মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্য এবং অনাগত দিনে এর ভূমিকা নিয়ে ঔৎসুক্য বাড়ছে। বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত।
এক দেশ কোনো কিছু আমদানি করবে অন্য দেশ থেকে, মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রধানত ডলারের মাধ্যমে। কিছু রফতানি করবে দেশটি, মূল্য বুঝে নিতে হয় ডলারের মাধ্যমে। এভাবে পৃথিবীতে যত লেনদেন হয় তার ৮০ ভাগেরও বেশি হয় আমেরিকান ডলারের মাধ্যমে। বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমেরিকান ডলারের মাধ্যমে। অতএব প্রশ্ন উঠেছে, ডলারের কি কোনো বিকল্প নেই? আমেরিকান ডলারের বিপরীতে চীনের মুদ্রা ইউয়ান কি বিকল্প হতে পারবে?
বৈশ্বিক মুদ্রা প্রবাহে ইউয়ানের অবস্থান
চায়না সংবাদমাধ্যম ইয়াহু নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের অর্থনীতি অধিকাংশ সূচক অনুসারেই বেশ শক্তিশালী। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১৭.৭ ট্রিলিয়ন ডলার যা যুক্তরাষ্ট্রের পরেই বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরে চীনই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক লেনদেনকারী দেশ।
তবে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক লেনদেনের মাত্র ৩ শতাংশ চীনা মুদ্রায় হয়, যেখানে মার্কিন ডলারে মোট লেনদেনের ৮৭ শতাংশ হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেশটি বৈশ্বিক মুদ্রা প্রবাহে তেমন একটা অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ধীরে ধীরে ইউয়ানের অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে।
আধিপত্য বিস্তারে ইউয়ানের অগ্রগতি
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছর চীনের নেতারা ইউয়ানকে রিজার্ভ মুদ্রার পর্যায়ে উন্নীত করতে স্পষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন। চীনের অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক প্রবাহ এধরনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে এখন চীনকে অন্যান্য বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে রিজার্ভ হিসেবে ইউয়ান সংরক্ষণের জন্য রাজি করাতে হবে।
জুলাই মাসে পিপল’স ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি) পাঁচটি দেশ ও ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটলম্যান্টস (বিআইএস)-এর সঙ্গে কোলাবরেশন ঘোষণা করে। চীনের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং চিলি প্রতিটি দেশ ১৫ বিলিয়ন ইউয়ানের (২.২ বিলিয়ন ডলার) তারল্য চুক্তি করে।
গবেষণা যা বলছে
এদিকে চীনা ইউয়ান ইতোমধ্যেই রাশিয়ার ডি-ফ্যাক্টো রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া চীনের মুখাপেক্ষী হয়। বর্তমানে রাশিয়ার ১৭ শতাংশ ফরেন রিজার্ভই ইউয়ানে। মস্কো এক্সচেঞ্জেও ইউয়ান এখন তৃতীয় চাহিদাসম্পন্ন মুদ্রা।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালোফোর্নিয়া বার্কলে-র ব্যারি আইচেনগ্রিন এবং ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যামিলে ম্যাকায়ারের মতো অর্থনীতিবিদরা রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষকরা বলেন, ডলারকে খুব সহজে বা দ্রুত প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে না। তবে তারা দেখতে পান যে, চীনের সঙ্গে যেসব দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে তাদের রিজার্ভ মুদ্রায় ইউয়ানের ব্যবহার বাড়ছে।
‘বহুমেরু’-বিশিষ্ট এক বিশ্বে ইউয়ানের বাড়তে থাকা প্রভাব বিশ্বব্যাপী একে ডলারের বিকল্প করে তুলতে পারে। অন্যভাবে বললে, চীন ধীরে ধীরে ডলারের প্রভাব কমিয়ে আনতে পারে।
গবেষকরা আরও বলেন, ১৯৫০-এর দশকে ডলারের যে অবস্থান ছিল, বর্তমানে ইউয়ান সেই অবস্থানে রয়েছে। সেই হিসেবে ডলারের জায়গায় উঠে আসা- ইউয়ানের জন্য আর কয়েক দশকের ব্যাপার মাত্র। ভবিষ্যদ্বাণী অনু্সরণ করলে, দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারীরা ভালো মুনাফা আসা চীনা শেয়ার ও অন্যান্য ইউয়াননির্ভর খাতে সীমিত হলেও বিনিয়োগ করতে পারেন।
