দেশে ব্যাংকে জমা থাকা আমানতের ৮০ শতাংশের বেশি বেসরকারি ব্যাংকের। দেশে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের যাত্রা আশির দশকে। ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবাহকে অবাধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংক বিরাষ্ট্রীকরণের উদ্যোগ নেন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংকের পথচলা শুরু ১৯৮২ সালে। এরপর প্রায় চার দশক পর বর্তমানে দেশে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩-এ। এর মধ্যে এরশাদ আমলে অনুমোদন পেয়েছিল ১০টি ব্যাংক। বিএনপির আমলে অনুমোদন হয়েছে সাতটি। বাকি ২৬টির সবই যাত্রা করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদের শাসনামলে।
২৬ টি বেসরকারি ব্যাংক!
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দলটি ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠা পায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এরপর ১৯৯৯ সালে কার্যক্রম শুরু হয় নয়টি ব্যাংকের। এগুলো হলো ব্যাংক এশিয়া, এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ওয়ান, স্ট্যান্ডার্ড, দ্য প্রিমিয়ার ও ট্রাস্ট ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকারের ওই মেয়াদ শেষ হয় ২০০১ সালের জুলাইয়ে। এর আগে ওই বছরেই প্রতিষ্ঠা পায় আরো তিনটি ব্যাংক—ব্র্যাক, যমুনা ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ১৯৯২ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ১০ বছরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে স্থাপিত এ ২০টি ব্যাংককেই ধরা হয় দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিকাংশ ব্যাংকেরই জন্ম অর্থনৈতিক প্রয়োজনে হয়েছিল উল্লেখ করে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের পর থেকে যে ব্যাংকগুলো এসেছে সেগুলোর মধ্যে একটি-দুটি ছাড়া উদ্ভাবনী পণ্য নিয়ে আসতে পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগের ব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। অর্থাৎ এসব ব্যাংকের অর্থনৈতিক প্রয়োজন ছিল তুলনামূলক কম। এগুলোয় সমস্যাও দেখা দিয়েছে বেশি। গতানুগতিকভাবে দেশে অনেকগুলো ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে। এখন সময় এসেছে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা, সুশাসনের দিকগুলোয় উন্নয়ন ঘটানোর। নিয়মনীতিগুলোও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের বেশির ভাগ ব্যাংকই অর্থনৈতিক কারণেই যাত্রা করেছিল। সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা। এর পর থেকে মিশ্র কারণে বেসরকারি ব্যাংক গড়ে উঠতে শুরু করে। কিছুটা ব্যবসার জন্য, কিছুটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদনা ব্যাংক গড়ে ওঠে। কয়েকটি বিশেষায়িত ব্যাংক হয়েছে, সেগুলো হয়তো সরকার বিভিন্ন কারণে করেছে। ব্যাংকগুলো পুরনো। এগুলোর সমস্যা থাকলেও নানা অবদানও আছে। এখন গোষ্ঠীভিত্তিক ব্যাংক আসছে। কতগুলো প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আসছে, কর্মসংস্থান ব্যাংক আসছে, এগুলোর পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য হয়তো ইতিবাচক ছিল, কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না।
দেশে তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত আটটি বেসরকারি ব্যাংকের সবই যাত্রা করে ২০১৩ সালে। ওই বছর যাত্রা করা ব্যাংক নয়টি হলো এনআরবি গ্লোবাল, ফারমার্স বা পদ্মা, মেঘনা, মিডল্যান্ড, মধুমতি, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, এসবিএসি ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
২০১৬-২১ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ব্যাংকগুলোকে বলা হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক। এ সময়ে প্রতিষ্ঠিত মোট ব্যাংক সংখ্যা চার। এর মধ্যে চতুর্থ প্রজন্মের প্রথম ব্যাংক হিসেবে সীমান্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পায় ২০১৬ সালে। এরপর ২০১৯ সালে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয় কমিউনিটি ব্যাংকের। সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের দুটি ব্যাংক—বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংক।
যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেসরকারি অনেক ব্যাংকেরই অনুমোদন হয়েছিল কোনো প্রয়োজন ছাড়াই। এগুলোয় সুশাসন নিশ্চিতের পথগুলোকেও সংকুচিত করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়মনীতি শিথিল করা হয়েছে। নতুন বেসরকারি ব্যাংকের জন্ম হয়েছে অযাচিতভাবে। ব্যাংক পরিচালনার পরিবেশকেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুর্বল করা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে ব্যক্তি খাতের অনেক ব্যাংককেই কোনো অর্থনৈতিক বা আর্থিক যৌক্তিকতার ভিত্তিতে অনুমোদন দেয়া হয়নি। এর প্রমাণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যারা নতুন ব্যাংক করার ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই যারা করেন, তারা তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিছু নতুন ব্যাংকের বিরুদ্ধে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে ওপর মহল থেকে নির্দেশনা এসেছে। এটা প্রকাশ্য সত্য। এটি দিয়েই বোঝা যায়, ভেতরে কী ছিল। শুধু যে ব্যাংকগুলো প্রয়োজন ব্যতিরেকে আনা হয়েছে তা নয়, এদের সুশাসনের জন্য যেসব ব্যবস্থা ছিল সেগুলোকেও শিথিল করে ফেলা হয়েছে।
অর্থাৎ শুধু অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে নতুন নতুন ব্যাংক হয়েছে তা নয়, যে পরিবেশে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হবে, সে কার্যক্ষমতার জবাবদিহিতার জায়গাগুলোও দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। আগে পরিচালকরা যেন নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ না নেন, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হতো। এখন দেখা যাচ্ছে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে ঋণ দিচ্ছে। দুই ক্ষেত্রেই ফেরত দেয়ার বিষয়েও কোনো দায়বদ্ধতা দেখা যায় না। এ পন্থায় নতুনভাবে ইনসাইডার লেন্ডিং দেখছি। এসব উপায়ে যে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যবহার কোথায় হচ্ছে? দেখা যাচ্ছে অনৈতিকভাবে বের করা অর্থ কোনো উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হচ্ছে না। আবার অর্থগুলো পুঁজি পাচারের অংশে পরিণত হতেও দেখা যাচ্ছে।
অনেকটা একই বক্তব্য পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুরেরও। তিনি বলেন, প্রথম দিকের ব্যাংক গড়ে ওঠার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছিল। ওই সময় ব্যাংক আনতেই হতো। আমাদের ব্যাংক খাতে বেসরকারি ব্যাংকের অবদান অনেক বড়। সরকারি ব্যাংকেরও উন্নতি যতটুকু হয়েছে, তা বেসরকারি ব্যাংক টিকে থাকার জন্য। তারপর বলতে হবে দেশে বেসরকারি খাতে এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না। এখনো নেই। আগেও ছিল না। ব্যাংকগুলো হয়েছে রাজনৈতিক কারণে।
বিশ্বের কোনো দেশে সেনাবাহিনী বা পুলিশ বাহিনীর জন্য ব্যাংক নেই। কিন্তু আমাদের দেশে আছে। এর পরিণতি এখনই দেখা যাচ্ছে। দিনে দিনে ব্যাংক খাত সার্বিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতাও অপ্রতুল। এতগুলো ব্যাংক পরিচালনার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন এমডিও দেশে নেই। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সংখ্যাগত ও সেবার মান দুদিকেই ঘাটতি আছে। এভাবে দুর্বল ব্যাংক খাতকে দুর্বল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আরো দুর্বল করা হচ্ছে। দরকার ছিল কিছু ব্যাংক একীভূত করার। এভাবে যদি ১০টি ব্যাংক করা যেত তাহলে যথাযথ পরিবেশ পাওয়া যেত। দুঃখজনক হলো সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক খাতের গভীরতা কমে গিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