বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। গত বছরের তুলনায় চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। তার পরও রাজনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কার (৭৯) চেয়ে এক ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ। গেল বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৪তম। শ্রীলঙ্কার অবস্থান ছিল ৭২তম।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ‘গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারত ৬৮তম, মিয়ানমার ৭২তম এবং নেপাল ৭৪তম অবস্থানে রয়েছে।
চারটি মানদণ্ড ক্রয়ক্ষমতা, সহজলভ্য, গুণগত মান ও নিরাপত্তা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও সহনশীলতার ওপর ভিত্তি করে সূচকটি প্রণয়ন করা হয়েছে। সূচকে পয়েন্ট হলো ১০০।
সার্বিক সূচকে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮০তম। এর মধ্যে খাদ্য ক্রয়ক্ষমতায় ৫২ দশমিক ১ পয়েন্ট পেয়ে অবস্থান ৮৭তম এবং খাদ্য প্রাপ্তিতে ৬১ দশমিক ৫ পয়েন্ট পেয়ে ৪৬তম। খাদ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তায় ৫৮ দশমিক ৪ পয়েন্ট পেয়ে অবস্থান ৭১তম এবং টেকসই প্রাকৃতিক সম্পদ ও অভিযোজনে ৪৩ দশমিক ৯ পয়েন্ট পেয়ে অবস্থান ৯৩তম।
খাদ্যনিরাপত্তা সূচকে শীর্ষ দেশ ফিনল্যান্ড। দেশটির অর্জন ৮৩ দশমিক ৭। এর পরই আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস। আর তলানিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। ১০০ পয়েন্টের মধ্যে দেশটির অর্জন ৩৬ দশমিক ৩। এরপরই হাইতি, ইয়েমেন, সিয়েরা লিওন ও মাদাগাস্কার।
তবে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে স্থবিরতা চলে এসেছে। গত ১১ বছরের মধ্যে সারা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার মান সর্বোচ্চ উন্নীত হয়েছিল ২০১৯ সালে। পরের বছর ২০২০ সালেও তা অব্যাহত ছিল। অন্যদিকে ২০২১ সলে তা ৬২.২ পয়েন্টে নেমে আসে, যা চলতি বছরও বিদ্যমান। যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ সরবরাহ সংকটে বৈশ্বিক খাদ্যমানের উন্নতি হচ্ছে না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টসের প্রিন্সিপাল প্রতিমা সিং সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি খাদ্য বাণিজ্যের বড় বাধা হয়েছে। এ ছাড়া পরিবহন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে খাদ্য সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক খাদ্যের সহজলভ্য প্রাপ্তি কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে অনেক দেশকে। সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা কিছুটা ঝুঁকিতে থাকবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অবশ্যই সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করতে হবে।
সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা কিছুটা ঝুঁকিতে থাকবে।
বাংলাদেশ মূলত দুটি মানদণ্ডে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে টেকসই প্রাকৃতিক সম্পদ ও অভিযোজন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বেশ শক্তিশালী হলেও ব্যবস্থাপনায় বেশ দুর্বলতা রয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। তবে পানি ও ভূমি ব্যস্থাপনায় আরো জোর দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এ ছাড়া খাদ্য ক্রয়ক্ষমতায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। ১১৩টি দেশের মধ্যে ৮৭তম। এই মানদণ্ডের বেশ কিছু উপসূচকে বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি গবেষণা ও উৎপাদন এবং কৃষিপণ্যের বাণিজ্য।
দেশের খাদ্য ও খাদ্যপণ্যের মান নিয়ে যথেষ্ট উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। তবে কৃষি অবকাঠামো, দারিদ্র্য ইস্যু এবং খাদ্য নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে না পারার কারণে খাদ্য ক্রয়ক্ষমতার সূচকে বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রবেশগম্যতার জন্য অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এই মানদণ্ডে বৈশ্বিক গড় যেখানে ৭২.৪ পয়েন্ট, সেখানে বাংলাদেশের অর্জন মাত্র ২৬.৮ পয়েন্ট। কৃষি অবকাঠামো বেশ অনুন্নত এবং টেকসই না হওয়ায় বাংলাদেশের অর্জনকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া দেশের একটি বড় অংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের কাছে খাদ্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি দেখছে দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে দেশের জনগণ তাদের আয়ের বেশিরভাগ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো সকল সময়ে সবার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সকল নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা।
তারা বলছেন, খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা কেবল খাদ্যের প্রাপ্যতা কিংবা আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে না, বরং পুষ্টি ধারণ করার জন্য পরিপূরক শর্ত যেমন নিরাপদ পানীয় জলের প্রাপ্যতা, স্যানিটেশন সুবিধা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃ ও সাধারণ শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। সার্বিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য শরীরে পুষ্টির ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। বাংলাদেশে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও অপুষ্টির উচ্চহার এখনো বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৬
আপনার মতামত জানানঃ