২০১১ সালের ২ জানুয়ারি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেবে। তত দিনে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৯০০ কোটি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য এখনকার চেয়ে আরও ৫০ শতাংশ বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে হবে।
আর তাই ভবিষ্যদ্বাণী করা হলো এই বলে যে, ওই দশকের (২০২০ থেকে ২০৩০) মাঝামাঝি নাগাদ পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে। তখন আর সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুদ্ধ হবে না, যুদ্ধ হবে খাদ্য নিয়ে।
তবে খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর ২০৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। তার আগেই পৃথিবীতে খাদ্য সংকট দেখা দেবে। বলা যায় দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালের পর বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে সাড়ে ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্যসহায়তা-সংক্রান্ত শাখা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত আগস্ট মাসে এ তথ্য জানিয়েছে।
এসের মধ্যে রাশিয়ায় রেকর্ড শস্য ফলনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় বৈশ্বিক খাদ্য সংকট সমাধানে আরও ভূমিকা রাখতে আগ্রহী মস্কো। বিশেষ করে, সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলিকে খাদ্য সহায়তা দেবে। গত শনিবার এক ভিডিও বার্তায় এসব কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
রাশিয়ার কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কর্মী দিবস উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে এ ভাষণ দেন তিনি। এসময় তিনি কৃষিকে রুশ অর্থনীতির প্রধানতম খাত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই খাত শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য অর্জন করেছে।
তিনি জানান, চলতি বছর যার ফলে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি (প্রাক্কলন অনুসারে) ১৫ কোটি টন হতে পারে, যারমধ্যে ১০ কোটি টনই হলো গম।
পুতিন আরও বলেন, কিছুকাল আগেও এই মাত্রা অর্জন খুবই কঠিন মনে করা হতো। কিন্তু, বর্তমানে নিজ দেশের নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি সম্ভাবনাও বাড়ছে রাশিয়ার; তাই আমরা বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলিকে সহায়তা দেব’।
আমি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই– খাদ্য নিয়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় রাশিয়া অবদান রাখতে প্রস্তুত; যার আওতায় দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।
এসময় পুতিন স্বীকার করেন যে, নজিরবিহীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাপক প্রতিকূলতার মুখে তার দেশের কৃষিখাত। তবে এসকল বাধা সরকারি সহায়তার মাধ্যমে সমাধান করা হবে বলেও জানান তিনি।
রাশিয়ায় কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও এ খাতে স্বনির্ভরতা আয়ত্তের ওপর জোর দেন পুতিন। একইসাথে, দেশটির গ্রামীণ এলাকার অধিবাসীদের জীবনযাপনের মান উন্নয়নে কাজ করার কথাও বলেছেন।
কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কর্মী দিবস রাশিয়ায় এই খাতে যুক্তদের সরকারি ছুটির দিন। ১৯৯৯ সাল থেকে এটি পালিত হচ্ছে। প্রতি অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় রোববার এটি পালিত হয়।
খাদ্যে পরাশক্তি হয়ে উঠছে রাশিয়া
ব্রিটিশ নাগরিক জে রেনার একজন টেলিভিশন উপস্থাপক এবং প্রখ্যাত খাদ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ফসলের খেতগুলো পরিত্যক্ত বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। তাই গম, ভুট্টা, বার্লির বৈশ্বিক উৎপাদন দিনকে দিন কমবে। একই কারণে (জলবায়ু পরিবর্তন) রাশিয়া হয়ে উঠবে খাদ্যে বৈশ্বিক পরাশক্তি। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমায়িত খাদ্যের চাহিদা ভয়ংকরভাবে বাড়বে। তখন রাশিয়ার দখলে থাকা বিশাল সাইবেরিয়ান প্রেইরি অঞ্চল খাদ্য উৎপাদনের জন্য উন্মুক্ত করবে রাশিয়া।
জলবায়ু পরিবর্তন রাশিয়ার কপালে আশীর্বাদ হিসেবে নেমে এসেছে। সে কথা স্বীকার করে রাশিয়ার এক বিশিষ্ট কলাম লেখক লিওনিদ বারশিদস্কি বলেছেন, ‘বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। দেশটির শস্য পরাশক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।’
২০২০ সালে ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি গম রপ্তানি করেছে রাশিয়া। মার্কিন কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়া ৩ কোটি ৮৫ লাখ মেট্রিক টন গম রপ্তানি করছে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি ৩ কোটি ৬৫ লাখ মেট্রিক টন গম রপ্তানি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে শুধু গম রপ্তানি থেকেই দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৪৫ কোটি ২০ লাখ ডলারে।
রাশিয়া সবচেয়ে বেশি গম রপ্তানি করে মিসর, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। দেশটির রপ্তানি বাজার ক্রমশ বাড়ছে। দ্রুত বর্ধনশীল এ রপ্তানি বাজারের মধ্যে রয়েছে মিসর, পাকিস্তান ও তুরস্ক। শুধু গমই নয়, ভুট্টা, বার্লি এবং ওটস রপ্তানির দিক থেকেও রাশিয়া এখন বিশ্বের এক নম্বর দেশ।
২০১৫-১৬ সালের দিকে রাশিয়ার তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আলেক্সান্ডার তাকাচেভ বলেছিলেন, ‘তেল নয়, শস্য রপ্তানিতে বিশ্বে এক নম্বর দেশ হবে রাশিয়া। আমরা শস্য উৎপাদনে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছি।’ সাত বছর পর তাকাচেভের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছে। রাশিয়া এখন সত্যি সত্যিই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শস্য রপ্তানিকারক দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তন রাশিয়ার জন্য শাপে বর হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপক খরা দেখা দিচ্ছে। ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে এই জলবায়ু পরিবর্তনই রাশিয়াকে এশিয়ার নতুন রপ্তানি বাজার দখল করতে সাহায্য করছে।
কীভাবে সাহায্য করছে? জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রুশ কৃষকেরা তাদের খামারগুলো উত্তর দিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উত্তরের বিস্তীর্ণ ভূমি বছরের পর বছর ধরে পতিত পড়ে ছিল, যে জমিগুলো আগে কখনো শস্য আবাদের জন্য ব্যবহৃত হয়নি। সেসব জমিতে এখন ফসল ফলানো হচ্ছে। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ৫ কোটি ৬৬ লাখ হেক্টর পতিত জমি পুনরুদ্ধার করেছে। সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে এই জমিগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। এখন প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে এই জমিগুলো চাষ উপযোগী করা গেছে।
রাশিয়া তার দেশে ফলন বাড়াতে পশ্চিমা প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে। ২০০৫ সাল থেকে কৃষিকে ‘জাতীয় অগ্রাধিকার’ ঘোষণা করেছে ক্রেমলিন। এর পর থেকে কৃষিতে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে সরকার। রাশিয়া দেখিয়ে দিয়েছে, সরকারি সমর্থন পেলে করপোরেশনগুলোর চেয়ে ছোট ছোট খামারগুলো দক্ষতার সঙ্গে অনেক বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারে। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে ভূমি আইন সংস্কার করে ভূমির মালিকানা উদার করেছে রাশিয়া। এটিও দেশটির ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