ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়েছে ইডেন কলেজ। যদিও ইডেন কলেজে ছাত্রী সংগঠনের এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়। অথচ দেশের নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম সবার আগে সামনে আসে, রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ তাদের অন্যতম। এই কলেজের ওয়েবসাইটে সার্বক্ষণিকভাবে যে স্ক্রলটি চলে, সেখানে লেখা আছে: ‘সন্ত্রাস নয় শান্তি চাই, শঙ্কামুক্ত জীবন চাই।’
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক দলাদলি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা অনৈতিক অভিযোগের কারণে এই কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে আবাসিক হলে থেকে যারা পড়াশোনা করে, তারা কতটা শঙ্কামুক্ত, তা নিয়ে আগেও বহু প্রশ্ন উঠেছে।
আর এখনতো তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে হলে থাকা অনেক ছাত্রীকে দিয়ে নানারকম অনৈতিক কাজ করানো; এমনকি দলীয় পদ-পদবি পাওয়াসহ নানারকম স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ হাসিলের জন্য তাদেরকে নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন কোন রাজনৈতিক নেতার ‘শয্যাসঙ্গী’ হতে বাধ্য করার মতো গুরুতর অভিযোগ করেছে তাদেরই কমিটির অন্যান্য সদস্য।
এদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের যৌন শোষণের অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দায়ীদের বিচার দাবি করেছেন ২১ জন নারী অধিকারকর্মী।
সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তাঁরা এ দাবি জানান।
সেখানে তারা জানান, একে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে না দেখিয়ে, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে বিচার হতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গুঁড়িয়ে ফেলার অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশীয় রাজাকারদের সাহায্যে এদেশের মেয়ে ও নারীদের জোরপূর্বক তুলে নিয়ে ক্যাম্পে রেখে ৯ মাস ধর্ষণ করেছিল, সেই সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইডেন কলেজের নেত্রীদের বিরুদ্ধে তাদের জুনিয়র সহপাঠীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে টর্চার করে পার্টির নেতা বা ব্যবসায়ীদের যৌন উপভোগের জন্য পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে।’
এতে বলা হয়েছে, গত কয়েক দশকে শাসক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে অলিখিত চুক্তি গড়ে উঠতে দেখেছি আমরা। সেই অনুযায়ী, শাসক দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতানেত্রী, কর্মীরা শারীরিক ও মতাদর্শিক লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। প্রতিদানে ছাত্রনেতারা সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির মাধ্যমে ছাত্রাবস্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবে, যা বৈধ উপায়ে কোনো মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর পক্ষে সারাজীবনেও অর্জন করা সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দলকানা কর্ণধাররা, এসব না বোঝার ভান করে থাকবেন, বিনিময়ে তাঁদের নিজেদের ‘অধ্যক্ষ’, ‘ভিসি’ পদ সুরক্ষিত থাকবে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিট বাণিজ্যের সন্ত্রাস ও অপরাধের রাজত্বে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীরা ছাত্রীদের যৌন শোষণের মাধ্যমে নিজের পকেট ও নেতৃত্বের প্রোফাইল ভারি করার ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছেন।
নারী অধিকারকর্মীরা বিবৃতিতে বলেছেন. ইডেনে প্রবর্তিত ব্যবস্থার দুটি দিক আছে, যেগুলো সমানভাবে ভয়াবহ। ছাত্র রাজনীতিতে ইচ্ছুক মেয়েদের মধ্যে ধারণা বপন করা হয়েছে, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে নেতাদের সঙ্গে রাত কাটাতে হবে। দ্বিতীয় দিকটি হলো, ছাত্রলীগ নেত্রীদের পরিচালিত যৌন অপরাধ চক্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নির্দেশ না মানলে নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হবে। মারধর, বিবস্ত্র করে ছবি তুলে ‘ভাইরাল’ করার হুমকি, ‘শিবির’ তকমা দিয়ে ছাত্রীনিবাস থেকে বের করে দেওয়া হয়। আধিপত্য বিস্তারে দলীয় কোন্দলের কারণে ফাঁস হওয়া এই কাহিনিগুলো নারী আন্দোলন কর্মী হিসেবে আমাদের সংক্ষুব্ধ করেছে। কারণ এই ব্যবস্থার বিস্তার ঘটেছে নারী নেতৃত্বাধীন শাসনামলে। নারী শিক্ষার অগ্রদূত প্রতিষ্ঠান ইডেন কলেজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখাপড়া করেছেন। ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। লক্ষণীয়, সরকার এখনও ইডেনের বিষয়ে নীরব। শিক্ষামন্ত্রী একজন নারী হয়েও কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এমন কিছু দেখিনি। পদত্যাগ করতে চাওয়া তো দূরের কথা।
