গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে অনিয়মের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের দায়ী করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ভোটগ্রহণ অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে মর্মে লিখিত বক্তব্য দিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন প্রিসাইডিং অফিসার।
অনেকে দাবি করেছেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তাদের বিবৃতিতে মোট ভোটের পরিসংখ্যান লিখতে বাধ্য করেছেন।
সাঘাটা উপজেলার মথরপাড়া দাখিল মাদ্রাসার ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. মশিউর রহমান জানান, গোপন বুথে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি প্রবেশের কারণে দুপুর ১টার দিকে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
তিনি জানান, তিনি যখন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত সাঘাটা উপজেলা কমপ্লেক্সে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন প্রায় ২০০-৩০০ এলাকাবাসী তাকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের হতে বাধা দেন এবং ভোটের ফলাফল ঘোষণার দাবি জানান।
শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে মর্মে একটি বিবৃতি লিখতে তারা আমাকে চাপ দিতে শুরু করেন। ওই পরিস্থিতিতে সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে মশিউর বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে মাত্র ৪ জন পুলিশ সদস্য ছিল। তাদের পক্ষে এত বড় ভিড় দমন করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ডেকেছি।’
ম্যাজিস্ট্রেট তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল দলকে ডাকতে বলেন জানিয়ে মশিউর বলেন, ‘টহল দলের ৪ জন পুলিশ সদস্য এসে যোগ দেয়। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তারাও যথেষ্ট ছিল না।’
নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ স্থগিত করার পর, আমরা সবকিছু নিয়ে উপজেলা পরিষদে ফেরার প্রস্তুতি নেই। হঠাৎ করেই স্থানীয় ১৫-১৬ জন যুবক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ঘেরাও করেন এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার জন্য আমাকে চাপ দিতে থাকেন।
সদুল্লাপুর উপজেলার ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোকসানা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার পর প্রিসাইডিং অফিসার আমাকে কল করেন। আমি অন্য ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলাম। এ কারণে টহল দলকে ডাকতে বলেছিলাম।’
দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা ১৬ জন প্রিসাইডিং অফিসারের মধ্যে অন্তত ৪ জন দাবি করেছেন, তাদেরকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পোলিং এজেন্টরা লিখিত বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছিল যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
যদুরতাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও যদুরতাইর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আব্দুল লতিফ জানান, প্রায় ১৫-১৬ জন যুবক তাকে ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে মর্মে বিবৃতি লিখতে বাধ্য করেন।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ স্থগিত করার পর, আমরা সবকিছু নিয়ে উপজেলা পরিষদে ফেরার প্রস্তুতি নেই। হঠাৎ করেই স্থানীয় ১৫-১৬ জন যুবক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ঘেরাও করেন এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার জন্য আমাকে চাপ দিতে থাকেন। আমি পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি। তাই ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল, এমনটি লিখতে হয়েছে। ভোটের সংখ্যাও উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছি।’
গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচন ছিল নিস্তরঙ্গ, উত্তাপহীন। সাবেক ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। যথারীতি বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাতীয় পার্টি। ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকার পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। কোথাও কোনো গোলযোগের খবর পাওয়া যায়নি।
১২ অক্টোবরের এ উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের ভিতরে সিসিটিভি লাগানো হয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনাররা নির্বাচন কমিশনে বসে ভোটের অবস্থা সিসিটিভি ফুটেজের বদৌলতে দেখছিলেন। দেখতে দেখতেই সিইসি যেন ‘চোর’ ধরছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে ৫০টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাদে বাকি প্রার্থীরা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, গাইবান্ধা উপনির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগ যতই সতর্ক হোক, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আগ্রহী হোক না কেন নির্বাচন কমিশন যদি চায় সব ভণ্ডুুল করে দেবে। সেটা যে খুব সহজেই তারা পারে গাইবান্ধা তার এক ছোট্ট উদাহরণ। সামনের নির্বাচন ও উপনির্বাচনগুলোয় কমিশন যদি গাইবান্ধার মতো একের পর এক ঘটনা ঘটায় তাহলে কে কী করবে? নির্বাচন কমিশনই যদি বলে, আসলে এ সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। অবশ্য অনেকে এটাকে ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনারের কৌশল হিসাবেও দেখছেন।
জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক ঘটনা ঘটবে। তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল গাইবান্ধায়। আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য আরও অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে নাকি দেশের জন্য, তা অচিরেই দেখা যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