জাতীয় নির্বাচনের মৌসুমের সঙ্গে জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের যেন অলিখিত সম্পর্ক রয়েছে। নব্বই দশক থেকে প্রায় প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি ভেঙেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও দলটিতে যে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে যেন আগের অঘটনেরই প্রতিধ্বনি।
সম্মেলন ডাকা নিয়ে ফের দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ এবং দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এতে সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া দলটিতে আবার ভাঙনের সুর তৈরি হয়েছে।
চিকিৎসা শেষে ব্যাংকক থেকে চলতি মাসেই (অক্টোবর) দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের। তার দেশে ফেরার পরই নতুন করে ভাঙতে যাচ্ছে প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলটি!
ভাঙছে এবারও
জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দলের বর্তমান চেয়ারম্যান ও এরশাদের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জি এম কাদের) বাদ দিয়ে আগামী ২৯ নভেম্বর দলের সম্মেলনের ডাক দেন ভাবি রওশন এরশাদ। অন্যদিকে, জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান বলছেন, দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক রওশন এরশাদের সম্মেলন ডাকার এখতিয়ার নেই। এরপরই দলে রওশনপন্থি প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করেন তিনি। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে অন্তর্কোন্দল দেখা দিয়েছে। বিভক্ত হয়ে পড়েছে দুটি গ্রুপে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল রওশনপন্থিরা যদি সরকারের সমর্থন পায় তাহলে রওশন এরশাদ দেশে ফিরে এসে সম্মেলন করতে চাইলে আবারও ভাঙবে জাতীয় পার্টি।
এদিকে রওশনপন্থিদের দাবি, দুর্বল হলেও ম্যাডাম (রওশন এরশাদ) দেশে ফিরে আসলে এ চিত্র পাল্টে যাবে। এখন যারা দলে জি এম কাদেরপন্থি বলে পরিচিত তারা অনেকে রওশন এরশাদের কাছে চলে আসবেন। এখনও অনেক সংসদ সদস্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তারা বলছেন, জি এম কাদের দলের গঠনতন্ত্রের ২০/১-ক ধারা অনুযায়ী তাদের বহিষ্কারের ভয় দেখাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, কেউ জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে গেলে তাকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ারও ভয় দেখানো হচ্ছে! যে কারণে সংসদ সদস্যরা ভয়ে চুপ আছেন। কিন্তু যখন রওশন এরশাদ দেশে আসবেন এবং সরকারের পুরোপুরি সমর্থন পেয়ে যাবেন, তখন জাতীয় পার্টির অনেক সংসদ সদস্য রওশন এরশাদের দলে ভিড়বেন। জি এম কাদের চাইলেও সেসময় কিছু করতে পারবেন না।
অন্যদিকে জি এম কাদেরপন্থি জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে জি এম কাদেরকে কিছু নাম দেওয়া হয়েছিল। মূলত যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাদের দলে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু জি এম কাদের তাদের দলে ফিরিয়ে নেননি। এখনও তিনি তার অবস্থানে অনড়। তার অবস্থান পরিবর্তন না করলে জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন অনিবার্য। তারপরও শনিবার (৮ অক্টোবর) দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের বৈঠক আছে। বৈঠকের পর বোঝা যাবে আসলে জাতীয় পার্টিতে কী হতে যাচ্ছে।
রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে জি এম কাদেরকে কিছু নাম দেওয়া হয়েছিল। মূলত যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাদের দলে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু জি এম কাদের তাদের দলে ফিরিয়ে নেননি। এখনও তিনি তার অবস্থানে অনড়। তার অবস্থান পরিবর্তন না করলে জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন অনিবার্য।
কাউন্সিল ঘোষণার ইস্যুতে রওশন এরশাদের পক্ষ নেওয়ায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ দলের সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় মসিউর রহমান রাঙ্গাকে। তিনদিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর অব্যাহতি দেওয়া হয় চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধাকে। ২৮ সেপ্টেম্বর জি এম কাদেরের উপদেষ্টা ও বরিশাল মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মহসিন উল ইসলাম ওরফে হাবুলকে দল থেকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেওয়া হয়। এছাড়া শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রংপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এ কে এম আব্দুর রউফ মানিক এবং ময়মনসিংহ জেলা জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. কে আর ইসলামকে দল থেকে অব্যাহতি দেন জি এম কাদের।
নির্বাচন এলেই কেন জাপায় ভাঙন ধরে
জানা যায়, ১৯৮৪ সালে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ প্রথমে ‘জনদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন ঘটান। ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে এরশাদ তার জনদল, বিএনপির একাংশ, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ফ্রন্ট। একপর্যায়ে কাজী জাফর স্বেচ্ছায় ইউপিপি ভেঙে দিয়ে এরশাদের দলে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। ওই সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। পরে এরশাদ যখন বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দেন; আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তাতে যোগ দেননি। তিনি দল ভেঙে গঠন করেন জাতীয় পার্টি-জেপি।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আগে এইচএম এরশাদ বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান। সে সময় জাতীয় পার্টির দুই প্রভাবশালী নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জু এবং এমএ মতিন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি গঠন করে ওই জোটে থেকে যান। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করেন এরশাদ। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদের নাটকীয় অবস্থান আমরা দেখেছি। একবার ঘোষণা দেন- ভোটে যাবেন। আবার বলেন- ভোটে যাবেন না। এরশাদের অবস্থান বদলের খেলায় ক্ষুব্ধ হয়ে দল থেকে বেরিয়ে যান কাজী জাফর আহমদ। তিনি ব্রাকেটবন্দি জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
জাতীয় পার্টির অবস্থান ও পাল্টা অবস্থানের খেলা সম্ভবত এখনও শেষ হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে জাতীয় পার্টির একাংশ তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়ে ভোটে যায়। পরে দলে বিভক্তি তৈরি না হলেও ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর দলটিতে দেবর-ভাবির বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন যে সংকট, তাতে ক্ষমতাসীন দল ২০১৪ সালের মতো ফের রওশন এরশাদের ওপরেই ভরসা করতে চাইবে। আর এর ‘অভিঘাত’ হিসেবে দলটি যদি ফের ভাঙনের মুখে পড়ে, অবাক হওয়া কঠিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি বিশেষ কোনো আদর্শ নিয়ে গড়ে ওঠেনি। যে কারণে সুবিধাবাদীরা নিজের স্বার্থে দলটিতে যোগ দিয়েছে। আদর্শ না থাকায় ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নেতারা দল ভাঙতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। ক্ষমতাসীনরা বরাবরই জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি- উভয় দলই জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করতে চেয়েছে। কেন্দ্রীয় দলগুলোর কারণে দলটিতে বারবার ভাঙন দেখা দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৭
আপনার মতামত জানানঃ