পালটে গেছে ইয়াবা লেনদেনের ধরন। মাদক কেনাবেচার জন্য নগদ অর্থ না থাকলে মানুষ ‘বন্ধক’ রেখে ইয়াবা নিয়ে আসছে মাদক কারবারিরা। বন্ধক রাখা ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তের নির্ধারিত আস্তানায় বা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে। এরপর ইয়াবা বিক্রি শেষে টাকা পরিশোধ করে দিলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বন্ধক রাখা ব্যক্তিকে।
মিয়ানমার থেকে ইয়াবা-আইসসহ যেসব মাদক দেশে ঢোকে তার বেশির ভাগই আনা হয় বাকিতে। আগে এ জন্য কোনো কিছু বন্ধক রাখতে হতো না। এখন বন্ধক কিংবা জিম্মা দিয়ে আনতে হয় চালান। বন্ধক হিসেবে রাখা হয় মানুষ। কোনো কারণে চালানের টাকা পরিশোধ না হলে এই বন্ধকি মানুষটির লাশ পড়ে নাফ নদীতে।
সম্প্রতি টেকনাফের স্থানীয়দের বন্ধক রেখে দেশে মাদকের চালান আনার বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় বন্ধক রাখা মানুষদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের এমন পন্থায় রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মাদক প্রতিরোধে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সম্প্রতি বাহারছড়ার বাসিন্দা আলী হোসেনকে বন্ধক রেখে মাদক আনা হয়। পরে নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না হওয়ায় শিকলে বাঁধা হোছনকে রড দিয়ে পেটানোর ভিডিও তার পরিবারের কাছে পাঠায় মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, একজন তার গলায় দা ধরে রেখে টাকা পরিশোধের কথা বলছে। টাকা না পেলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আগস্টের শুরুতে বাহারছড়া ইউনিয়নের চৌকিদারপাড়ার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে নুরুল আমিনকে (২২) মিয়ানমারে বন্ধক দিয়ে একই এলাকার আলী হোসাইনের ছেলে শহীদুল্লাহ ১১ লাখ টাকার ইয়াবার চালান আনে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরে নির্ধারিত সময়ে টাকা না দেওয়ায় নুরুল আমিনকে নির্যাতনেরও একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় দেশের অভিযুক্তরা আত্মগোপনে চলে যায়।
আমার ভাইকে মিয়ানমার থেকে কারেন্ট জাল আনার কথা বলে নিয়ে গিয়ে সেখানে বন্ধক রেখে ইয়াবা নিয়ে এসেছে শহীদুল্লাহ।’
ভুক্তভোগীর বড় ভাই মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমার ভাইকে মিয়ানমার থেকে কারেন্ট জাল আনার কথা বলে নিয়ে গিয়ে সেখানে বন্ধক রেখে ইয়াবা নিয়ে এসেছে শহীদুল্লাহ।’
জানা যায়, ২০২০ সালের শেষের দিকে মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবা লেনদেনের সিস্টেমটা চালু করেন দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র করার দুঃস্বপ্ন দেখা আলোচিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। তার ডেরায় এভাবে মানুষ বন্ধক রেখেই মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে দেশের মাদক কারবারিরা।
সম্প্রতি নবী হোসেনের ডেরায় বন্ধক থাকা বেশ কয়েকজনের ভিডিও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাদের একজন টেকনাফের আলি হোসেন। ভিডিওতে দেখা যায়, মাদকের টাকা পরিশোধ না করার কারণে আলী হোসেনের হাত-পা বেঁধে আমানুষিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং তার গলায় ছুরি ধরে টাকা পরিশোধে দেরি হলে জবাই করে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দিতে দেখা গেছে। তার জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে পরিবার।
