কপি, কাট, আর পেস্ট একজনেরটা থেকে করলে সেটা চুরি আর কয়েক জনেরটা মিলিয়ে করলে সেটা গবেষণা। চুরি এখানে শিল্প। আর শিল্পী এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক অথবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এক্ষেত্রে তারা অনেকটাই যেন অপ্রতিরোধ্য। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি অন্যের গবেষণাকর্ম পুরোটাই মেরে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি’র ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষক মো. শাহাব উদ্দিন রেট্রাকশনওয়াচ.কম এর সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন।
রেট্রাকশনওয়াচ.কম একটি ব্লগ যা বৈজ্ঞানিক কাগজপত্র এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন করে। ব্লগটি আগস্ট ২০১০ সালে চালু করা হয়েছিল এবং এটি বিজ্ঞান লেখক ইভান ওরানস্কি (সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, এডিটোরিয়াল মেডস্কেপ) এবং অ্যাডাম মার্কাস (গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি এবং এন্ডোস্কোপি নিউজের সম্পাদক) দ্বারা সম্পাদিত। এর মূল সংস্থা হল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক ইন্টিগ্রিটি।
রেট্রাকশনওয়াচ.কম এর প্রতিবেদনে জানা যায়, বৈজ্ঞানিক কাগজপত্র মূল্যায়ন করার একটি প্রযুক্তি সংস্থা ‘রিপেটার'(Ripeta) এর সিইও ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা লেসলি ম্যাকিনটোশ মার্চের মাঝামাঝি একটি ছদ্মনাম অ্যাকাউন্ট থেকে একটি টুইট দেখেন। যেখানে গবেষণাকর্ম চুরির বিষয়ে গণমাধ্যমের নীরবতায় আক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে। অ্যাকাউন্টের মালিক একটি কাগজ খুঁজে পেয়েছেন যেখানে তার লেখা হুবহু মেরে দেওয়া হয়েছে। কেবল বাক্যই নকল করা নয়, কাগজটির পুরো কাঠামো এবং ধারণাটিও হুবহু একই। ম্যাকিনটোশ কাগজটি এবং এর লেখক মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিনের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামেন।
13 months since I reported an obvious case of plagiarism. The paper is still online. Journal gone silent and no longer replying to emails.
Ready to name and shame both authors and the journal.@OpenAcademics @AcademicChatter #academictwitter #sciencetwitter pic.twitter.com/3j1hX9uCiR
— Dr Meming (@Dr_Meming) March 15, 2022
তিনি দেখতে পান, সাহাব উদ্দিন একজন নিউরোফার্মাকোলজি গবেষক, যিনি তার লেখাপত্র তার প্রথম নাম ‘মো.’ নামে প্রকাশ করেন। তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি-র আগেই ২০১৬ থেকে এই কয়েক বছরে ১৬০টি আর্টিকেল বা বইয়ের চ্যাপ্টার প্রকাশ করেছেন। তার সাইটেশন সংখ্যা ৩৬০০!
ম্যাকিনটোশ বলেন, প্রথমে তিনি কেবল কৌতূহল থেকে শাহাব উদ্দিন সম্পর্কে আরও জানতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি রিপেটার স্বয়ংক্রিয় চেকের মাধ্যমে চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত কাগজটি পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি তার অন্যান্য কাজের জন্য ডাইমেনশন ডাটাবেস অনুসন্ধান করেছেন এবং ORCiD এবং Publons-এ সাহাব উদ্দিনের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করেছেন। এর কয়েকদিন পরই শাহাব উদ্দিন তার ORCiD প্রোফাইল, সমস্ত উদ্ধৃতি এবং রেফারেন্স মুছে ফেলেন।
তার অনুসন্ধানগুলো প্রকাশ করার জন্য কী করা উচিত এ বিষয়ে ম্যাকিনটোশ তার একজন সহকর্মীর সাথে পরামর্শ করেন। শাহাব উদ্দিনকে ইমেল করে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করেও যখন জবাব পাননি, তখন তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করা, যেখানে শাহাব উদ্দিন পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছিলেন।
গত ৮ জুন, ম্যাকিনটোশের সহকর্মী হংকং ইউনিভার্সিটির এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ রিসার্চ ইন্টিগ্রিটির ডিরেক্টর ড্যানি চ্যানকে ইমেল করেছিলেন। যেখানে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু করেছে কিনা তা জানতে চেয়েছেন।
চ্যান ওই দিনই জানান যে, বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি দেখছে। এবং পরের দিন বলেন মামলাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির কাছে পাঠানো হবে।
