ভারতে বেআইনিভাবে প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়কে শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) শুক্রবার মন্তব্য করেছে।
একাধিক ঘটনার উদাহরণ দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, প্রধানত যেসব রাজ্যে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, সেখানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। বেআইনিভাবে নির্মিত মুসলমান সম্প্রদায়ের বাড়ি বা দোকানপাট আদালতে না গিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে এবং তারা হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে, এ অভিযোগে প্রকাশ্যে পেটানো হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, কোনো ক্ষেত্রেই আদালতের দ্বারস্থ না হয়ে প্রশাসন সরাসরি আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে এবং প্রকাশ্যে শাস্তি দিচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে মন্তব্য করে সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার মহাপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা খোলাখুলি আইন অমান্য করে নিজেরা শাস্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে এই বার্তা দিচ্ছেন যে মুসলমানদের আক্রমণ করার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।
উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, অক্টোবরের ৪ তারিখে; অর্থাৎ গত মঙ্গলবার গুজরাটের খেড়া জেলার একটি ভিডিও চিত্রের কথা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সাদাপোশাকে এক পুলিশ সদস্য বিদ্যুতের পোস্টের সঙ্গে বেঁধে মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু পুরুষকে পেটাচ্ছেন। ওই ব্যক্তির কোমরে রিভলবার গোঁজা রয়েছে।
এ ঘটনা ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে ও সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলে এ ঘটনার প্রশংসাও করা হয়েছে। ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ নারী ও পুরুষের দল ওই জায়গায় একত্র হয়ে পুলিশের এই পেটানোকে চিৎকার করে সমর্থন দিচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবৃতিতে বলছে, তারা গুজরাটি গরবা নাচের অনুষ্ঠানে পাথর ছুড়েছিলেন, এ অভিযোগে মোট ১৩ জনকে প্রকাশ্যে পেটানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ঘটনার পর্যাপ্ত সমালোচনা হওয়ার পরেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঘটনাটিকে দক্ষিণ এবং পশ্চিম এশিয়ার কিছু দেশে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ বা বেত মারার ঘটনার সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে তুলনা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হয়েছে, ভারত ধীরে ধীরে ওই দেশগুলোর মতো ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হওয়ার পথে পা বাড়াচ্ছে। তবে এ সমালোচনা মূলত ইউরোপীয় ও পশ্চিমা ভাষ্যকারেরা করেছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মান্ডসোর জেলায় গত রোববারের একটি ঘটনারও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানেও গরবা নাচের অনুষ্ঠানে পাথর ছোড়ার অভিযোগে ১৯ মুসলমান পুরুষের বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টা এবং দাঙ্গা করার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করার পর তিনজনের বাড়ি আদালতের অনুমতি ছাড়াই ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
ভারতে কয়েক মাস ধরে মুসলমান সম্প্রদায়ের দোকানপাট এও বাড়িঘর আদালতের কোনো অনুমতি ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রশাসন ভেঙে ফেলছে। এ ধরনের ঘটনার ছোট তালিকাও প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।
গত এপ্রিল মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর সামনে আসার পর মধ্যপ্রদেশের খার্গন, গুজরাটের আনন্দ ও সাবরকাঁথা এবং দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী অঞ্চলে প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পত্তিতে প্রশাসনের হাত পড়ে। খার্গনে ১৬টি বাড়ি ও ২৯টি দোকান, আনন্দে ১০টি দোকান ও ১৭টি গুদাম এবং সাবরকাঁথায় ৬টি সম্পত্তি বিনষ্ট করে দেওয়া হয়।
দিল্লিতে দোকান, পণ্য বিক্রয়ের ঠেলা গাড়ি ও বাসস্থান মিলিয়ে ২৫টি স্থাপনা ধ্বংস করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি বলছে, যদিও কর্তৃপক্ষের তরফে সম্পত্তি বিনষ্ট করার পক্ষে একটি যুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
