় না; তখন ওই ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে।
বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা এই খেলাপি ঋণ। অনেক পদ্ধতি, কৌশল ও প্রচেষ্টা অবলম্বনের পরও তা আজও হাতের নাগালের বাইরে।
সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সাড়ে তিন বছরের মাথায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জানা যায়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক—ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। ২০১৯ সালেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ করে দিলে পরের বছর ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমে আসে ৪৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকায়। তবে পরের বছরেই (২০২১) তা আবার বেড়ে হয় ৫০ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে তা আরও বেড়ে ৫৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ সাড়ে তিন বছরে ছয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ, অবলোপন থেকে আদায়, শীর্ষ ২০ খেলাপি ঋণগ্রহীতা থেকে আদায়, ঋণ-আমানত অনুপাত এবং মামলায় আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ নিয়ে ৩ অক্টোবর বৈঠক করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরাই (এমডি) উপস্থিত ছিলেন। সার্বিক কৃতিত্বের (পারফরম্যান্স) মূল্যায়ন করে বৈঠকে ব্যাংকগুলোর ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। এই ব্যাকের মোট ঋণের ২৫ শতাংশই খেলাপি, যার পরিমাণ ১৭ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
আর সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংকের মোট ঋণের ১৭ শতাংশ খেলাপি, যার পরিমাণ ১০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ শতাংশ, পরিমাণ ৬ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ, যার পরিমাণ ৭৬৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকে। টাকার অঙ্কে যা ৮ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা।
২০২২ সালে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অথচ ছয় মাসে ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ অর্থাৎ ১০৫ কোটি টাকা।
খেলাপি আদায়েও পিছিয়ে আছে জনতা ব্যাংক। মোট খেলাপি ঋণের ৬ থেকে ৭ শতাংশ অর্থ আদায় করতে বিডিবিএল ছাড়া পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গেই সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের হলেও খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে সবচেয়ে পিছিয়ে এই ব্যাংক। ব্যাংকটি ২০১৯ সালে ৯০৪ কোটি, ২০২০ সালে ১৭৯ কোটি এবং ২০২১ সালে ২৮৩ কোটি টাকা আদায় করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে করা ব্যাংকটির এমওইউ অনুযায়ী, ২০২২ সালে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অথচ ছয় মাসে ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ অর্থাৎ ১০৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এমওইউ অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৬৫, অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২৪৮, রূপালী ব্যাংক ৬৭০ কোটি টাকার মধ্যে ১১৭ কোটি, বেসিক ব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার থেকে ১৪৬ এবং বিডিবিএল ৯৮ কোটি টাকার মধ্যে ১৬ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে পাওনা ২১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকেরই রয়েছে ৮ হাজার ১০৯ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংককে চলতি বছর শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা আদায় করতে বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো গত ৩০ জুন পর্যন্ত আদায় করেছে মাত্র ১১৯ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি আদায় করেছে অগ্রণী ব্যাংক। বেঁধে দেওয়া ৩০০ কোটি থেকে ব্যাংকটি আদায় করেছে ৮৭ কোটি টাকা।
আর জনতা ব্যাংক ৮০০ কোটির মধ্যে ১০ কোটি, সোনালী ব্যাংক ৩০০ কোটির মধ্যে মাত্র ৩৮ লাখ, রূপালী ব্যাংক ৩৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ২ কোটি, বিডিবিএল ১০ কোটি টাকার মধ্যে ২ কোটি এবং বেসিক ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৮ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।
পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকগুলো পায় বাংলাদেশ। সব ব্যাংক রাষ্ট্রীয়করণ করার পর নতুন করে যাত্রা শুরু করে। নতুন যাত্রায় সঙ্গী ছিল খেলাপি ঋণ। এরপর বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরু ১৯৮৩ সাল থেকে। অল্প সময়ের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকেও আঁচড় কাটে খেলাপি ঋণ। এরপর কয়েক দফায় দফায় নতুন নতুন বেসরকারি ব্যাংক হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে সব ব্যাংকই খেলাপির ছোবলে পড়ে।
খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যার থেকে কোনোভাবে কেউ বাদ যায়নি। বলতে গেলে বাদ যাওয়ার চেষ্টাও করেনি। এই সংস্কৃতি বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপও কোনো পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। তবে সব সময় খেলাপি ঋণ লুকানোর নিত্য নতুন কৌশল আবিষ্কার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা নামে ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দিয়েছে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য এককভাবে কোন কারণকে দায়ী করা যাবে না। এক সময় ছিল কাগজপত্র ছাড়াই বা জাল কাগজপত্র দাখিল করে নামে-বেনামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নানা চক্র। এই দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ীদের পারস্পারিক যোগসাজশ রয়েছে। আইন-কানুন পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণের ফলে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ার সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। এখন দুর্নীতি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারে এবং ব্যাংকের মালিকদের দৌরাত্ম্যে।
তারা জানান, ব্যাংকের টাকা মূলত জনগণের আমানত। এই আমানতের তুছরুপ হচ্ছে। যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি হচ্ছে ওই পরিমাণ টাকা বেহাত হচ্ছে, ওই ঋণের বিপরীতে ব্যাংক কোন আয় করতে পারছে না, আবারও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে ঋণ কার্যক্রমে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এই ব্যয় বৃদ্ধির ফলে আমানতের সুদ হার কমছে, ঋণের সুদ হার বাড়ছে এবং বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও কমে যাচ্ছে। শুধু লাভবান হচ্ছেন দুর্নীতিবাজরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৮
আপনার মতামত জানানঃ