এ ছাড়াও সম্প্রতি উখিয়া পালংখালী ইউনিয়নের দিল মোহাম্মদ নামে সপ্তম শ্রেণির এক মাদ্রাসাছাত্রকে নবী হোসেনের কাছে বন্ধক রেখে ৫০ লাখ টাকার ইয়াবা নিয়ে আসে কারবারিরা। ইয়াবার চালানটি বিজিবির হাতে ধরা পড়ার কারণে তাকে আর ছাড়িয়ে আনতে যায়নি কারবারিরা।
জিম্মিদশায় থাকা দিল মোহাম্মদের পরিবারকে ফোন করেন নবী হোসেনের লোকজন। ইয়াবার ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করে তাকে ছাড়িয়ে নিতে বলা হয় দিল মোহাম্মদের পরিবারকে। একপর্যায়ে জিম্মিদশায় থাকা দিল মোহাম্মদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেওয়া হয় তার বড়ভাই সৈয়দ আকবরকে।
সৈয়দ আকবর জানান, জিম্মিদশা থেকে দিল মোহাম্মদ তাকে ফোন করে জানায় যে, দামি মোবাইল ফোন ও ১০ হাজার টাকার লোভ দেখিয়ে কৌশলে তার ভাইকে অপহরণ করা হয়। পরে ইয়াবা কারবারিরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের কাছে তাকে বন্ধক রেখে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা নিয়ে যায়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার ভাইয়ের ফোনে দেওয়া তথ্যমতে বটতলী এলাকার গফুর আলমের ছেলে সোহেলকে আটক করেন এলাকাবাসী। সোহেল আমার ভাইকে মিয়ানমারের ইয়াবা কারবারিদের কাছে বন্ধক রাখার বিষয়টি স্বীকার করে। একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িতদের নামও প্রকাশ করে; যা ভিডিও ধারণ করে রাখা হয়।
এদিকে শুক্রবার রাতে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে নবী হোসেন গ্রুপের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫।
তাদের কাছ থেকে চার লাখ ১০ হাজার পিস ইয়াবা ও একটি বিদেশি একে-২২ রাইফেল, একটি বিদেশি পিস্তল, একটি এসবিবিএল এবং ১৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃরা হলো-নবী হোসেনের ইয়াবা সেক্টরের প্রধান আব্দুল্লাহ রাজ্জাক ওরফে রাজ্জাক মাঝি, ইলিয়াছ, সাহেদ, মো. আয়াছ ওরফে আজিজুল ও সাইফুল ইসলাম। এর মধ্যে রাজ্জাক মাঝি ও আজিজুল হক রোহিঙ্গা। বাকি তিনজন বাংলাদেশের নাগরিক।
র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার বলেন, গোপন সংবাদের ভিক্তিতে অভিযান চালিয়ে নবী হোসেন গ্রুপের এসব সদস্যকে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতাররা র্যাবের কাছে স্বীকার করে যে, নবী হোসেনের ডেরায় মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবা কারবার হয়। তার ডেরায় অনেকেই বন্ধক রয়েছে। ইতোমধ্যে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় বন্ধক থাকা অনেক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে নবী গ্রুপের সদস্যরা।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে ইয়াবা-মাদকের উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে এই মাদক ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার ধারাবাহিকভাবে কঠোর অভিযান চালালেও মাদক থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না দেশের যুবসমাজকে। জিরো টলারেন্স নীতি নেয়ার কারণে ওই সব অভিযানে মাদক কারবারিদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। তার পরও এর বিস্তার রোধ করা যায়নি। বরং দেশে নতুন নতুন মাদকের দেখা মিলছে। এসব মাদক আগেরগুলোর চেয়ে আরো ভয়াবহ।
লক্ষণীয়, দেশে যতই কড়াকড়ি আরোপ করা হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সীমান্তের হাজার হাজার কিলোমিটার পথ যদি মাদক পাচারে ব্যবহৃত হয়, আর সেখানেই যদি গড়ে ওঠে মাদকের কারখানা; তাহলে আমাদের দেশের তরুণ-যুবকদের মাদকের হাত থেকে রক্ষার কোনো উপায় থাকে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২০৩
আপনার মতামত জানানঃ