সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থ প্রতিবছর বাড়ছে। বাংলাদেশি কারা কারা সুইস ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছে এ বিষয়ে তথ্যের জন্য আলোচনা সমালোচনা থাকা সত্বেও আজও জানা যায়নি সেসব। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে থাকা বিভিন্ন দেশের ব্যাংক হিসাবের তথ্য ভারতসহ ৯০টি দেশের কাছে তুলে দিয়েছে সুইজারল্যান্ড, কিন্তু তালিকায় নেই বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের কোন নাগরিক সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা করছেন, তা জানা যায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য তথ্য পেতে তেমন তৎপরতাও নেই। অর্থাৎ সরকার জানতে চায় না, কারা বিদেশে অর্থ পাচার করছেন।
সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় চুক্তির (অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন বা এইওআই) আওতায় এসব তথ্য পেয়েছে দেশগুলো। বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির এমন কোনো চুক্তি নেই। ফলে বাংলাদেশকে তথ্য দেওয়া হয়নি।
গত সোমবার অনাবাসী ভারতীয় ও দেশীয় সংস্থার প্রায় ৩৪ লাখ সুইস ব্যাংক হিসাবের তথ্য ভারত সরকারের হাতে তুলে দেয় সুইজারল্যান্ড। ওই হিসাবগুলো যেসব ভারতীয় নাগরিক ও সংস্থার নামে খোলা হয়েছে, তারা ১০১টি দেশে ছড়িয়ে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। এ নিয়ে টানা চতুর্থ বছরে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের ‘কালোটাকা’র খবর পেল ভারত।
এখন আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের আন্তর্জাতিক ফোরাম এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হিসেবে বিএফআইইউ দেশটির এফআইইউ থেকে তথ্য নিতে পারে। এগমন্ট গ্রুপ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম। বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের ১৬৬ দেশের এফআইইউ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য
অর্থ পাচার প্রতিরোধের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কর্মকর্তারা বলছেন, এমন চুক্তির জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে; বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। কারণ, এখানে কর ফাঁকির বিষয়টি যুক্ত। অন্য দেশগুলো সেভাবেই তথ্য পাচ্ছে।
বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, হোটেল-রিসোর্ট, ব্যাংক-ব্যালান্স, জায়গা-জমিতে দৃশ্যমান কোটিপতি কারবারিদের; কিন্তু শত কোটি বা হাজার কোটির মালিকদের তথ্য চোখে পড়ে না খুব একটা। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এসব প্রভাবশালীদের বসবাস কানাডার বেগম পাড়ায়, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি কোনো দেশে। কাগজে-কলমে এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো তথ্য নেই; কিন্তু বাড়ি-গাড়ি আছে, আছে বিদেশে ব্যবসা এমনটি নিজেরাও প্রচার করে থাকে।
এদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা টাকার পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
গত জুনে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। দেশের বাইরে তারকা হোটেল, বিলাস প্রাসাদসহ বিভিন্ন সম্পদ গড়া এখন অনেকের শখের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যদিও বৈধ পথে অর্থ নিয়ে এমন বিনিয়োগের সুযোগ নেই।
এতকিছুর পরেও ক্ষমতাসীন সরকারকে এবিষয়ে নীরব ভূমিকায় দেখা যায়। কখনোবা চাইছেন বিষয়টি এড়িয়ে যেতে। কখনোবা এসব না জানার ভাণ করে থাকতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড সম্প্রতি বলেছেন, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধপথে আয় করা হয়েছে—এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য চায়নি।’ জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ আয়োজিত ডিকাব টকে তিনি এসব কথা বলেন।
নাতালি চুয়ার্ড বিষয়টি নিয়ে বলেন, ‘তথ্য পেতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে আমরা সরকারকে জানিয়েছি, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তথ্যের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করা হয়নি। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এ ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব এবং সেটি তৈরি করতে হবে। এটি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছি।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশিরা কত টাকা জমা রেখেছে ওই তথ্য প্রতিবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক দিয়ে থাকে এবং ওই অর্থ অবৈধপথে আয় করা হয়েছে কি না, এটি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’
নাতালি চুয়ার্ডের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা তো দূরের কথা, সুইস ব্যাংক থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাই বাংলাদেশ কখনো করেনি। যদিও আমরা জানি বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে ঠিকই আমানতকারীদের তথ্য পাচ্ছে। আসলে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) নামে সুইস ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো আছে, যা চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। এর আওতায় কেউ যদি নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন, তাহলে সেই তথ্য দিতে বাধ্য থাকে সুইস ব্যাংকগুলো। এই ১২১ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ ও সম্পদ পাচার করে বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলার প্রবণতা নিকট অতীতে বেড়েছে। পাচার হওয়া সম্পদের অধিকাংশই দুর্নীতি ও অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জিত। অর্থ ও সম্পদ পাচারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে উপরের সারিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি দেশের সম্পদ পাচার হওয়ার ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা। কী পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে, সে হিসাব জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে। বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধ পথে অর্থ ও সম্পদ পাচার করেছে, তা ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ, স্বীকার করি। কিন্তু তাদের নামধাম ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করতে বাধা কোথায়?
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অর্থ পাচারকারীদের ব্যাপারে অনুসন্ধান ও তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের গুরুতর ঘাটতি আছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, অর্থ পাচারকারীরা প্রভাবশালী, তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো সংস্থা ব্যবস্থা নিতে চায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৯
আপনার মতামত জানানঃ