বলা হচ্ছে যে এই নির্মাণগুলো বেআইনি। কিন্তু প্রশাসনের বিবৃতি ও কাজ মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পত্তিই বিনষ্ট করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে মুসলমানদেরই দাঙ্গার সময়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে অংশ নেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে প্রশাসন নিজেই ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ধারাবাহিকভাবে বুলডোজার ব্যবহার করে গরিব এবং প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের বাড়ি, দোকানপাট ইত্যাদি ভেঙে দেওয়ার ভারতীয় প্রবণতা বিদেশেও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ছোট শহর এডিসনে ভারতীয় দিবস পালন করা হয় এবং ভারতের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে একটি বুলডোজার সেখানে উপস্থাপিত করা হয়।
উল্লেখ্য, সেই বুলডোজারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ছবি ছিল। বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট ভেঙে ফেলার রাজনীতি কিছু মাস আগে শুরু করেন আদিত্যনাথ। যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য কিছু কিছু ভারতীয় এর প্রতিবাদও করেছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের শুক্রবারের বিবৃতিতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে জুন মাসে জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটিয়াররা ‘খেয়ালখুশিমতো মুসলমান সংখ্যালঘু এবং নিম্ন আয়ের মানুষ’-এর বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূতভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় সম্পর্কে ভারত সরকারকে জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানব ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্টও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে মুসলিম নির্যাতনের পেছনে মোদির দায় অনেক। গুজরাটে ২০০১ সালে দাঙ্গা বাধিয়ে হাজারো মুসলমান হত্যায় সহযোগিতা করে এর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের হিন্দুত্ববাদের প্রাণভ্রমর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।
এরপর থেকে তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জাতীয়ভাবে নির্যাতনের শিকারে পরিণত করেন। ফলে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপুল সমর্থন অর্জন করে ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন। এমতাবস্থায় তার ও তার রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং সন্ত্রাসী দল ‘আরএসএস’ ভারতজুড়ে দ্বিগুণ উৎসাহে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ হলো হিন্দু উগ্রবাদী নেতাদের মুসলমানগণকে গণহত্যার আহ্বান জানানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রীদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পোশাক হিজাবকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা।
মোদির বর্ণবাদী আচরণ মুসলমান নাগরিকদের কোণঠাসা করে ফেলেছে। বর্তমান ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে একটিতেও মুসলমান মুখ্যমন্ত্রী নেই। ১৫ রাজ্যে একজনও মুসলমান মন্ত্রী নেই। ১০ রাজ্যে একজন করে মুসলমান মন্ত্রী আছেন, যাদের দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেখভাল করা। লোকসভায় বিজেপির ৩০৩ সদস্যের একজনও মুসলমান নন (আকার প্যাটেল, প্রথম আলো: ২৮/০১/২০২২)।
সম্প্রতি আসামে মাদরাসাশিক্ষা আইনকে সংশোধন করে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোতে ইসলামী শিক্ষা বন্ধ করে সাধারণ স্কুল কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম সম্প্রদায় আদালতে গেলে হাইকোর্ট সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। অন্য দিকে বিশ্বখ্যাত দেওবন্দ মাদরাসার বিরুদ্ধেও কৌশলে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
ভারতের কাশ্মির ছাড়া একমাত্র মুসলিমপ্রধান এলাকা, লাক্ষাদ্বীপ যেখানে ৯৮ শতাংশই মুসলমান। সেখানে কয়েক দশক ধরে চলে আসা স্কুলগুলোর শুক্রবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে। গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা, হোটেল-রিসোর্টগুলোতে অ্যালকোহল বৈধ করা, স্কুলে মিডডে মিলে শুধু নিরামিষ খাবার দেয়ার ব্যবস্থা এবং দুইয়ের অধিক সন্তানের বাবা-মাকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা ইত্যাদির মাধ্যমে ৯৮ শতাংশ মুসলমানের এই অঞ্চলে ব্যাপক নির্যাতনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এমনভাবে নানা কৌশলে দেশটিতে থাকা মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে মোদি শাসিত ভারত।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