বাংলাদেশে জরুরি ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত জুলাই থেকেই দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবতা আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমনি। এখনো ভোজ্যতেল ও চালের অস্বাভাবিক দামে নাকাল ভোক্তারা। পেঁয়াজ, আলুর দামও চড়ছে কয়েক মাস ধরে। নতুন করে দাম বৃদ্ধির তালিকায় যুক্ত হয়েছে রসুন। পরিস্থিতি নির্দেশ করছে, বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা যেভাবে চাইছেন সেভাবেই চলছে বাজার। শিগগিরই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে, আবারও এমন আশ্বাস শোনানো ছাড়া মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আরও ১০ টাকা বৃদ্ধি অথবা এক স্তরের ভ্যাট চায় বিপণন কম্পানিগুলো। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের এই দাবিও পূরণ হয়ে যাবে। বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে দ্রুত। ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, কেজিপ্রতি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭০ টাকা দরে। আর মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা। এ ছাড়া নিম্নমানের মোটা চালের কেজিও এখন ৪৮-৫০ টাকা। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের লিটার ১১০ টাকা।
বাজারে প্রতি কেজি ভালো মানের পুরনো আলুর কেজি ৪৫, নতুন ৫০-৫৫, দেশি পুরনো পেঁয়াজ ৭০-৮০ ও নতুন পেঁয়াজ ৬০-৭০ টাকা। এ ছাড়া ভালো মানের রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা দরে। চট্টগ্রাম নগরীতে সপ্তাহ ব্যবধানে নাজিরশাইল চালে কেজিপ্রতি ৮ টাকা বেড়ে গতকাল ৬৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। মোটা স্বর্ণা চালে কেজিতে ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৫৪ টাকায়। আর কেজিপ্রতি ৪ টাকা বেড়ে বিরি-২৮ চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬ টাকা দরে। দেশি পুরনো পেঁয়াজ কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা ও আমদানি পেঁয়াজ প্রকার ও মানভেদে ৫-১৫ টাকা বেড়ে ৩০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর নাখালপাড়ায় থাকেন রিকশাচালক ইব্রাহীম আদহাম। তিন সন্তান ও পিতামাতসহ তার সংসারে মোট সাতজন সদস্য। তিনি গতকাল সগবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘রোজ তিন কেজির বেশি চাউল লাগে। কেজিতে দাম বাড়ছে ৮-১০ টাকা। হিসাব করলে মাসে ১ হাজার টাকা খালি চাউলেই নাই। ত্যাল (সয়াবিন তেল), পেঁয়াজ, আলু সবকিছুরই দামই বাড়ছে। ওএমএসের গুদামের চাউল কিনতে বড় লাইন। সেখানে যে সময় যাবে, তাতে একটা ট্রিপ হয়। এমনিতেই করোনার পর থেকে ট্রিপ কমে গেছে। তাই সময় নষ্ট করি না। আমাদের দুঃখ বোঝার মতো কেউ নাই।’
চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে ১৪ ডিসেম্বর থেকে, এ কথা জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম। চালের দাম এখনো নিয়ন্ত্রণে না আসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘আজকে বললাম আর কালকেই দাম কমবে, বিষয়টা এমন না। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। কৃষক বেশি দামে ধান বিক্রি করছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাই মিলাররা চালের দাম বেশি নেবেন। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি কোথাও কিন্তু অতিরিক্ত চাল মজুদ নেই। যেটা বলতে পারেন সেটা হলো মিলাররা বেশি করে ধান কেনায় বাজারে ধানের দামটা একটু বেশি বেড়ে গেছে। এতে তো কৃষকের লাভ হচ্ছে। আমরা মোটা চাল আমদানি করতেছি। এ সপ্তাহেই এটা আমরা পাব। আর ৪ লাখ টন চাল আমদানির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। একটু অপেক্ষা করেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমদানিকৃত চাল কেবল খাদ্য অধিদপ্তর বিক্রি করবে, নাকি খোলাবাজারে বিক্রি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মোটা চাল আমদানি করছি। এটা ওএমএস (খোলাবাজারে) বিক্রি হবে। এতে যারা মোটা চাল খায় তাদের খুচরা বাজারে যেতে হবে না। ফলে বাজারে চালের ওপর চাপ কমবে।’ খুচরা বাজারের জন্য চাল আমদানি করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে তো দেখি কী অবস্থা দাঁড়ায়। প্রয়োজন হলে সেটাও করব। এ ছাড়া আগামী মাসে ওএমএসের আওতা আরও বাড়ানো হবে।’
এদিকে গত ৫ মাসে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৩-২২ টাকা বাড়িয়েছে বিপণন কম্পানিগুলো। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় খরচ বেশি পড়ছে উল্লেখ করে গত ১৫ নভেম্বর লিটারে আরও ১০ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিপণনকারী ম্পানিগুলোর সমিতি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। প্রস্তাবিত দর যৌক্তিক কি না, তা যাচাই করতে ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণারয় গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। কিন্তু এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। তাই বাজারে লিটারপ্রতি সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে।
তীর ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল উৎপাদক কম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ^জিৎ সাহা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয় বসেছিল। আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি। তিন স্তরের ভ্যাট থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে খরচ বাড়ে। কমলে খরচ কমে। সরকার যদি এক স্তরের ভ্যাট করে তাহলে এই সমস্যা থাকে না। কিন্তু মন্ত্রণালয় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।’
পেঁয়াজের দামের বিষয়ে শ্যামবাজার বণিক সমিতির সহসভাপতি আবদুল মাজেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এত দিন কুয়াশা থাকায় কৃষক পেঁয়াজ তুলতে পারেননি। আর পুরনো পেঁয়াজের সরবরাহ তো প্রায় শেষ। তাই দাম কিছুটা বাড়তি। আবহাওয়া এখন কিছুটা ভালো। বাজারেও নতুন পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। আগামী সপ্তাহে দাম আরও কমবে। রসুনের অবস্থাও একই। নতুন রসুন বাজারে আসতে শুরু করলে এই সমস্যা আর থাকবে না।’
ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। এক টাকা মূল্যবৃদ্ধির কারণ সৃষ্টি হলে বাজারে সেই পণ্যটির দাম পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। যথাযথ তদারকির অভাবেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। মজুদ, সিন্ডিকেট, গুজবের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেয়ার পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ এবং আমদানিতে জোর দিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠনও সময়ের দাবি বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের সংগঠকরা।
এসডাব্লিউ/ডিআর/আরা/১১৫০
আপনার মতামত জানানঃ