সম্প্রতি বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দেয় সৌদি আরবের এক ঘোষণা, যখন দেশটি বলে চীনের কাছে সে তেল বিক্রি করবে ইউয়ানে। এ ঘোষণা পেট্রোডলারের যুগের অবসানের ভয় ধরিয়ে দেয় আমেরিকায়।
ডলারের উত্থান যেভাবে
আন্তর্জাতিক লেনদেন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণে মার্কিন ডলারের এই আধিপত্য চলে আসছে বহু দশক ধরে। ডলারের জয়যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মিসরের সুয়েজ খালের পাশে গ্রেট বিটার হ্রদে নোঙর করা ইউএসএস কুইন্সি নামের জাহাজে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এবং সৌদি বাদশাহ ইবনে সৌদ উপস্থিত ছিলেন। সৌদি তেলে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকার এবং ডলারের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে দেশটিকে সামরিক সহায়তা দেয়ার অঙ্গীকার করেন রুজভেল্ট। শুরু হয় পেট্রোডলারের যুগ।
এর মধ্যে অনেকবারই সৌদি-মার্কিন সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়িয়েছে; কিন্তু এই চুক্তির বরখেলাপ করেনি কোনো পক্ষই। পরবর্তী দশকগুলোতে তেলের চাহিদা যতই বেড়েছে, মার্কিন ডলারের চাহিদাও বেড়েছে তরতর করে। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম হয়ে ওঠে মার্কিন ডলার। সৌদি আরবের সহায়তায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একক মুদ্রা হিসেবে ডলারকে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বময় অর্থনীতির পাশাপাশি ভূ-রাজনীতিতেও ছড়ি ঘুরিয়ে চলছে যুক্তরাষ্ট্র। চালাচ্ছে অর্থনৈতিক যুদ্ধ।
যেভাবে ডলারের ধস নামছে
সম্প্রতি বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দেয় সৌদি আরবের এক ঘোষণা, যখন দেশটি বলে চীনের কাছে সে তেল বিক্রি করবে ইউয়ানে। এ ঘোষণা পেট্রোডলারের যুগের অবসানের ভয় ধরিয়ে দেয় আমেরিকায়।
অন্যদিকে ২০১৮ সালে আমেরিকার আদেশ অমান্য করে রাশিয়া থেকে ভারত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সরঞ্জাম, এমনকি সার কিনছে রুবলে। ইসরাইলের মতো মার্কিন মিত্রদেশ নিজস্ব মুদ্রার বাইরে শুধু ডলারে আটকে নেই।
ইউক্রেন যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার শিকার রাশিয়ার অভিজ্ঞতা পাঠ করতে বিলম্ব করেনি চীন। সে বুঝতে পেরেছে, এমন একটি নিষেধাজ্ঞা তার জন্যেও অপেক্ষা করছে। ফলে রাশিয়ার মতো ভুগতে না চাইলে বিকল্প বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থা লাগবেই। বর্তমানে চীনের কাছে থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়া দেশের তালিকায় প্রথমে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যার পরিমাণ ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ইউয়ানকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চীনকে দু’টি কাজ করতেই হবে। প্রথমত, ডলারের প্রতি দুনিয়াজুড়ে যে আস্থা তা নষ্ট করতে হবে। এটি তখনই সম্ভব, যখন ফেডারেল রিজার্ভ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হবে। কিংবা যখন এ বিষয়ক পূর্বাভাসগুলো ভুল প্রমাণিত হবে।
চীনকে দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে, তা হলো ইউয়ানের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রমাণ করা। না হয় অন্যান্য দেশের আস্থা অর্জন অসম্ভব। কিন্তু এ স্থিতিশীলতার পথে চীনের সমস্যা চীন নিজেই। সে মাঝে মধ্যেই রফতানি বাড়াতে ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করে। অন্য দেশগুলো কখনোই এমন অস্থিতিশীল মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে রাখবে না। চীন যদি এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল না হতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫৪
আপনার মতামত জানানঃ