ছাত্র রাজনীতিতে ইচ্ছুক মেয়েদের মধ্যে ধারণা বপন করা হয়েছে, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে নেতাদের সঙ্গে রাত কাটাতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইডেন শিক্ষার্থীদের যৌন শোষণের সত্য-মিথ্যা উদ্ঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে হবে। একে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে না দেখিয়ে, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে বিচার হতে হবে। যৌন শোষণ দণ্ডনীয় অপরাধ। ইডেনে কলেজে যা যা ঘটেছে, তা সত্য প্রমাণিত হলে ১১ নম্বর ধারার অধীনে কঠিনভাবে শাস্তিযোগ্য।
বিবৃতিদাতারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকর্মী রানী য়েন য়েন, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাজনীন শিফাসহ আরও অনেকে।
সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ করায় সম্প্রতি ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ।
এ ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস।
এ ঘটনার মধ্যেই রিভা ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে এবার অভিযোগ তুলেছেন ওই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখী।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, জান্নাতুলের ওপর সহিংস আচরণ নতুন নয়। আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে।
বৈধ রুমের মেয়েরা উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর করার সময় সভাপতির (তামান্না জেসমিন রিভা) অনুসারীরা তাদের ছবি তুলে পরে রাখেন। সেখান থেকে সুন্দরীদের বাছাই করেন। পরে বাছাইকৃত মেয়েদের রুমে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে খারাপ উদ্দেশ্যে তাদের বিভিন্ন ধরনের কু-প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ, তারা ওই মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করাতে চান।
কিছুদিন আগে একজন মেয়ে কান্না করতে করতে এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন উল্লেখ করে বৈশাখী বলেন, ‘কলেজের কর্মকর্তারা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে জানেন। কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে তারা জব্দ। ’
তিনি আরও বলেন, ‘দলের সুনাম যেন ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্য এতোদিন কিছু বলিনি। কিন্তু ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দিন দিন এমন বৈরী আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। এভাবে চলতে থাকলে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে যাবে। ’
সামিয়া আক্তার বৈশাখী বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাহায্য না করে আমরা যদি সিট বাণিজ্য, মেয়ে বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করি, তাহলে তো ইডেন কলেজেরও বদনাম হবে। ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতিহাসে দেখে এসেছি যে, ছাত্ররাজনীতি নৈতিকতার রাজনীতি। আমাদের যত বড় বড় অর্জন, ইতিহাসের যে মাইলফলক, সবগুলো ছাত্ররাজনীতি থেকেই শুরু হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ছাত্রনেতারা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন দল ছিল। কিন্তু, মূলত একটি আদর্শিক জায়গা থেকেই এই ছাত্ররাজনীতি করা হতো। কিন্তু, যখন শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতির মধ্যে ঢুকে গেল সুবিধার জন্য, তখনই নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা গেল। সেটার ছাপ সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে। আবার বড় বড় রাজনৈতিক দলও নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পাকাপোক্ত করতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। তখন আদর্শ-নৈতিকতা ম্লান হয়ে যায়। এটারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’
বিজ্ঞজনদের মতে, বর্তমান ছাত্রলীগ সরকারের জন্য এখন আর সম্পদ নয়, বোঝাস্বরূপ। তাই এ বোঝা ঝেড়ে ফেলতে হবে। একটা পরিশোধন কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৭
আপনার মতামত জানানঃ