মাসের শেষ দিকে চ্যান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত শেষ হয়েছে এবং শাহাব উদ্দিনের কাছে “সুপারিশ” করেছে। জুলাই ৭-এ একজন কর্মী ম্যাকিনটোশ এবং তার সহকর্মীকে জানান, শাহাব উদ্দিনকে হংকং ইউনিভার্সিটি থেকে প্রত্যাহার করে নেবে এবং তা পহেলা আগস্ট কার্যকর হবে। কর্তৃপক্ষের এহেন পদক্ষেপে ম্যাকিনটোশ মুগ্ধ হন।
জানা যায়, মো. সাহাব উদ্দিন একজন নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট এবং সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের একজন গবেষক। তিনি পিয়ার-পর্যালোচিত আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রচুর নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন এবং সাতটি বই লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন। যার মধ্যে অ্যাডভান্সেস ইন নিউরোফার্মাকোলজি: ড্রাগস অ্যান্ড থেরাপিউটিকস; নিউরোডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডারগুলোর সমালোচনামূলক পরীক্ষার উপর গবেষণার হ্যান্ডবুক; এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষা: স্বাস্থ্য এবং রোগে বায়োমেডিকাল মান।
শাহাব উদ্দিন অসংখ্য স্কলারলি জার্নালের অতিথি সম্পাদক, সম্পাদকীয় এবং পর্যালোচনা বোর্ডের সদস্য হিসেবেও কাজ করেন। তিনি অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সমিতির সদস্য। স্মৃতি, মনোযোগ এবং জ্ঞানের অনুমানের জন্য পাঁচটি নিউরোসাইকোলজিকাল পরীক্ষা তৈরি করেছেন। তাছাড়া, তিনি ফার্মাকন নিউরোসায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক। ২০১৪ সালে ফার্মেসি বিভাগ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করে তার BPharm প্রাপ্ত হন। শাহাব উদ্দিনের গবেষণার আগ্রহ হল কিভাবে আলঝেইমার ডিমেনশিয়া কমাতে নিউরোনাল অপারেশন পুনরুদ্ধার করা যায়।
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শাহাব উদ্দিনের এই অপকর্ম নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাব কামরুল হাসান মামুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে মতামত দিতে গিয়ে বলেন-
আমার ধারণা এই শাহাব উদ্দিন একা না। বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রোফাইল যদি ঠিক মত ইনভেস্টিগেট করা হয় এইরকম আরো অনেক অনেক পাওয়া যাবে। আমি প্রায়ই দেখি কারো কারো আর্টিকেল সংখ্যা বা সাইটেশন সংখ্যা হঠাৎ আকাশ ছোয়ার মত। হঠাৎ কিছু পরিবর্তন মানেই ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। গবেষণাপত্রে চৌর্যবৃত্তির দায়ে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আ জ ম কুতুবুল ইসলাম নোমানীকে পদাবনতি দিয়ে সহকারি অধ্যাপক করা হয়।
পিএইচডি থিসিসে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূর উদ্দিন আলোকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গবেষণা জালিয়াতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক-এর বিরুদ্ধে সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ আছে। এছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সালমা বেগমের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, এ ধরনের ঘটনা এখন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটছে৷ সেখানে এসব ধরার মতো তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলে তারাও থাকেন আড়ালে। তারা মনে করেন, এটা অত্যন্ত লজ্জার যে অন্যের লেখা চুরি করে ডক্টর হচ্ছে, শিক্ষক হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা যা পাচ্ছে সেটা আমাদের সার্বিক শিক্ষার মান দেখলেই বুঝতে পারি। ব্যক্তি স্বার্থের জন্য কিংবা পেশাগত দিক থেকে সুবিধা গ্রহণের জন্য যারা এসব করে থাকে তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তারা মনে করেন, কেবল পদাবনতি নয়, জালিয়াতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রজন্ম রক্ষার স্বার্থে আইনের আওতায় আনা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের কলুষমুক্ত রাখার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তারা বলেন, এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদার প্রশ্ন। এসব ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া ঠিক না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